ঢাকা, বুধবার, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭

আলম শাইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭

আনুমানিক সকাল নয়টা। সৈকতে কুড়িয়ে পাওয়া বহিরাগত লোকটার হাত-পা বেঁধে বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে দ্বীপবাসী ওদের বাসস্থানের উদ্দেশে হাঁটছে।

শক্ত করে বেঁধে রাখায় লোকটা নড়াচড়া করতে পারছে না; ব্যথা পাচ্ছে খুব। ব্যথার চোটে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। বারবার বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। এদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণায়ও কাহিল লোকটা। সকালে সৈকতের কিনারে একটা বড়সড় ডাব পেয়েছিল। ডাবটার মুখ থেঁতলানো থাকায় পানিটুকু খেতে পেরেছে কোনরকম। ডাবের শাঁস খেতে পারেনি সঙ্গে ছুরি-চাকু জাতীয় কিছু না থাকায়। তাছাড়া শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, নড়াচড়াও করতে পারছিল না। এমনকি ডাবটা হাতে ধরে রাখতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। এতটাই কাহিল হয়ে পড়েছে সে। তাই খানিকটা তৃষ্ণা নিবারণ হতেই বালির উপর চিত হয়ে পড়ল লোকটা। তারপর ঘণ্টা দেড়েক পরে চোখ খুলতেই দেখতে পেলো হাত-পা বেঁধে দ্বীপবাসীরা তাকে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা জানতে না পারলেও বুঝতে পেরেছে সেবা-শুশ্রূষার উদ্দেশ্যেই নিয়ে যাচ্ছে দ্বীপবাসীরা।

সেন্টিনেল দ্বীপে প্রচুর নারকেল গাছ। এখানকার ডাব-নারকেল বেশ সুস্বাদু। সাইজেও বড়সড়। দ্বীপের আশপাশে সৈকতে প্রচুর অর্ধ খাওয়া ডাব-নারকেল দেখা যায়। তার কারণ হচ্ছে, ‘কোকোনাট ক্র্যাব’ গাছে উঠে ডাব-নারকেলের বোটা কেটে নিচে ফেলে। নারকেলের কিছু অংশ ওরা খায়, বাকিগুলো জোয়ারের জলে দ্বীপের আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে অথবা দূর সাগরে ভেসে যায়। এই দ্বীপে অসংখ্য ‘কোকোনাট ক্র্যাব’ বা ‘নারকেল কাঁকড়া’ বিচরণ করে। শুধু উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপেই নয়, আন্দামান-নিকোবরের অধিকাংশ দ্বীপেই নারকেল কাঁকড়ার উপদ্রব লক্ষ্য করা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি নারকেল কাঁকড়া দেখা যায় দক্ষিণ সেন্টিনেল দ্বীপে। ওখানে প্রচুর নারকেল গাছ থাকায় কাঁকড়ার সংখ্যাও প্রচুর। রীতিমতো সেখানে গিজগিজ করে নারকেল কাঁকড়ারা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, দিনের বেলায় এদের খুব একটা দেখা যায় না, তখন পাথরের খাঁজে বা বালির গর্তে লুকিয়ে থাকে। রাতের আঁধার নেমে এলে সমস্ত দ্বীপে নারকেল কাঁকড়ারা চষে বেড়ায়। তাই এদের ভয়ে দক্ষিণ সেন্টিনেল দ্বীপে লোকজন বসবাস করে না। তাছাড়া ভারতীয় আইনে এলাকাটা সংরক্ষিত। তথাপিও দিনের বেলায় জেলেরা ওদিকে মাছ ধরতে গেলে চুপিচুপি দ্বীপে উঠে ডাব-নারকেল খেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে। আর মাঝে মধ্যে সার্ফাররা সার্ফিংয়ে এলে দ্বীপে উঠে সময় কাটায়। এছাড়া দক্ষিণ সেন্টিনেল দ্বীপে তেমন কারো যাতায়াত নেই।

আন্দামানের নারকেল কাঁকড়ারা খুব হিংস্র প্রাণী। আকৃতিতেও অনেক বড়সড়। ওজনও কম নয়, চার কেজির উপরে। নারকেল কাঁকড়াদের একেকটা পা বা দাঁড়া সাঁড়াশিসহ দৈর্ঘ্য তিন ফুট প্রায়। ভীষণ শক্তিশালী সাঁড়াশিগুলো। এতটাই ধারালো আর শক্ত মজবুত যে, নিমেষেই আস্ত একটা নারকেল চাপ দিয়ে ফাটিয়ে ফেলতে পারে। আরও বিস্ময়কর হচ্ছে, এই কাঁকড়ারা ডাব-নারকেল খাওয়ার লোভে নিজেরাই গাছে উঠে ডাব-নারকেলের বোটা কেটে দেয়। গাছের ওপর থেকে লক্ষ্য রাখে কেটে দেওয়া ডাব-নারকেলটা নিচে কতদূরে ছিটকে পড়ছে। তারপর গাছ থেকে নেমে নারকেলটা ভেঙে ভেতরের শাঁসটুকু খুটে খুটে খায়। ভয়ংকর এই হিংস্র প্রাণীরা বনের অন্যান্য প্রাণীদেরও রেহাই দেয় না। বন্যপ্রাণীরা রাতে ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে কাছে গিয়ে সাঁড়াশি দিয়ে ওদের পা কেটে দূরে টেনে নিয়ে খুটে খুটে মাংস খায়। এরকম পা হারানো অনেক বন্যপ্রাণী অসহায়ের মতো পড়ে থাকতে দেখা যায় দ্বীপের বন-জঙ্গলে। হ্যাভলক দ্বীপের জঙ্গলেও প্রচুর নারকেল কাঁকড়া দেখা যায়। এই ভংয়কর প্রাণীরা সুযোগ পেলে মানুষেরও ক্ষতি করে। দ্বীপের অধিবাসীদের রঙিন জামাকাপড় রাতে ঘরের বাইরে রাখলে টেনে নিয়ে যায় খাবার মনে করে। তারপর দূরে নিয়ে কুটিকুটি করে ফেলে রাখে। মূলত এদের উপদ্রব বেড়ে যায় রাতের অন্ধকারে। রাতের নিস্তব্ধতায় লুকিয়ে-চুকিয়ে অপারেশনে নামে। আন্দামানের অনেকেই তাই এদের ‘ডাকাত কাঁকড়া’ অথবা ‘চোর কাঁকড়া’ নামেও ডাকে। তবে যে নামেই ডাকুক না কেন, দ্বীপের আতঙ্কজনক একটা প্রাণী নারকেল কাঁকড়া; এটা সত্য। এদের বাসস্থান স্থলভূমিতে। অন্য প্রজাতির কাঁকড়াদের মতো এরা জলে বিচরণ করে না। ফাঁকা জায়গা অথবা সমুদ্র সৈকতে ঘুরে এটাসেটা খায়। এদের খাবারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডাব-নারকেল। যেটুকু খায় তারচেয়ে বেশি অনিষ্ট করে। তেমনি অনিষ্ট করে ফেলে রাখা একটা ডাব বহিরাগত লোকটা খেয়েছিল ঘণ্টাখানেক আগে। ফলে লোকটার কিছুটা তৃষ্ণা নিবারণের পাশাপাশি সামান্য দুর্বলতাও কেটেছে।

হাত-পায়ের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসতেই লোকটা কাকুতি-মিনতি করে জানালো, বাঁধটা খুলে দিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কয়েকবার বলার পরও দ্বীপবাসীদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পায়নি। তাতে লোকটার কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, দ্বীপবাসী ওর ভাষা বুঝতে পারেনি। আবার ইশারায়ও কিছু বোঝাতে পারেনি হাত-পা বেঁধে রাখায়। বড় যন্ত্রণায় পড়েছে লোকটা। তবে সে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে, মানুষগুলো কথাবার্তা না বললেও নিজেদের মধ্যে ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান করছে। তার মানে ওরা কথা বলতে জানে না। সুতরাং কথাবার্তা বলে কিছু বোঝানো যাবে না, তা সে নিশ্চিত হয়েছে। তাই ব্যথা হজম করে চুপচাপ রইল। বহিরাগত লোকটার বিশ্বাস দ্বীপবাসীরা তাকে ঝুলিয়ে নিলেও শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলবে। রোগী বহন করে নেওয়ার মতো দ্বীপে কোনো বাহন না থাকায় হয়তোবা বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটাই হয়তো দ্বীপে সেবা দেওয়ার একমাত্র বাহন। তাছাড়া কাঁধে বহন করে আনাও কম সৌজন্যতার বিষয় নয়। সমস্যা হচ্ছে কৃতজ্ঞতার ভাষাটাও বোঝাতে পারছে না দ্বীপবাসীদের।

আধ ঘণ্টার মতো হেঁটে দ্বীপবাসীরা লোকটাকে নিয়ে ওদের বাসস্থানের কাছে এলো। কাঁধ থেকে নামিয়ে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিলো। নতুন শিকার কুড়িয়ে এনেছে, মজা করে ভুরিভোজ হবে আজ। শিকার কুড়িয়ে আনার খবরটা দ্বীপে তাৎক্ষণিক চাউর হয়ে গেল। খুশির খবর শুনে যে যেখানে আছে সবাই চলে এলো শিকার দেখতে। নারী-পুরুষ সবাই সমবেত হয়ে শিকার সামনে রেখে নেচে নেচে উল্লাস করতে লাগল। বাদ যায়নি কেউ-ই, একেবারে কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরা পর্যন্ত উল্লাস করছে। দীর্ঘদিন ওরা মানুষের মাংসের স্বাদ নিতে পারেনি। বহিরাগতরা তো আসেনিই দ্বীপে, তার ওপর স্বগোত্রীয়রাও তেমন মারাত্মকভাবে আহত হয়নি। ফলে মানুষের মাংসও খাওয়া হয়নি এতদিন। মানুষের মাংস খাওয়া অনেকেই ভুলেই গেছে বলা যায়। কিশোররা তো আজ অব্দি মানুষের মাংসের স্বাদও নিতে পারেনি। দীর্ঘদিন পর একটা শিকার জুটেছে; তাই অনেক অনেক আনন্দ দ্বীপজুড়ে।

বহিরাগত লোকটাকে ঘিরে যখন উদ্দাম নৃত্য শুরু করে দিয়েছে দ্বীপবাসীরা, ঠিক তখনই ওদের আরেক দল স্বগোত্রীয় একজনকে ঝুলিয়ে নিয়ে এলো। অর্থাৎ আজ ডাবল শিকার পেয়েছে ওরা। সুনামির ঢেউয়ের তাণ্ডবে স্বগোত্রীয় লোকটা গতকাল জলে ভেসে গেলেও পুনরায় ঢেউয়ের ধাক্কায় সৈকতে আছড়ে পড়েছে। তবে লোকটা এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে, বলা যায় মৃতপ্রায়। যার ফলে ওকে স্বগোত্রীয়দের আহারে পরিণত হতে হবে আজই। এটাই দ্বীপবাসীদের রীতি। আহতদের আগে পরিত্রাণ দিতে হয়। তাছাড়া মৃতের মাংস খায় না ওরা। মৃতের শরীর বালি দিয়ে ঢেকে রাখে। ফলে বহিরাগত লোকটার আগে স্বগোত্রীয়ের প্রাণ হারাতে হবে আদিবাসীদের রীতি অনুযায়ী।

দলপতি ইশারা-ইঙ্গিতে সিদ্ধান্ত দিয়েছে আজকের প্রথম শিকার হবে স্বগোত্রীয় লোকটা। যেহেতু স্বগোত্রীয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তাই ওকে এখনই তীর ছুড়ে হত্যা করা হবে। অন্যদিকে বহিরাগত লোকটা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই সুস্থ, তাই ওকে হত্যা করা হবে আগামীকাল। অর্থাৎ পরপর দুইদিন ওদের ভুরিভোজ হবে দ্বীপে। এমন আনন্দ দ্বীপে সহসাই হয়নি। একত্রে ডাবল শিকার, বড় ধরনের আয়োজন, প্রচুর আনন্দ। দ্বীপবাসীদের আয়োজন দেখে ভয়ে লোকটার হাত-পা কাঁপছে থরথর করে। কয়েক মিনিট আগেও লোকটা বুঝতে পারেনি ওকে হত্যা করা হবে; ওর মাংস খেতেই ভোজের আয়োজন করবে দ্বীপবাসীরা। এতক্ষণ পর্যন্ত ধারণা ছিল, দ্বীপবাসীরা ওকে বয়ে এনেছে শুশ্রূষার উদ্দেশ্যে। ধারণাটা ছিল ভুল। বরং ধারণার বিপরীত ঘটতে যাচ্ছে সব। এমতাবস্থায় লোকটা কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মাথায়ও ঢুকছে না কী করলে এখান থেকে মুক্তি মিলবে। মনে মনে ভাবছে অনুনয়-বিনয় করে পার পাওয়ার চেষ্টা করবে, এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার আবেদন ওদের বোঝাতে পারছে না।

দ্বীপবাসীদের আজকের শিকার হচ্ছে উদয় ঘোষাল। বাঙালি। বয়স বড়জোর ত্রিশ। কলকাতার বাসিন্দা। গান-টান গায়। গানের গলাও বেশ ভালো। একজন উঠতি গায়ক উদয় ঘোষাল। কমবেশি পরিচিতিও আছে কলকাতাবাসীর কাছে। সুনামির দুই-তিনদিন আগে একটা গানের এলবামের শুটিংয়ে এসেছিল ওড়িশার পুরী সৈকতে। শুটিং শেষ করে পরের দিন সৈকতে দাঁড়িয়ে মনোমুগ্ধকর সূর্যোদয় উপভোগ করছিল দুই বন্ধু মিলে। সূর্যোদয় উপভোগ শেষেও অতৃপ্ত থেকে গেছে পুরীর সৈকত ভ্রমণ। তাই দুজন আরও কিছুটা সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো ওয়াটার বাইক রাইডিংয়ের মাধ্যমে। বাইক চালকের সঙ্গে দরদাম করে দু’জন লাইফ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বাইকে চড়ল। চালককে জানালো, চক্কর না দিয়ে দূর সমুদ্রে নিয়ে যেতে। চালক প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে রাজি হয়েছে টাকা-পয়সা একটু বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করতেই। সঙ্গে সঙ্গে বাইক স্টার্ট দিয়ে গভীর সমুদ্রের দিকে যাত্রা করল চালক। আনুমানিক বিশ সেকেন্ড অতিবাহিত হয়েছিল। বাইকের প্রচণ্ড গতি থাকায় সৈকত ছাড়িয়ে ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে তারা। বেশ উপভোগ করছে দু’জন। বাইক আরও সামনে অগ্রসর হচ্ছে, অমনি সবাই লক্ষ্য করল সাগরের জল কমতে শুরু করেছে। তারপর মিনিট খানেকের মাথায় জল সম্পূর্ণ শুকিয়ে এলো। বিষয়টা এতই দ্রুত ঘটেছে যে, বলা যায়, চোখের পলকেই জল গায়েব! এমতাবস্থায় সৈকত অভিমুখে বাইক ফিরিয়ে এগোনোর চেষ্টা করল চালক। কিন্তু পারেনি আর অগ্রসর হতে বাইক বালিতে কাত হয়ে পড়ায়। দুই বন্ধু বিষয়টাকে খুব উপভোগ করছিল। চালক হতভম্ব হয়ে গেল। এমন অলৌকিক ভাটার কবলে তো আগে কখনোই পড়েনি সে। সাধারণত ভাটার জল নামে ধীরে ধীরে, তাৎক্ষণিক নেমে যাওয়ার কথা নয়। তাছাড়া ভাটার জল এতদূর নেমেও যায় না। বড় ধরনের দুর্যোগের আলামত কি না তা বুঝে উঠতে পারছে না চালক। বিষয়টার হিসাব-নিকাশ মেলানোর চেষ্টা করছে চালক, অমনি দেখতে পেলো সাগরের বুক থেকে বিশাল বিশাল ঢেউ তেড়ে আসছে সৈকতের দিকে। কী করবে এমতাবস্থায় কিছুই বুঝতে পারছে না তিনজন। বাইক থেকে নেমে দৌড়ানোর চেষ্টা করল সবাই। কিন্তু প্রবল গতির ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সহজ কাজ নয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ২০-২৫ ফুট উঁচু ঢেউয়ের নিচে চাপা পড়ল তিনজন।

উদয় ঘোষাল ভেসে উঠলেও কীভাবে বাঁচলো তা ওর জানা নেই। ভাগ্যচক্রে সে বেঁচে গেছে এটাই শুধু জানে। বন্ধু আর বাইক চালকের পরিণতি সম্পর্কেও অবগত নয়। তারপর চব্বিশ ঘণ্টার মতো অতিবাহিত হলেও, মধ্যের কয়েক ঘণ্টার সাক্ষী হতে পারেনি অচেতন থাকায়। ঢেউয়ের ধাক্কায় কীভাবে আছড়ে পড়ল উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে তা-ও অজানা রয়ে গেছে উদয় ঘোষালের।

সুনামির কবলে পড়া সেই উদয় ঘোষাল আজ দ্বীপবাসীদের শিকারে পরিণত হলো। ওরা উদয়কে ডেরা-কুটিরের কাছে এনে একটা খোঁয়াড়ে আটকে রাখল। খোঁয়াড়টা বাঁশের খুঁটি দিয়ে বানানো, তেমন মজবুত নয়। এই খোঁয়াড়ে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীদের আটকে রাখে। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রাণী শিকার করতে পারলে সেটাকে খোঁয়াড়ে বন্দি করে রাখে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে শিকারে বের হতে না পারলে খোঁয়াড়ে রাখা প্রাণীদের হত্যা করে খায়। তেমনি উদ্দেশ্যেই আটকে রেখেছে উদয় ঘোষালকে। এই প্রথম কোনো সভ্য মানুষকে খোঁয়াড়টাতে আটকে রেখেছে, আগে শুধু বন্যপ্রাণীদের আটকে রেখেছিল দ্বীপবাসীরা।

উদয় ঘোষালের ভাগ্যে কী আছে তা ওর জানা নেই। তবে দ্বীপবাসীদের তোড়জোড় দেখে পরিষ্কার হয়েছে, সিরিয়ালের প্রথম ব্যক্তি ওদের স্বগোত্রীয় লোকটা। পরের সিরিয়ালে আছে উদয়। খোঁয়াড়ে আটকে রাখায় বিষয়টা বুঝতে পেরেছে সে। কিন্তু বুঝতে পারছে না সিরিয়াল আজ না কি আগামীকাল বাস্তবায়ন করবে সেই বিষয়টা। ভাবেসাবে বুঝতে পেরেছে ওকে আরও একদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে বড়জোর।

উদয় ঘোষাল মনে মনে ভাবছে যদি ওকে বেঁধে না রেখে রাতে খোঁয়াড়ে ফেলে যায়, তাহলে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে পারবে। কারণ ওদের আচরণে বুঝে ফেলেছে অনুনয়-বিনয় করে কোনো লাভ হবে না। ভেবেচিন্তে দেখল এই মুহূর্তে ওকে কৌশলী হতে হবে। হত্যাযজ্ঞ দেখে চিৎকার না করে নির্বোধ পশুদের মতো চুপচাপ থাকবে। বোঝাবে খোঁয়াড়ের খুঁটিটা সরানোর সাধ্য ওর নেই। ওরা যখন বুঝবে বন্দির অনুভূতি নেই, পালাবে না। তখন আর হাত-পা বেঁধে রাখার চেষ্টা করবে না। এখন ভালোয় ভালো আজকের সিরিয়ালে না পড়লেই হয়।

পরবর্তী আধ ঘণ্টার মধ্যেই স্বগোত্রীয় লোকটাকে লক্ষ্য করে দ্বীপবাসীরা উপুর্যপরি তীর ছুড়তে লাগল। লোকটা চুপচাপ। টু শব্দ নেই মুখে। ব্যথা পাচ্ছে, অথচ সেই অনুভূতি ওর মুখে ফুটে ওঠেনি। মনে হচ্ছে জীবন উৎসর্গ করতে পারলেই যেন সে ধন্য হয়। উদয় ঘোষাল আড়চোখে দেখল সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের প্রস্তুতি। দেখে ঠিক থাকতে পারেনি, থর থরিয়ে কাঁপতে লাগল। এরই মধ্যে বড় সাইজের একটা পাথরখণ্ড দিয়ে লোকটার মাথা থেঁতলে দিলো স্বগোত্রীয়রা। হত্যাকাণ্ড শেষ হতেই ছুরির মতো ধারালো পাথর দিয়ে লোকটাকে টুকরো টুকরো করতে লাগল দ্বীপবাসীরা।

দ্বীপবাসীদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখে উদয় ঘোষালের মাথা ঘুরতে লাগল। বমির ভাব হলেও তা ঠেকিয়ে রাখল বহু কষ্টে। বীভৎসতা সইতে না পেরে প্রায় অচেতন হয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা চেপে ধরে বসে রইল উদয় ঘোষাল।

বহিরাগত লোকটা উত্তেজিত হয়নি, হতবাকও হয়নি, তাই দ্বীপবাসীরা ধরে নিয়েছে শিকারের অনুভূতি নেই। বন্যপ্রাণীদের মতোই অসহায়। কাজেই খোঁয়াড়ে নিরাপদে ফেলে রাখা যাবে। খোঁয়াড় ভেঙে পালাতে পারবে না। পালানোর মতো সাহস, শক্তি কিছুই নেই শিকারের। ফলে ওকে আর বিরক্ত না করে স্বগোত্রীয় লোকটার মাংস খেয়েদেয়ে যে যার মতো চলে গেছে। যাওয়ার সময় ইশারায় একে অপরকে বুঝিয়ে গেছে আগামীকাল কোঁয়াড়ের বন্দিকে হত্যা করা হবে। তাই দলপতির নির্দেশে দায়িত্বশীল একজনকে বন্দির পাহারায় রেখে চলে গেল দ্বীপবাসীরা। চলবে...

মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-১
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩
এমজেএফ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।