[সম্প্রতি আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রকাশ করেছেন তার আত্মজীবনী। শিরোনাম ‘ডিসিশন পয়েন্টস’।
আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ যে আত্মজীবনী লিখেছেন তার শিরোনাম ‘ডিসিশন পয়েন্টস’ (Decision Points) না রেখে ‘দ্য ডিসাইডার ডিসাইডস’ (The Decider Decides) রাখলেই যেন ভালো হতো। এই আত্মজীবনীতে তার শাসনকালের এবং ব্যক্তিজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তের উল্লেখ রয়েছে। যেমন ধরুন, ১৯৮৬ সালে তার মদ পান ছেড়ে দেওয়া; ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ বা ২০০৮ সালে শুরু হওয়া আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকট।
বইটি আদতে বুশের কিছু ছলচাতুরি, কিছু ভুল, কিছু পারিবারিক কেচ্ছা এবং কিছুটা তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার পুনর্নির্মাণের বিব্রতকর প্রচেষ্টার সম্মিলন। তার বইটিতে রয়েছে বস্তুনিষ্ঠতা ও অনুভূতিশীলতার অভাব।
নিশ্চিতভাবে এটাকে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির সাদামাটা (ও মনগড়া) স্মৃতিকথা বলা যেতে পারে। এখানে রয়েছে কিছু নীরস তামাশা। বইটি লেখা হয়েছে ব্যবহারিক ভাষায়। তবে ভাষায় রয়েছে মাধুর্যের অভাব। অনেক কথা বলতে তিনি সঙ্কোচ করেছেন। এমন ভাব করেছেন যেন তিনি ঘটনা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না।
বইটিতে তিনি কিছু কথা বলেছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আর কিছু কথা যেন বলে ফেলেছেন অনেকটা ভুল করেই। তিনি অনেক ভুলের কথা স্বীকার করেছেন। যেমন, তার প্রশাসন থেকে হ্যারিকেন ক্যাটরিনার মতো বিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘ফেডারেল সরকারের নেতা হিসেবে আমার প্রথমেই ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা এবং দ্রুত হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল। ’
দুঃখ প্রকাশ করে ইরাক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সাদ্দামের পতনের পর যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল তখন আমাদের উচিত ছিল খুব দ্রুত এবং আক্রমণাত্মকভাবে বিষয়টিকে মোকাবিলা করার। ’ তার মতে, ‘দ্রুত সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে নেওয়াটাই ছিল যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। ’
তবে ইরাকে যে গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি সে বিষয়ে তার মনের ভিতর সবসময় একটা ‘বিরক্তিকর অনুভূতি’ কাজ করছে। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করাটা যুক্তিযুক্ত ছিল। ‘আমেরিকা এখন নিরাপদ। সাদ্দাম ছিল একজন বিপজ্জনক স্বৈরাচার, যে গণবিধ্বংসী অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল এবং মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদে মদদ জোগাচ্ছিল। ’
সমালোচকদের চোখে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ বুশ যেন সেই বিষয়গুলোকেই এড়িয়ে গেছেন তার ‘আত্মজীবনী’তে। তার শাসনকালীন সময়ে ইরাক বিষয়ে গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা এবং তথাকথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ বিষয়ে তার অসীম ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার মতো বিষয়গুলো বলা থেকে তিনি দূরে সরে থেকেছেন।
গুয়ানতানামো বে সংক্রান্ত সমস্যাগুলো তিনি যেন কৌশলেই এড়িয়ে গেছেন। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বন্দিদেরকে এক কপি করে কুরআন দেওয়া হয়েছে। ’ শুধু কি তাই? ‘গ্রন্থাগারে তাদের প্রবেশাধিকার ছিল এবং সেখানে হ্যারি পটারের আরবি অনুবাদও ছিল। ’
বুশ তার দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতার শেষের দিকে যে মুক্তবাজার নীতিমালা নিয়েছিলেন আর এর ফলে তার দেশের অর্থনীতিতে যে ধস নেমেছিল সেসব বিষয় তিনি বেমালুম চেপে গেছেন। এমনকি তার প্রশাসনে যে ন্যাক্কারজনক দলীয় প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন সে ব্যাপারেও তিনি নিশ্চুপ।
ইরাকের আবু গারাইব কারাগারে বর্বরোচিত নির্যাতনের বিষয়টিকে তিনি মনে করেন ‘অপ্রত্যাশিত’। তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ড আমাকে বলেছেন, জেলখানার বিষয়টির সত্যতা নিয়ে মিলিটারি একটি তদন্ত করছে। তবে ছবিগুলো যে এত জঘন্য হতে পারে বিষয়টি আমার জানাই ছিল না। ’ জগতের সবাই যখন বিষয়টি জানলেন তখন তিনিও তা জানতে পারেন।
বুশ তার উপদেষ্টাদের বলেছেন, গোপন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি নিয়ে হোয়াইট হাউস এবং জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের মধ্যে যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছিল সে বিষয়ে ‘তিনি এভাবে আর চোখ বন্ধ করে থাকতে চাননি। ’
তার বিশ্বাস, যে অর্থনৈতিক মন্দাভাব নিয়ে তার প্রশাসনের ঘাড়ে দোষ চাপানো হয় তা বছর দশেক আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। চাকরির সংকট আর মুদ্রাস্ফীতি বিভিন্ন বাজার-নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানেরই কা-।
এভাবে নানা অর্ধসত্য ও মনগড়া ‘সত্যে’ পরিপূর্ণ বুশের কথিত এই আত্মজীবনী। আসলে এটিকে বলা যায় আত্মজীবনীর নামে একজন বিশ্বরাজনীতিকের আত্মপ্রতারণার বয়ান।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১২৫০, নভেম্বর ১১, ২০১০