ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (কিস্তি ২)

ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (কিস্তি ২) অলংকরণ : ধ্রুব এষ

প্রথম কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন

বিকেলে বড়মামার সঙ্গে দুজন ভদ্রলোক এলেন। বেশ ভদ্রভাবে কথাবার্তা হলো।

মাকে বললেন মেয়েকে দেখে আসতে। অতনু একটু টয়লেটে গেল যাতে ওরা কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ফিরে এসে চেয়ারে বসামাত্র সে চমকে গেল। মেয়ের বাবার মুখের ওপর কালো ছায়া ঝুলছে। সে রুমালে চোখ চাপল। এঁরা যখন এসেছিলেন, তখনো কালো ছায়া ভদ্রলোকের মুখের ওপর ছিল না। হঠাৎ এসে গেল—অতনু মাথা নাড়ল, অস্বাভাবিক না। গাড়ি চালানোর সময়ও ড্রাইভারের হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। সে শুনল, মেয়ের বাবা বলছেন, মাস দুয়েক সময় পেলেই আমার সুবিধা হয়। ’

অতনু বলল, ‘না হবে না। আপনি যদি আমার কথা না শোনেন তাহলে আগামী এক বছরের মধ্যেও আপনার মেয়ের বিয়ে হবে না। ’
‘সে কী!’ ভদ্রলোক অবাক।
মা রেগে গেলেন, ‘কী বলছিস তুই?’
‘আমি ঠিকই বলছি। আপনি এখনই আমার সঙ্গে নার্সিংহোমে চলুন। ’
‘কী কা—!’ ভদ্রলোক বড়মামার দিকে তাকালেন, ‘আপনার ভাগ্নে কী অসুস্থ?’
‘আমি অসুস্থ নই। ’ অতনু জোর দিয়ে বলল, ‘আপনি যদি আমার কথা না শোনেন তাহলে... দাঁড়ান। আমি এখনই আসছি। ’ প্রায় ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল সে।
মেয়ের বাবার বন্ধু বললেন, ‘ছেলেটিকে নরমাল বলে মনে হচ্ছে না। ’
অতনুর মামা মিনমিন করে বললেন, ‘ও এরকম কেন বলল বুঝতে পারছি না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওর মধ্যে আমরা কখনো অ্যাবনর্মালিটি দেখতে পাইনি। ’
মেয়ের বাবা বললেন, ‘আচ্ছা আমরা উঠছি। আর কিছু নয়, ওইসব কথা শুনলে মন দুর্বল হয়ে যায়। বলল, একবছরের মধ্যে মেয়ের বিয়ে হবে না। মা-বাবা মারা গেলে তো সে রকম হওয়ার কথা। তার মানে—!’
‘ছাড়ো তো। কী পাগলের প্রলাপ, চলো!’
কিন্তু যাওয়া হলো না। পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন ডাক্তার মিত্র। অতনু তাকে ধরে নিয়ে এসে বলল, ‘ওকে একটু দেখুন তো!’
ডাক্তার মেয়ের বাবাকে বললেন, ‘দেখি হাতটা!’
‘আশ্চর্য! আমি খামোকা হাত দেখাব কেন?’ মেয়ের বাবা রেগে গেলেন।
‘প্লিজ। এই অনুরোধটুকু রাখুন। ’ অতনু হাত জোড় করল। ডাক্তার ভদ্রলোক কবজি ধরে নাড়ি দেখলেন। তারপর... ‘একটু শুয়ে পড়ুন তো। জুতো খুলতে হবে না। ’
ভদ্রলোক এবার প্রতিবাদ করলেন না। ওর ব্যাক পিঠে স্টেথো বসিয়ে পরীক্ষা করে ডাক্তার অতনুর দিকে তাকালেন, ‘ইউ আর রাইট, কিন্তু কী করে বুঝলে?
মাথা নাড়ল অতনু। খুলে কিছু বলল না।

ডাক্তার এবার বড়মামার দিকে তাকালেন, ‘ওকে এখনই নার্সিংহোমে ভর্তি করা উচিত। পালস বিট, হার্ট বিট ভালো নয়। আমি নার্সিংহোমে ফোন করে দিচ্ছি, এখনই অ্যাম্বুলেন্স এসে যাবে। ওখানে ডক্টর রহমান আছেন, ওকেও জানিয়ে দিচ্ছি।

ছয় মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেস এসে মেয়ের বাবাকে নার্সিংহোমে নিয়ে গেল। তারপর যমের সঙ্গে ডাক্তারের লড়াই চলল। ভদ্রলোক আইসিইউতে। তার সব আত্মীয়-স্বজন পৌঁছে গিয়েছেন দেখে ফিরে এলো অতনু। মা প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা কেউ ওকে দেখে বুঝতে পারিনি, তুই বুঝলি কী করে?’
‘বিশ্বাস কর, আমি কিছু জানি না। হঠাৎ মনে হলো। ’
‘তোর এই মনে হওয়ার কথা কাউকে বলার দরকার নেই। শুনলে লোকে তোকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে’—মা বললেন। পরদিন অতনুর মোবাইলে একটি মহিলার গলা ভেসে এলো, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না। কাল আপনি যে উপকার করেছেন তার জন্য আমাদের পরিবার আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। ’
‘আপনি কে বলছেন?’
‘আমি সুরমা। আমার বাবাকে আপনি জোর করে নার্সিংহোমে নিয়ে না গেলে ওকে আমরা হারাতাম। কী বলে ধন্যবাদ জানাব জানি না। ’

কথা আর না বাড়িয়ে ফোন অফ করে দিল অতনু।

ডাক্তার মিত্রের কাছে অতনু জানতে পারল ওই ভদ্রলোক জানতেনই না যে তার হৃদযন্ত্রে ইতোমধ্যে নিয়মিত রক্ত যাচ্ছিল না। অসুবিধা তেমন বোধ করেননি বলে তিনি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। আচমকা বিপদ এলে আর সামলানো যেত না। আজ সকালে অপারেশন করা হলো। এখন তিনি বিপদমুক্ত।

জ্ঞান ফিরে আসার পরই ভদ্রলোক অতনুকে দেখতে চাইলেন। মা জোর করায় নার্সিংহোমে গেল অতনু। ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে সে সেই ছায়াটাকে দেখতে পেল না। পরিষ্কার মুখ। ভদ্রলোক কৃতজ্ঞতা জানালেন।

কিন্তু খবরটা আর চাপা থাকল না। খবরের কাগজ লিখল, ‘বিস্ময়কর প্রতিভা। কেউ লিখল, বিজ্ঞানের এক ধাপ এগিয়ে। ’ কেউ লিখল, ‘অলৌকিক মানুষ। ’ পাশে অতনুর ছবি।

আর তারপরই বাড়ির সামনে প্রায় মেলা বসে গেল। যেসব অসুস্থ মানুষ হাসপাতাল অথবা নার্সিংহোমে রয়েছেন, তাদের আত্মীয়-বন্ধুরা ভিড় জমিয়েছে। তাদের আকুল আবেদন, অতকু যেন একবার রোগীকে দেখে বলেন, তার সামনে বিপদ আছে কি-না! বিপদ থাকলে তারা ডাক্তারদের ওপর চাপ দেবেন দ্রুত চিকিৎসা করার জন্য। পাড়ার ছেলেরা ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছিল। অফিসে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল অতনুর। ছেলেরা এসে জানাল, মোট সাতশ’ পেশেন্টের একটা তালিকা তৈরি হয়েছে। এরা আছেন শহরের সবক’টা হাসপাতাল আর বারোটা নার্সিংহোমে। অতনু কী করবে বুঝতে পারছিল না। এতগুলো মানুষকে দেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিকেলে টিভির খবরে জানা গেল ভারতের আশ্রমগুলোতে এই খবর আলোড়ন ফেলেছে। সেখানকার পেশেন্টরাও অতনুকে চাইছেন। অতনু এসে একবার বলুক তাদের সামনে বিপদ আছে কি-না। এই বলার জন্য যথাযথ দক্ষিণা দিতে তারা প্রস্তুত।

কিন্তু বিভিন্ন মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সতর্ক করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়ে কেউ এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। একমাত্র মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে। একটি-দুটির ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়াটা নেহাৎই কাকতালীয়। তারা অতনুর সঙ্গে কথা বলে যাচাই করতে চান।

কিন্তু এই সতর্কবাণী সাধারণ মানুষ মানতে ইচ্ছুক নয়। যেখানে কলকাতার সবচেয়ে বড় ডাক্তারকে দেখাতে হলে রোগীকে তার চেম্বারে হাজার টাকা দক্ষিণা দিতে হয়, সেখানে অতনুর পরামর্শ পেতে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা দক্ষিণার প্রস্তাব এলো। পাড়ার চারজন মাতব্বর ছেলে অতনুকে বলল, দাদাভাই, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা একটি কমিটি তৈরি করেছি। এই কমিটি সব ঝামেলা সামলে নেবে। যা দক্ষিণা পাওয়া যাবে তার সেভেন্টি পার্সেন্ট আপনার, বাকিটা কমিটি নেবে। দৈনিক পঞ্চাশটা পেশেন্ট দেখবেন। ব্যাস।

একজন চটপট হিসাব করে বলে দিল, ‘দাদাভাই পার-ডে দুলাখ পারেন। ’
আর একজন বলল, ‘এর কোনো অ্যান্ড নেই। সারাজীবন চলবে। ’
অতনু নার্ভাস হয়ে বলল, ‘যদি ভুল হয়!’
‘হতেই পারে। বড় বড় ডাক্তারের ভুল হয় না? বিখ্যাত সার্জন অপারেশন করার পর পেশেন্ট মারা যায় না। ওগুলো ফরমে লেখা থাকবে। ’
‘ফরম?’
বাঃ পেশেন্ট দেখতে যাওয়ার আগে ওদের আত্মীয়দের দিয়ে বন্ড সই করিয়ে নেব আমরা। কেউ মামলা করতে পারবে না। ’

তৃতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।