ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভাষা মতিনের সাথে একদিন | আদনান সৈয়দ

সাক্ষাৎকার / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৫
ভাষা মতিনের সাথে একদিন | আদনান সৈয়দ

কেউ তাঁকে ডাকে ভাষা মতিন বলে। আবার তাঁকে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনও বলা যায়।

অথবা শুধু মতিন ভাই হলেই মন্দ কী? যে নামেই ডাকি না কেন তাঁর নামটির সাথে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা যেন গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার আত্মিক যৌথতায় মিশে আছে। বায়ান্নোর সেই উত্তাল দিনে আব্দুল মতিন তখন টগবগে এক যুবক। চোখে তাঁর আগুনের গোলা। জিন্নাহ যখন ঘোষণা দিলেন পূর্ব বাংলার ভাষা হবে উর্দু, তখন এক সংগ্রামী যুবক তার বিদ্রোহী চোখ নিয়ে উত্তেজনায় ফেটে পড়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ়ভাবে বলে উঠল, ‘নো, নো, নো’। সেই যুবকটিই আব্দুল মতিন। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।

ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের সঙ্গে দেখা হবে ভাবতেই বারবার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম বায়ান্নোর উত্তাল সেই দিনগুলির বিভিন্ন ফটোগ্রাফ। ভাষা মতিন তখনও ভাষা মতিন হয়ে ওঠেন নি। ছিলেন একজন ছাত্রনেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থমথমে। একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গোটা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস। সেই দিবসকে স্বার্থক করে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সামনে সকাল ৯টা থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। এদিকে বেলা বাড়তে থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি তখন ঢাকার রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে। সকাল ১১টা। কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক সহ আরও অনেকের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হতে থাকে। আন্দোলন প্রকট হতে শুরু করে।

পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকারের কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ। ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্যে ঢাকাতে তারা সমাবেশ-মিছিল-মিটিংয়ের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। এদিকে সময় গড়িয়ে যায়। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত গোটা তিন ঘণ্টা সময় ধরে আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রতি জোর সমর্থন জানায়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে স্লোগানে তখন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর মুখরিত। ছাত্রদের একটি মিছিল পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের দিকে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল) এগিয়ে চলে। শত শত বিদ্রোহী কণ্ঠে তখন শুধু একটাই স্লোগান। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।   শুরু হয় পুলিশের সাথে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার লড়াই। পুলিশ নির্মমভাবে ছাত্র মিছিলে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত, রফিক উদ্দীন এবং আব্দুল জাব্বার নিহত হন। সালাম গুলিবিদ্ধ হন।

যাই হোক, আব্দুল মতিনের মোহাম্মদপুর বাসার কলিংবেল টিপতেই তাঁর স্ত্রী মনিকা ভাবী দরজা খুলে দিলেন। মতিন ভাই তখন সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি, লুঙ্গি পরে টেবিলের কোণার একটি চেয়ারে বসে আমাদের অপেক্ষায় আছেন। আমাদের পৌঁছাতে একটু দেরি হওয়ায় তাঁর যে কী অভিমান! কিন্তু এই সাহসী তেজী লোকটার মন যে  শিশুর মতোই নরম তা কি আর জানা ছিল! মুহূর্তের মধ্যেই তিনি আমাদের খুব আপন কেউ একজন হয়ে গেলেন।

কেমন আছেন মতিন ভাই?—প্রশ্নটা করতেই তিনি যেন অনেক কিছুই একসাথে বলতে চাইলেন। বয়স ৮৮ কিন্তু তাতে কী? চিন্তায়, মনন এবং মেধায় তিনি এখনও যেন সেই ৫২’র যুবক। বললেন চোখ নাকি সমস্যা করছে, কানেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু তাঁর উৎসাহের কোনও কমতি নেই। কথায় কথায় একটা নোটবুক এনে আমাদের সামনে হাজির করলেন। জানালেন এই নোটবুকটিতে তার ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কথা লেখা রয়েছে। এটি তিনি প্রকাশ করতে চান। আমাদের সহযোগিতা চান। আমরা আনন্দের সঙ্গেই তার নোটবুকটা পড়তে শুরু করলাম। ভাষা মতিন কথায় কথায় বললেন, ‘দেখেন, আমি খুব অরডিনারি একজন মানুষ। আমার সামান্য এই লেখাটা গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করা কি সম্ভব?’ ভাষা মতিনের মুখ থেকে এই কথা শুনে মনে হলো বিনয় একেই বলে। যেখানে সব জায়গায় ‘আমি’র সগৌরব অবস্থান সেখানে আব্দুল মতিন নিজেকে বলছেন ‘একজন সাধারণ মানুষ আমি’।

বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?—প্রশ্নটা শুনে মনে হলো তিন কপালটা একটু কুঁচকালেন। তারপর মাথা নত করে মাটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘দ্যাখেন, আজ আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এটা আমাদের জন্যে গর্বের বিষয়। আমি গর্বিত। আমরা তো আমাদের কাজ করেছি এখন বাকি কাজটা আপনাদের করতে হবে। ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু ইদানীং ভাষার যে অবস্থা হচ্ছে দেখলে খুব ভয় লাগে। ছোট ছোট শিশুরা কি সুন্দর হিন্দিতে কথা বলে অথচ বাংলা বলতে পারে না। এটা দুঃখজন। সরকারিভাবে মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। ’

আমাদের আলোচনার যোগ দেন আব্দুল মতিনের স্ত্রী গুলবদন নেসা মনিকা। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি গুলবদন নেসা মনিকা নিজেও একজন রাজনৈতিক কর্মী। বামপন্থী আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত করতে তাঁর অবদান অনেক। মনিকা ভাবী বললেন, ‘আমাদের নাতিও  ঠিকমত বাংলা বলতে পারে না। যেভাবে বাংলাদেশের শিশুরা ভারতের চ্যানেল দেখছে এবং হিন্দি ভাষা শিখছে তা সত্যি ভয়াবহ রকম বিপদ সংকেত। সরকারিভাবে এর হস্তক্ষেপ খুবই জরুরি। ’


বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পর আপনি তো রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দিলেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর ন্যাপেও যোগ দিয়েছেলেন। আপনার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলেন?’—ভাষা মতিন এবার হা করে উপরের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর দৃঢ়তার সাথেই বললেন, ‘মানুষের অধিকারের দাবি আদায়ের জন্যেই আমি রাজনীতিতে নেমেছিলাম। মানুষই সবচেয়ে বড় সত্য। আর কিছু নয়। আমি আর আমার স্ত্রী সেই সময় চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে পুরো সময় ব্যয় করেছিলাম। মওলানা ভাসানীর রাজনীতি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি সত্যিকারের একজন মানব দরদী নেতা ছিলেন। ’

মওলানা ভাসানীর সঙ্গে প্রথম দেখা কিভাবে হয়? মনে আছে?’—‘অবশ্যই। বেশ মনে পড়ে তাঁর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তেজগাঁ কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে। তিনি সম্ভবত ভারত থেকে তখন এসেছিলেন। আমরা তাকে বিমান বন্দরে আভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলাম। আমি তো তাকে দেখে রীতিমত শকড! এ কেমন ধরনের নেতা। মাথায় তালের আঁশের টুপি, পরনে লুঙ্গি আর হাতে একটা ছোট টিনের সুটকেস। আমার তখন মনে হলো এই তো সেই নেতা যাকে আমি খুঁজছি। সত্যিকারের মানুষের নেতা ছিলেন মওলনা ভাসানী। গরীবের নেতা, বন্ধু ছিলেন ভাসানী। আমার স্পষ্ট মনে আছে সাথে সাথেই সেই বিমান বন্দরেই আমি ভাসানীকে নিয়ে একটি কবিতা বানিয়ে ছিলাম। ’

কবিতাটা কি আপনার মনে আছে?’—‘হ্যাঁ, অল্প কয়েকটা লাইন এখনও মনে আছে:

যেমন আমার দেশ
তেমনি সেই দেশের নেতা
মওলানা ভাসানী।
তেমনি তাঁর সুটকেস
তেমনি তাঁর পোশাক
তেমনি তাঁর ব্যাবহার
তিনি আমাদের নেতা
মওলানা ভাসানী। ’

তাহলে মওলানা ভাসানী তো আপনাকে কবিও বানিয়ে দিল দেখছি!—হাসতে হাসতে পশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম আব্দুল মতিনের প্রতি। —‘হ্যা, তা যেমন বলেছেন(হাসতে হাসতে)। তবে আমি কবি নই। কবি হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। তবে ভাসানীকে দেখলে কবি না হয়ে উপায় কী? কি সুন্দর হাতের লেখা ছিল মওলানা ভাসানীর। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা অসাধারণ। তাঁর হাতের লেখা অনেক লিফলেট এখনও আমার কাছে আছে। ’



মতিন ভাই, আবারও ভাষা প্রসঙ্গে ফিরি। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?’—‘আমি অনেক আশাবাদী। আপনি দেখবেন একদিন এই বাংলা ভাষা গোটা মহাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ্ ভাষায় পরিণত হবে। কারণ আমাদের বাংলা ভাষা অনেক আধুনিক একটা ভাষা। অসাধারণ যুক্তাক্ষর রয়েছে ভাষাটিতে। কত সায়েন্টিফিক এই ভাষা। আপনি বলেন “দৈনন্দিন” শব্দটাকে আপনি ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন কিভাবে? আমরা আমাদের ভাষায় যে বিভিন্ন মাত্রার চিন্তা ভাবনা করতে পারি তা অন্য অনেক ভাষাতেই সম্ভব না। তবে হ্যাঁ, এই ভাষাকে বুকে ধরে রাখতে হবে। নিজেকে আগে ভালোবাসতে হবে। নিজেকে জানতে হবে। নিজেরে সংস্কৃতি আগে জানতে হবে। তবেই ভাষাকে জানা হবে। একুশে ফ্রেব্রুয়ারি আজ আমাদের এক বিশাল অর্জন। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই অর্জনকে ধরে রাখা চাই। ’

ভাষা সৈনিকের কাছ থেকে যখন আমরা বিদায় নেই, ততক্ষণে ঢাকার কালো পিচের রাস্তায় বিকেলের নরম রোদ পড়তে শুরু করেছে। মতিন ভাই আর মনিকা ভাবি দরজা পর্যন্ত এসে আমাদের বিদায় জানালেন। এই বিদায়ই যে শেষ বিদায় তা কে জানত? মতিন ভাই নেই কিন্তু তার সংগ্রামের ফসল আমরা আমাদের অস্থি মজ্জায় ধারণ করে আছি।


বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।