ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সেলিনা হোসেনের কালকেতু ও ফুল্লরা | ফজলুল হক সৈকত

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৬ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৫
সেলিনা হোসেনের কালকেতু ও ফুল্লরা | ফজলুল হক সৈকত

“তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ঘরের একদল লোকের জন্য সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের নাগপাশ ছিঁড়তে পারছে না। ওদের জনগণের দু’ধরনের শত্রু, ভেতরের এবং বাইরের।

এসব দেশের শাসকরা চায় গোটা জাতিকে হয় ভিক্ষুকে পরিণত করতে, নয় ক্রীতদাস বানাতে। তাহলেই ওদের সুবিধে। কিন্তু এসব শাসকরা ভুলে যায় যে, এক মাঘে শীত চায় না। ”—এভাবেই শেষ হয়েছে সেলিনা হোসেনের (জন্ম: ১৪ জুন ১৯৪৩) ২১টি পরিচ্ছেদে নির্মিত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’র (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৯২) দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। এই কথাগুলো কাহিনীর এক চরিত্র মজিদের দিনপঞ্জির অংশবিশেষ। মজিদের অনুভবের মধ্য দিয়ে প্রসারিত হয়েছে উপন্যাসটির ভেতর-ক্যানভাস।

সেলিনা হোসেন সমাজলগ্ন ও ইতিহাসনিমগ্ন কথানির্মাতা। তিনি সামাজিক বিবর্তন, মানুষের পরিবর্তন প্রভৃতিকে ইতিহাসের পাটাতনে রেখে বিবেচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। রাজনীতিকে তিনি উপন্যাসের বিষয় করেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। মানুষ যে রাজনীতির ভোক্তা এবং অসহায় শিকার, তার নিবিড় পর্যবেক্ষণ সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্যের বিশেষ প্রবণতা। আর পরিবেশনকৌশলের দিক থেকেও তাঁর সাতন্ত্র্য পাঠকের চোখে পড়ে। যা বলতে চান, তা কীভাবে প্রকাশ ও পরিবেশন করলে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে—সেই বিষয়ে তিনি সাবধানী শিল্পী। নারীর উন্নয়ন, জেন্ডার সমতা, নাগরিক অধিকার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মর্যাদা, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রভৃতি বিষয়ে সেলিনা হোসেন সরবকণ্ঠ সাহিত্যিক।

মধ্যযুগের বাস্তবধর্মী ও জীবনবাদী কবি ‘মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এইকালে জন্মগ্রহণ করিলে ঔপন্যাসিক হইতে পারিতেন’—এই কথা আধুনিক বাংলা সাহিত্য মহলে প্রচলিত আছে। সাহিত্য-সমালোচকেরা এই বিষয়ে আলোচনা করে হয়ত আনন্দ পেয়ে থাকেন। শ্রোতা হয়ত পেয়ে যান মুকুন্দের সামর্থ্যের সন্ধান। মুকুন্দরাম সমকালীন মঙ্গলকাব্যের দেবনির্ভর গতানুগতিক বিষয়বস্তুর ভেতর দিয়ে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর বাংলাদেশ ও নামগোত্রহীন সাধারণ বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের যে পরিচয় তুলে ধরেছেন, তা সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিরল। কিন্তু ওই কালে এমন কী ছিল না, যে কারণে তিনি কথানির্মাতা না হয়ে কবি হলেন? অথবা তিনি যা বলেছেন কবিতায়, তা-ই কি বলেছেন একালের ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন তাঁর কাহিনীতে? তাহলে ভিন্নতা কি কেবল পরিবেশনশৈলীতে? না-কি প্রতিবেশও প্রধান এক্ষেত্রে?—এই রকম নানান জিজ্ঞাসা সামনে রেখে আমরা কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের কালকেতু ও ফুল্লরা  উপন্যাসের পাঠ গ্রহণ করি। আর আমাদের স্মৃতিতে থাকে পনের শতকের মঙ্গলকাব্য।

কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের তিন খণ্ডের দ্বিতীয় খণ্ড হচ্ছে কালকেতু-ফুল্লরার উপাখ্যান। গুজরাটে নগর পত্তন, নানান ধর্ম ও বৃত্তির মানুষের সমাজ-বিন্যাস, নাগরিক সুখ-শান্তি, ক্ষমতা-লোভ-কপটতা—এইসব ঘিরে আবর্তিত হয়েছে কালকেতুর কাহিনী। একটি প্রশ্ন মাঝে-মধ্যে উঁকি দেয়—সেলিনা কি একালের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের, মঙ্গলকাব্য লিখেছেন? সমাজের অমঙ্গল দূর করে মঙ্গল-প্রতিষ্ঠাই কি তাঁর লক্ষ্য?

মুকুন্দরামের কালকেতু উপাখ্যানে উপন্যাসের যে সম্ভাবনা, আধুনিকতার যে আভাস—তা থেকে আমাদের উপলব্ধি এই যে, উপন্যাসের বিরাট-ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিত কালকেতু উপাখ্যানে আছে। কেবল সময়ের তাগিদ বা চাহিদার জন্য ছিল পাঠকের প্রবল প্রতীক্ষা। তাহলে সেলিনা হোসেন কি সেই সম্ভাবনা ও সত্যটিকেই প্রতিষ্ঠিত করলেন তাঁর কালকেতু ও ফুল্লরার মধ্য দিয়ে? এটিকে কি মধ্যযুগের কোনো উপাখ্যানের নবরূপ বা উপন্যাসকরণ বলা যেতে পারে? আবার এমনও তো হতে পারে, এই কালের একজন লেখক পূর্বসূরি কাহিনীকারের অভিব্যক্তির সাথে তাঁর সমাজ ও রাষ্ট্রভূমি-বিষয়ক চিন্তাকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। নির্মাণ করে তুলেছেন বহমান সমাজ-রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক চিরন্তন ধারা। সমাজে শাসকের, শাসকের সহযোগীর যে চরিত্র, তা যে সব সময় একই, কেবল ব্যক্তির হাত বদল মাত্র—এই কি কাহিনীকারের অনুভব? এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে সতর্ক পর্যবেক্ষণের পথ ধরে অগ্রসর হতে হয় কাহিনীপাঠে। একালের ঔপন্যাসিক তাঁর কালকেতু ও ফুল্লরা কাহিনীটি শুরু করেছেন এভাবে:

“কালকেতু প্রাসাদের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, সূর্য ওঠেনি। গতরাতে ঠিকমতো ঘুমুতে পারেনি। অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো কিছু একটা দেখেছিল, কিন্তু তা কী, এখন সেটা মনে করতে পারছে না। ও ভাবল, সে কারণে ঘুম ভেঙে যাওয়া উচিৎ হয়নি। কোনো কারণ ছাড়া ঘুম ভেঙে যাওয়াতে নিজের ওপর রাগ হয়। ও স্পষ্ট এবং নীতিবান লোক, কঠোর নিয়ম মেনে চলে। ... ও যাদের নিয়ে এ নগর চালায় তারা ওর কথায় ওঠে বসে, কান ধরতে বললে কান ধরে, হামাগুড়ি দিতে বললে হামাগুড়ি দেয়। কালকেতু ওদের নিয়ে যা খুশি তা করতে পারে। এ জন্য ও খুশি। ”

শাসকের অসীম ক্ষমতা, স্বেচ্ছাচারিতা, জনগণের শান্তি-প্রতিষ্ঠার চেয়ে নিজের ও আত্মীয়-পরিজনের সুখ-সমৃদ্ধির দিকে প্রবল নজর; অন্যদিকে মেরুদণ্ডহীন-ব্যক্তিত্ববর্জিত সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের জালিয়াতি-ভণ্ডামি—এইসব প্রবণতার কারণে আমাদের রাজনীতি যে বিনষ্ট হয়েছে, তার স্বরূপ ধরতে চেষ্টা করেছেন সেলিনা হোসেন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকেরা কীভাবে রাজনীতির কালো ছোবলে আক্রান্ত, তার বিবরণ পাওয়া যায় এখানে। লেখকের রাজনীতিলগ্নতা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পেতে, প্রসঙ্গত, সেলিনা হোসেনের একটি সাক্ষাৎকার থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেছিলেন:

“আমি তো মনে করি প্রত্যেক লেখকেরই রাজনৈতিক চেতনা থাকা উচিত। রাজনৈতিক ফিলোসফি বাদ দিয়ে আমি কখনো সোস্যাল কমিটমেন্টের দিকে যেতে পারব না। সেটা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, সৌখিন মজদুরি হবে। আসলে সে মজুর লোকটির হাড়-ভাঙা পরিশ্রমের উপলব্ধি হবে না। আমি রাজনীতিকে এভাবেই দেখি। কারণ রাজনীতি ছাড়া কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, রাজনীতি অথবা মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করে দেবার জন্যে যে পদ্ধতিগুলো আসে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। রাজনীতি একটি বড় ধরনের চালিকা শক্তি। এই চালিকা শক্তির বাইরে গিয়ে যদি লেখক তাঁর উপাদান খোঁজেন—আমি মনে করি না যে, সেটা শিল্পের জন্য যথেষ্ট খোঁজা হয়। তাই রাজনীতি আমার কাছে একটি প্রধান বিষয়। একটি অন্যতম বিষয় এবং যে-বিষয়টিকে আমি ক্রমাগত ভাঙতে চাই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে যে-রাজনীতি আমি দেখেছি; যে-সময় আমি দেখেছি, এখন এই ৯০ দশকে এসে সেই সময়টাকে যদি আমি হুবহু প্রতিফলিত করতে চাই তাহলে সেটা আমার সঠিক দেখা হবে না। আমার সেই রাজনীতিটাকে এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে ভিন্নভাবে আনতে হবে। ” (সেলিনা হোসেনের সাক্ষাৎকার, সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাসুদুল হক, খালেদ হোসাইন, রবীন আহসান, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ১৯৯৯

কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনীতে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র কালকেতু দেবীর আশির্বাদে তার পূর্ববর্তী শিকারী-জীবন ও সমূহ ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে কলিঙ্গ নগরের প্রশাসক হয়ে ওঠে। তবে তার দুঃখ—নিন্দুকেরা তার কাজের কোনো প্রশংসা করে না; বলে নগরের আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে। আর আরেকটি কষ্ট তার রয়েছে—সে আর তার স্ত্রী ফুল্লরা আজ অবধি সন্তানের মুখ দেখেনি। ফুল্লরা রানী হবার পর থেকে সারাক্ষণ সৌন্দর্যচর্চায় নিমগ্ন থাকে। তবে তার হাসি যেন কৃত্রিমতায় ভরা—তাতে প্রাণের কোনো সাড়া নেই। কালকেতু সাধারণ মানুষ থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছে। নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অনেক টাকা খরচ করেছে। বিদেশিদের জন্য বিলাসবহুল ‘অতিথি ভবন’ নির্মাণ করেছে। এসবের ব্যাপক প্রচারও চায় সে। কিন্তু নগরের মানুষের ঘরে খাবার নেই; যদিও ডাস্টবিনে উপচে পড়ছে খাদ্য। কালকেতু অনেকদিন বাঁচতে চায়। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সে শরীরচর্চা করে, গলফ খেলে, বুক ভরে শ্বাস নেয়। ‘ও দীর্ঘজীবী হতে চায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার ওর খুব খায়েশ। ’ কাহিনী নির্মাতা সেলিনা হোসেন সম্ভবত ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী কোনো শাসকের কথা বলছেন। আশির দশকে একজন সেনাপ্রধান প্রায় ৯ বছর অগণতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রেখেছিলেন। শেষের দিকে প্রবল প্রতিরোধের মধ্যে পড়েন সেই স্বৈরশাসক। সেলিনা হোসেন সম্ভবত ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহের ভেতর থেকে উপাদান সংগ্রহ করে এই উপন্যাসটির ক্যানভাস সাজিয়ে তুলেছেন।

স্বার্থান্ধ-চাঁদাবাজ, লুটেরা আর চাটুকার পরিবেষ্টিত কালকেতুর স্বপ্ন—“নগরীকে তিলোত্তমা নগরী করবে। আরো ফোয়ারা তৈরি হবে, উদ্যান হবে, রাজপথ আলোকিত হবে। পুষ্পময় তরুলতায় ছেয়ে যাবে রাস্তার দুপাশ। বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত হবে নগরের ভবনগুলো। ”—কিন্তু এইসবই তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ লোক-দেখানো; লেখক জানাচ্ছেন:

“এই চমৎকার নগরীর দুটো অংশ। একদিকে আছে সোডিয়াম লাইট শোভিত কার্পেটিং করা রাজপথ, প্রাসাদোপম অট্টালিকা, লেক, উদ্যান, ফোয়ারা। অন্যদিকে রয়েছে অপ্রশস্ত সড়ক, ঘিঞ্জিমারা বস্তির বিস্তার, খোলা ম্যানহোল, আবর্জনার স্তূপ, মশার কামড়, সরু গলি, আলো বাতাসহীন মানুষের বসত। ”

তিলোত্তমা নগরী ঢাকার বাস্তব ছবি আঁকতে চেষ্টা করেছেন সেলিনা হোসেন। এই নগরীর সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থান এবং অর্থনীতির পাশাপাশি শাসকের নারীপ্রীতি ও ক্ষমতাপ্রীতির কথাও প্রকাশ করতে চেয়েছেন। আমাদের দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানরা রাষ্ট্রপরিচালনাকে ‘দায়িত্ব’ না ভেবে ‘ক্ষমতা’ মনে করে যে ভুলের ভুবনে প্রবেশ করেছেন, যার দায় ও জ্বালা ভোগ করছে সাধারণ জনতা—সেই সত্যটুকু সাহিত্যের মোড়কে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। কালকেতুর নগরে বেড়ে উঠছে ভবন, ভেসে যাচ্ছে মানুষ। এখানে কেউ ভালো কিছু করার চেষ্টা করলে তাকে প্রকট যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। ধূর্ত মানুষের চোখে সে সহজেই গর্দভ হয়ে যায়! সেলিনা হোসেনের নগর-ভাবনায় জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতার ছায়া পড়ে সম্ভবত অনিবার্যভাবেই। জীবনানন্দ কতকাল আগে লিখেছিলেন ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। / যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,/ এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়/ মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। ’—জীবনানন্দের দেখা ওই আঁধার থেকে কি আমরা আজও মুক্তি পেয়েছি? মানুষের স্বপ্ন এখনো এখানে কেবলই স্বপ্ন! সাধ পূরণের সাধ্য কারো নেই—না মজিদের মতো চাকুরিজীবীর, না তারাবানুর মতো ভিক্ষুকের! রঞ্জনারাও পড়ে থাকে মানবতা ও শান্তির পথ থেকে বহু দূরে! প্রবল ‘বিশ্বাসীদের ঘাড়ের ওপর পা রেখে কালকেতুর অবাধ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিকই। চারিদিকে শুধু আর্তনাদ করে ফেরে আক্রোশ, অক্ষমতা, গ্লানি।

ক্ষমতা কেউ ছাড়তে চায় না। প্রকৃতপক্ষে, লাভ ও লোভের পথ থেকে ফেরা কঠিন ব্যাপার। ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে তারা প্রয়োজনে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে মানুষ হত্যার জন্য লেলিয়ে দেয়। অস্ত্র ঠেকিয়ে টিকিয়ে রাখতে চায় ক্ষমতা। অটুট রাখতে চায় রাজত্ব। সাধারণ মানুষের বুকের রক্তের রঙে নির্মাণ করতে চায় নগরের শোভা ও সমৃদ্ধি। কিন্তু সময়ের গতিতে বদলে যায় সবকিছু। অসীম ক্ষমতাবান কালকেতুদের দিন শেষ হয়ে আসে। তবে কালকেতুর মতো শাসকরা তা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। অবশ্য এইসব প্রবল প্রতাপশালী শাসককেও কখনো কখনো বিপন্ন হতে দেখা যায়। ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ে ক্ষমতার দণ্ড। উপন্যাসটির ১৯ পরিচ্ছেদের প্রথমাংশ থেকে খানিকটা পাঠ নিতে পারি:

“ফুল্লরাকে আলাদা করে দেয়ার পর একাই ঘুমোয় কালকেতু। গভীর রাতে দেবীকে স্বপ্ন দেখে থরথর করে কেঁপে ওঠে শরীর। ফুল্লরা বিছানায় থাকলে হয়ত ওকে জড়িয়ে ধরে ভয় কিছুটা প্রশমন করতে পারত। কিন্তু কেউ নেই। শূন্য ঘর। ও বিছানায় উঠে বসে আছে। হাত বাড়ালেই পানির গ্লাস। তবু টেনে নিয়ে খেতে পারে না। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। কালকেতু দুহাতে বুক চেপে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি করে। মুখে শব্দ নেই। ভয়, শব্দ বেরুলে পাছে কেউ যদি শুনে ফেলে! কালকেতু কাতরোক্তি করে এটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। এই নগীর মানুষ জানে কালকেতুই একক অধিপতি। তার আবার ভয় কী? কিন্তু স্বপ্নে দেবী দেখা দিলে ভয় না পেয়ে উপায় কী? বিছানা জুড়ে কালকেতু গড়াতেই থাকে। ”

অবশেষে জনতার আদালতের কাছে স্বৈরশাসক কালকেতুকে হার মানতে হয়। কাহিনী নির্মাতা দেখিয়েছেন শেষপর্যন্ত জনগণের প্রবল ঘৃণা আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শিকার হয় শাসক কালকেতু ও সুবিধাভোগী ফুল্লরা। জনতার বিচারে প্রকাশ্যে ওদের ফাঁসি কার্যকর হতে দেখা যায় কাহিনীর ক্যানভাসে। গল্পটিতে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনতার বিজয়ের কথা আছে। উন্নয়নের নামে নিজেদের পকেটভর্তি ও প্রবল প্রতারণার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের কথা আছে। গণ-জোয়ার বা গণ-আন্দোলন যে কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারে—সে রকম ইঙ্গিত রয়েছে কাহিনীটিতে। রুমানিয়ার স্বৈরশাসক জেনারেল চসেস্কুর নির্মম পতন ও জনসমক্ষে মৃত্যু কার্যকরের ইতিহাস বা উদাহরণটা সম্ভবত সেলিনার সামনে ছিল। পৃথিবীর সকল স্বৈরশাসকের নির্মম পরিণতির কথাও বোধকরি তিনি জানতেন। আর তারই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের অবসান কল্পনা করেছেন—স্বৈরশাসকের পতনের কালক্রমিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন। কল্পনা ও ইতিহাসের মিশেলে, শেষপর্যন্ত, এখানে তৈরি হয়েছে অনন্য কথামালা।

মধ্যযুগের কালকেতু থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের শাসক পর্যন্ত—অপরিসীম ব্যক্তিক ও গোষ্ঠীগত সুখ-শান্তি আর জনগণের দোয়াই দিয়ে প্রহসনের যে রাজনীতি চলমান, তার প্রতি প্রবল জনসচেতনতা সৃষ্টিকারী এই কাহিনী সমকালে এবং উত্তরকালে পাঠকের কাছে প্রেরণার বিষয় হয়ে থাকবে। কালকেতু ও ফুল্লরার রাজনীতি-বীক্ষণ সমাজ-পর্যবেক্ষণের একটি দিক। অন্য একটি দিকও আছে—সময়ের পরিক্রমায় যদি দেখা যায়, গণতন্ত্রের থলের ভেতরে স্বৈরাচারের বিড়াল লুকিয়ে আছে—অবাধে দম্ভ করে বেড়াচ্ছে, তখন নিরীহ ও সাধারণ জনগণ পরিহাসের পাত্র হয়ে ওঠে মাত্র! তখন সেলিনা হোসেনের মতো কথাসাহিত্যিকদের জীবনদর্শনও হয়ত নতুন কোনো পথের সন্ধানে উৎসাহী হয়ে ওঠে। আর এভাবেই হয়ত সময়ের গাড়িতে গড়ায় উপন্যাসে রাজনীতি কিংবা রাজনীতির উপন্যাস।



বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।