ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

লিয়েফ তলস্তয়

সন্তানের স্মৃতিতে বিখ্যাত পিতা

কাউন্ট ইলিয়া তলস্তয় | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১০
সন্তানের স্মৃতিতে বিখ্যাত পিতা

[ইন্টারনেটে মাগনা বহি  খোঁজা ও ভার্চুয়াল লাইব্রেরিতে তা যুক্ত করা অনেকের নেশা। অধমের সেই দোষ রহিয়াছে।

এইভাবেই তলস্তয়ের তৃতীয় পুত্র কাউন্ট ইলিয়া তলস্তয়ের লেখা Reminiscences of Tolstoy বহির লগে প্রথম মোলাকাত হয়। সাহিত্য হিসাবে হয়তো তেমন  কিছু না। কিন্তু একজন পুত্রের চোখে তলস্তয়ের মতন এক পিতার কী চেহারা দাঁড়ায় সেই হিসাবে বহিটির মূল্য আছে। মানুষ হিসাবে ইলিয়াও নানা গুণে গুণান্বিত। তিনি আমিরিকায় তাহার আবাস গাড়িয়াছিলেন। হলিউডি ছবিতে তিনি রাশিয়ান থিম লইয়া কায়কারবার করিতেন। এমনকি একটা ছায়াছবিতে তিনি খোদ তলস্তয়ের চরিত্রে রূপদান করিয়াছিলেন। তলস্তয়ের অন্দরের নানা অজানা কথা বেরিয়ে আসে ইলিয়ার লেখা এই স্মৃতিকথায়। তরজমা যাহারা করিয়া থাকেন তাহারা স্বীকার যাইবেন ইহাতে কতটুকু জমিন তথা স্বাধীনতা দরকার। হুবহু জিনিস খুঁজিলে হয়তো পাওয়া যাইবে না। মনে করি অনুবাদে দরকার মূল সুরটা। প্রতিটি বস্তুর নাম যেমন বাংলায় কহা যায় না, তেমনি রুশ বা ইংরাজিও রাখা যায় না। তাই মনে হয় তরজমা মিলমিশ একটা কিছুর নাম। নেহায়েত ভালো লাগা থেকে এই জিনিস পাঠকের সাথে শেয়ার করিবার মনস্থ করিলাম। ]

নিজের ছেলেমেয়েদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আমার বাবা তার বিখ্যাত খালা আলেক্সান্দ্রা আন্দ্রেয়েভনা তলস্তয়াকে একবার পত্র দিয়েছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন :

‘বড় ছেলে সের্গেই সুদর্শন, উজ্জ্বল তার চুল। তার প্রকাশভঙ্গি রোগীদের মতো দুর্বল। তবে সে খুবই ভদ্র। হাসিটাও আকর্ষণীয় কিন্তু সে যখন কাঁদে সাথে সবাইকে কাঁদায়। এমনকি আমিও কান্না ধরে রাখতে পারি না। সবাই বলে সে দেখতে আমার বড় ভাইয়ের মতো। শুনে আতংকিত হই, তাইলেই সেরেছে আর কী! সে এত ভালো! দুনিয়াদারিতে চলাচলের পক্ষে অযোগ্য। ভাইয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর মধ্যে না ছিল আত্মম্ভরিতা, না ছিল কোনও ব্যক্তিগত বাসনা। এই দুই ব্যাপারে সে এক্কেবারেই আপসহীন। অন্যের কথা ছাড়া কখনো নিজের কথা ভাবতো না। শুধু ভেবেই বসে থাকতো না। অন্যের খোঁজখবরের পাশাপাশি যতটা সম্ভব অন্যের জন্য কিছু করত, এমনকি নিজের কষ্ট হলেও। এতে সে অন্যরকম আনন্দ পেত।

তৃতীয়জন ইলিয়া। জীবনে কোনওদিন অসুস্থ হয় নাই সে। সার্থক জনম যাকে বলে। দুধে আলতা গায়ের রঙ। পড়াশোনায় যাচ্ছেতাই। সে সবসময় চিন্তা করে, কথা বলে কম। একা একাই খেলতে পছন্দ করে। প্রচন্ড বদমেজাজি আর উগ্র। তলে তলে মারামারি করার ধান্ধায় থাকে। তবে তার মনটা খুব নরম ও অনুভূতিপ্রবণ। খায় খুব আর সে কী ঘুম।

তানিয়ার (তাতায়ানা) বয়স আট বছর। সবাই বলে  সে তার মায়ের মতো। আমি খুব খুশি সে দেখতে আসলেই সোনিয়ার মতো। আহা হজরত আদম যদি মেয়ে হিসেবে তাকে পেত, তাইলে আর কোনও সন্তানের জন্ম দিত না। যদিও মেয়েটার শৈশবটা ছিল একেবারে রোগেশোকে ভরা। মজার ব্যাপার কী জানো, সে বাকি ছেলেমেয়েদের খুব যত্ন করে।

চতুর্থ লেফ। হ্যান্ডসাম, দক্ষ, জীবনীশক্তিতে ভরপুর। যে কোনও কাপড়ে রাজপুত্তুরের মতো লাগে। যে কোনও কাজে সে এত দক্ষতার পরিচয় দেয় ভাবা যায় না। যদিও সবকিছু এখনো ভালভাবে বুঝতে পারে না।

পঞ্চম হল মাশা (মেরি)। বছর দুই বয়স। মাশার জন্মের সময় সোনিয়ার অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্ট পেয়েছে। ও একটু দুর্বল, অসুস্থ থাকে বেশিরভাগ সময়। শাদা কোকড়ানো দীর্ঘ চুল, গায়ের রঙও মাসাল্লাহ দুধে আলতা যাকে বলে। চোখ দুটা অদ্ভুত নীল, অস্বাভাবিক রকমের গভীর, রীতিমতো ভীতিকর। বুদ্ধিশুদ্ধির কমতি নাই, তবে সত্যি কথা বলতে গেলে বিশ্রি সে। নিজেই নিজের কাছে ধাধা। মেয়েটা কষ্ট পাবে। বেচারি যা চায়, তা পায়ও না। সামান্য মনোযোগ আকর্ষণ করেই খুশি থাকে।

ষষ্ঠ হচ্ছে পিটার। তার কথা কী আর বলব। দৈত্য একটা। সোনিয়ার আলিঙ্গনের মধ্যেই সে জগতের সব চাইতে সুখী বাচ্চা। শারীরিক শক্তির জীবন্ত মজুদ বলা যায় তাকে। তার এই প্রাণশক্তির কী উদ্দেশ্য বুঝতে পারি না। এমনিতেই আমি দু-তিন বছরের বাচ্চাদের বুঝতে পারি না। তাই তাদের যত্নও নেওয়া হয় না।

এই পত্র লেখা হয়েছিল ১৮৭২ সালে। আমার ছয় বছর বয়স থেকে আমি বাবার এই সব চিঠিপত্র সংগ্রহ করি। সেই সময়ের কিছু স্মৃতি এখনো মনে করতে পারি।

রুশিয়ার পারিবারিক জীবন

আমার এক্কেবারে শৈশব থেকেই আমাদের পরিবার মস্কোতে ছিল। ১৮৮১ সালের কথা বলছি। একটানা আমার জীবন কাটে ইয়াসনায়া পলিয়ানায়। মা-ই ছিলেন পরিবারের হর্তাকর্তা। সবকিছু তিনিই ঠিক করতেন। বাবুর্চি নিকোলাইয়ের কাছে রান্না হয়েছে কিনা বা রাতের খাবারের খবরও তিনিই জানতেন। তিনিই আমাদের বাড়ির বাইরে বেড়াতে পাঠাতেন। জামাকাপড় তৈরি করে দিতেন আর সবসময় কোনও না কোনও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতেন। এভাবেই তাকে দেখতে আমরা অভ্যস্ত।   মোটকথা সারাদিন মা কর্মব্যস্ত। আমাদের মস্ত সংসার তার মাথায়। যদি কেউ তার সাথে দুষ্টুমি করত তো তিনি মাঝে মাঝে রেগে যেতেন, শাস্তি দিতেন। সব বিষয়ে তিনি কেন সবার চাইতে ভালো জানতেন, তা ঈশ্বরই ভালো বলতে পারবেন। তিনি জানতেন প্রত্যেকের নিয়মিত গোসল হচ্ছে কিনা, রাতের খাবারে সবাই সুপ খেয়েছে কিনা, সবাই নিয়মিত ফ্রেঞ্চ শিখছে কিনা, পড়া ছেড়ে বাচ্চারা হামাগুড়ি খেলছে কিনা, পড়ার টেবিলে বসে কেউ ঝিমুচ্ছে কিনা। আর তিনি যখন বারণ করতেন : সোনামনিরা, বাইরে যেও না, বৃষ্টি আসবে, ঈশ্বর জানেন কেন তখন সত্যি সত্যি বৃষ্টি আসত। আমরা সবাই তার কথা অরে অরে মেনে চলতাম। যেন তিনি  আমাদের সেনাশিক।

বাবা দুনিয়ার সেরা বুদ্ধিমানদের একজন। সৌরজগতের নিচে সব বিষয়ে তিনি বলতে পারতেন অনর্গল। তার ব্যক্তিত্বের ধারে তার সাথে কেউ দুষ্টুমি করারও সাহস পেতাম না। যখন তিনি তার স্টাডিতে বসে লেখালেখি করতেন, বাচ্চাদের গোলমাল করা বারণ ছিল। স্টাডিতে সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। যেন বাইবেলের আইন। এটা সবাই মেনে চলত। কারণ এ ব্যাপারে বাবা কোনও আপস করতেন না। ভেতরে তিনি ঠিক কী করতেন আমরা কেউ জানতাম না। অনেক পরে যখন আমি পড়তে শিখি, সবাইকে বলতাম, আমার বাবা একজন লেখক।

পড়তে জানার পর একদিন কয়েকটা কবিতার লাইন পড়ে খুব মজা পেয়েছিলাম। মাকে জিজ্ঞেস করি, এগুলো কে লিখেছে? তিনি বললেন এগুলো মহান পুশকিনের কবিতা। নিঃসন্দেহে তিনি মহান কবি ছিলেন। আমিও কোনও বিষয় নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতাম না। মা বলেছিল, তোমার বাবাও একজন মহান লেখক। বাস্তবিক আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।

রাতে খাবার টেবিলে বাবা মার ঠিক উল্টোদিকে বসতেন তার বিখ্যাত রুপার গোল চামচ হাতে। বুড়ি নাতালিয়া পেত্রোভনা, যিনি বিখ্যাত খালা তাতিয়ানা আলেক্সান্দাভনার সাথে নিচের ঘরে থাকতেন, নিজের জন্য গ্লাসে তরল ক্যাবেজ বানিয়ে নিতেন। ক্যাবেজের গ্লাসটা ডান হাতে নিয়ে বাবা বলতেন : ওহো আমি দুঃখিত নাতালিয়া পেত্রোভনা, আমি একটা ভুল করেছি গো।

আমরা সবাই হেসে উঠতাম। যখন নাতালিয়া পুডিংয়ের জন্য জেলি তৈরি করতেন বাবা বলতেন, পেপার বক্সের জন্য এটা আঠা হিসেবে ভালো হবে। আমরা দৌড়ে গিয়ে কাগজ নিয়ে আসতাম। বাবা বাক্স বানিয়ে দিতেন। মা রেগে যেতেন কিন্তু বাবা তাকে ভয় পেতেন না। তার সাথে কাটানো অনেক আনন্দদায়ক মুহূর্ত এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল। যে কোনও পেশাদার ঘোড়দৌড়ের চাইতেও ভালো ঘোড়া চালাতেন তিনি। তার চেয়ে শক্তিশালী মানুষ আমি কখনো দেখিনি।

তিনি কদাচিৎ আমাদের শাস্তি দিতেন। কিন্তু তিনি যখন আমাদের চোখের দিকে তাকাতেন আমাদের জারিজুরি সব ধরে ফেলতেন। তুমি বরং মাকে মিছা কথা কও গে, বাবাকে ঠকাতে যেও না। কারণ তোমার চোখের দিকে তাকালেই সব কিছু নিমেষে বুঝে ফেলবেন তিনি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল এরকম। সুতরাং কেউ সে পথ মাড়াতো না।

বাবা-মায়ের ঘরের পাশের ঘরেই থাকতেন তাতায়ানা আলেক্সান্দ্রভনা। তার ঘরে ছিল একটা রুপার পাহাড়ের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটাকে আমরা খুব ভয় পেতাম, কারণ সেটা অনেক পুরানো আর কালো।

যখন আমার বয়স ছয়, মনে পড়ে বাবা গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। তারা আলাদা একটা বাড়িতে পড়াশোনা করতো। সেখানে পরিচারক আলেক্সেই স্পানিভিচ থাকতো। মাঝে মাঝে সেই ঘরের নিচতলায় আমরাও গিয়ে থাকতাম। তারা এলেই হলঘরের উঠোন ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেটের ঘ্রাণে ভরে উঠতো। তাদের বাবা, সেরেওজা, তানিয়া ও কস্তিয়া চাচা পড়াতো। পড়ার সময়টা দারুণ প্রাণবন্ত ছিল। ছেলেমেয়েদের দঙ্গল যা খুশি তাই করে বেড়াতো। বসতো যেখানে খুশি। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা দৌড়াতো। সবাই একসাথে প্রশ্নের উত্তর দিত। একজনকে প্রশ্ন করলে অন্যজন উত্তর দিত। একজন অন্যজনকে পড়া স্মরণ করিয়ে দিত। একজন না পারলে লাফ মেরে আরেকজন তার হয়ে বলে দিত। পুরা কাসের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গল্পগুলো যেন নতুনভাবে তৈরি হতো। বাবা কখনো চাইতেন না বইয়ের ভাষার হুবহ পুনরাবৃত্তি। ‘নিজের মাথা খাটাও’ সবাইকে তিনি বলতেন।

বাবা তার শিক্ষার্থীদের যে ব্যাপারগুলো পছন্দ করতেন তা হলো তাদের শক্তিমান মানসিকতা আর অকৃত্রিম মুখের ভাষা।

[বিশেষ দ্রষ্টব্য : লেখাটি বেশ দীর্ঘ। এরকম আরও কয়েক কিস্তি চলবে। এখানে শুধু শুরুর অংশটা দেওয়া হলো। পরে বাকি অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। ]

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০২০, নভেম্বর ২৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।