মাঝরাতে বিন্ধ্যাচল পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হয় যেন কালদেব অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। পাহাড়ের ছোট ছোট গাছগুলো যেন কালদেবের মাথার জট।
মাঝরাত পার হয়ে গেছে। চারদিকে ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতার বেষ্টনী। পাহাড়ের পায়ের কাছ দিয়ে কালিগঙ্গার জল ধীরগতিতে বয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার প্রবাহ থেকে যেন সুললিত সঙ্গীতের সুর উঠে আসছে। নদীর কূলে মাঝিদের জ্বালানো চুলোর আগুন দেখা যায়। এমনই এক পরিবেশে মন্দিরের ভেতর দেবীর সামনে হাতজোড় করে বসে আছেন এক বয়স্ক নারী। পরনে সাদা কাপড়। তার মুখমণ্ডল শুকিয়ে আছে কিন্তু চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। কিছুণ পর মাথা নুইয়ে বয়স্ক নারী শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘মা! গত বিশ বছরে এমন কোনো মঙ্গলবার নেই যে দিনটিতে আমি তোমার কাছে আসিনি, তোমার চরণে মাথা রাখিনি। গত বিশ বছরে এমন একটি দিন নেই যে দিনটিতে তোমার চরণের কথা স্মরণ করিনি। তুমি বিশ্বচরাচরের মহারানী। তোমাকে এত ভক্তি করে, এত সেবা করেও আমার মনের ইচ্ছা আজও পূরণ হল না। এখন আমি তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব?
মা! আমি কত শতবার উপোস থেকে দেবতাদের উপাসনা করেছি। তীর্থে গিয়েছি। তারপরও আমার মনোবাসনা পূরণ হলো না। তাই তোমার কাছে শেষবারের মতো জানতে এলাম, এখন আমি তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব? তুমি তো সদাই ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ করো! আমি কি তোমার দরবার থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে যাব?’
এই নারীর নাম সুবামা। এমন করেই তিনি আকুতি জানাতে থাকলেন। হঠাৎ তাঁর চিন্তায় বাধা পড়ল। মনে হলো যেন তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলছেন। তাঁর চোখ এমনিতেই বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলেন, ‘সুবামা! আমি তোর প্রতি খুবই প্রসন্ন। কী চাস তুই বল!’
সুবামা যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তাঁর বুক কাঁপতে থাকল। আজ বিশ বছর পর মহারানী তাকে সাড়া দিলেন! তিনি কাঁপতে কাঁপতেই বললেন, ‘যা চাইব তুমি তাই দেবে মহারানী?’
‘হ্যাঁ, তাই পাবি!’
‘আমি বহু বড় তপস্যা করেছি। অতএব আমি খুব ওজনদার বর চাই মহারানী!’
‘তুই কি কুবেরের ধন চাস?’
‘না, মা। ’
‘ইন্দ্রের শক্তি?’
‘না। ’
‘স্বরস্বতীর বিদ্যা?’
‘না মাতা। ’
‘তাহলে তুই কী চাস?’
‘জগৎ সংসারের সবচেয়ে উত্তম পদার্থ চাই মা!’
‘সে জিনিসটা কী?’
‘এক সুযোগ্য পুত্র। ’
‘যে পুত্র বংশের নাম রাখবে? বংশকে আলোকিত করবে?’
‘না মা। ’
‘যে পুত্র মা-বাবাকে সেবা করবে?’
‘না। ’
‘যে পুত্র বিদ্বান আর বলবান হবে?’
‘না মা!’
‘তাহলে সুযোগ্য পুত্র কাকে বলে?’
সুবামা বললেন, ‘যে আপন দেশকে ভালোবাসে!’
‘ধন্য তোর চিন্তা সুবামা! যা, তোর ইচ্ছা পূরণ হবে!’
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৯১৫, ডিসেম্বর ৮, ২০১০