ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (কিস্তি ৩)

ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৪ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৫
সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (কিস্তি ৩) অলংকরণ : ধ্রুব এষ

দ্বিতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন

রাতে ঘুমাতে পারছিল না অতনু। কেবলই মনে হচ্ছিল একটা ভয়ঙ্কর ঝড় তার দিকে ধেয়ে আসছে।

সেই ঝড়ের মুখে পড়লে সে উড়ে যাবে? শেষরাতে সে সিদ্ধান্ত নিল কলকাতা থেকে পালাতে হবে। ওরা যদি তাকে না খুঁজে পায় তাহলে এই উত্তেজনা ক’দিনের মধ্যে মিটে যাবে। শেষ রাতটা তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করল। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ফোনে বললেন, ‘বাবা, আমি আর বাঁচতে চাই না। কিন্তু কিছুতেই মৃত্যু আসছে না। তুমি এসে আমাকে দেখে বলো, মৃত্যু এগিয়ে এসেছে কি-না। যদি জানাও খুব খুশি হব। তোমাকে আমি বিশ হাজার টাকা দক্ষিণা দেব। ’ ফোনটা সকাল থেকে বন্ধ করাই ছিল, কী কুক্ষণে যে সে খুলেছিল? মানুষ মৃত্যুর জন্য তাকে খুঁজছে।

চিঠি লিখে রাখল সে। মাকে জানিয়ে দিল সে কিছুদিনের জন্য অজ্ঞাতবাস যাবে। মা যেন কোনো চিন্তা না করে।

ভোর চারটার সময়, অন্ধকারে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো সে।

এখন পাড়া নির্ঘুম। রাস্তায় আলোগুলো হলদেটে। দু’পাশের বাড়িগুলোর দরজা-জানালা বন্ধ। খানিকটা হাঁটতেই ব্যাংকের সামনে পৌঁছে অতনু দেখতে পেল এটিএমের আলো জ্বলছে। যে লোকটার থাকার কথা তাকে ভেতরের একটা চেয়ারে বসে ঘুমাতে দেখা যাচ্ছে। অতনু ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই লোকটা তাকে ঘুম চোখে দেখল। দ্রুত মেশিনের সামনে গিয়ে কার্ড পাঞ্চ করে কুঁড়ি হাজার টাকা নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে বের করে নিল সে। তারপর আবার রাস্তায় পা রাখল।

ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রেলওয়ে স্টেশন চলে এলো অতনু। ভোরের এই সময়টায় ট্যাক্সিওয়ালা রেলস্টেশন অথবা এয়ারপোর্টের প্যাসেঞ্জার পেলে খুশি হয়। ট্যাক্সিতে বসার পর অতনু ভাবতে লাগল কোথায় যাওয়া যেতে পারে। সে ঠিক করল এই সময় কোথাকার ট্রেন পাওয়া যায় সেখানকার টিকেট কাটবে।

স্টেশনে ডিসপ্লে বোর্ডে সে দেখতে পেল সবচেয়ে আগে যে ট্রেনটা যাচ্ছে সেটা ছাড়বে ঘণ্টাখানেক পর। যাবে পুরীতে। পুরী সমুদ্রের গায়ে। সেখানে সবসময় ট্যুরিস্ট আর পুণ্যার্থীদের ভিড়। তার পরের ট্রেন যাচ্ছে রৌরকেল্লায়। পুরী না গিয়ে তার আগের স্টেশনে নেমে যাবে স্থির করল সে। টিকেট কাটতে গিয়ে সে অবাক। দ্বিতীয় বা তৃতীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণিতে কোনো জায়গা খালি নেই। আছে প্রথম শ্রেণিতে, যার টিকেটের দাম অনেক বেশি। আর চিন্তা না করে পুরীর আগের স্টেশনের টিকেট কেটে ফেলল সে। তারপর প্ল্যাটফর্মের দিকে পা বাড়াল।

তখনও ঘুম ভাঙতে শহরের দেরি, কিন্তু স্টেশনের ভেতরটা জমজমাট। এমনকি খবরের কাগজও বেরিয়ে গেছে। এক কপি খবরের কাগজ কিনে ট্রেনে চেপে বসল অতনু। প্রথম শ্রেণির কুপে বেশ আরামদায়ক। কোনো সহযাত্রী নেই। আরাম করে বসে খবরের কাগজ খুলতেই শ্বাস মুহূর্তের জন্য বন্ধ হলো যেন। সামনের পাতার নিচের দিকে তার ছবি ছাপা হয়েছে। পাশে লেখা, ‘মানুষের মৃত্যুকে আগাম দেখছে?’ তারপর বিস্তারিত বিবরণ। তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জেনে লিখে ফেলেছেন রিপোর্টার। এমনকি এই ঘোষণা চালিয়ে গেলে বছরে তার পক্ষে দশ কোটি টাকা রোজগার করাও অসম্ভব নয়। আরো বলা হয়েছে, মৃত্যু এগিয়ে এলে মানুষের শরীরে তার ইঙ্গিত তৈরি হয়। রক্তে কম্পন দৃঢ় হলে মুখের চামড়ায় তার প্রতিক্রিয়া টের পাবে। সেই প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না সাদা চোখে। কিন্তু সেই সময় যদি ইসিজি করা হয়, তাহলে হৃদযন্ত্রের পরিবর্তিত অবস্থা ধরা পড়ে। সাদা চোখে দেখতে পায় না, কোনো অস্বস্তি আগাম অনুভব করে না বলে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য যায় না। যখন অস্বস্তি শুরু হয় তখন কিছু করার সময় পাওয়া যায় না। অতনু  মানুষের মুখের চামড়ার সেই পরিবর্তন দেখতে পান, যা আজ পর্যন্ত কেউ পায়নি। ওই পরিবর্তন দেখে তিনি সতর্ক করে দিতে পারেন। এই খবর ভারত সরকারের কাছে যেমন পৌঁছেছে, স্বাস্থ্য দফতরেও কৌতূহল উদ্রেক করেছে।

খবরটা পড়ে হতভম্ব হয়ে গেল অতনু। তাহলে ব্যাপারটা এই, অন্যেরা যেটা দেখতে পায় না, সেটা সে পায়! এই সময় কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে দুজন যাত্রী কুপের দরজায় চলে এলে অতনু দ্রুত কাগজ ভাঁজ করে ফেলল। তারপর উঠে মুখ ফিরিয়ে টয়লেটে চলে এলো। তখনই খেয়াল হলো, কাগজটা ভাঁজ করার পর সিটের ওপর রেখে এসেছে। যারা এলেন তারা যদি কাগজটা খুলে দেখেন তাহলে? আর যদি তার কাগজ না দেখেন তাহলে তো এই সকালবেলায় ওঁরা কাগজ কিনে ট্রেনে চড়তে পারেন। অবশ্য সব কাগজেই তার খবরটা ছাপা নাও হতে পারে। যদি ওঁরা চিনতে পারে, তাহলে সে কী বলবে? ওরা ছাড়া ট্রেনের টিকেট চেকারও তো তাকে চিনতে পারে। টয়লেটের আয়নায় নিজের মুখ দেখল অতনু। তখনই তার মনে হলো সে তো কোনো অন্যায় করে কলকাতা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না! তার বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো তদন্ত করছে না। তাহলে সে ভয় পাচ্ছে কেন? হ্যাঁ, এটা ঠিক সে কিছুদিন অজ্ঞাতবাসে যাচ্ছে। এভাবে জানাজানি হয়ে গেলে সাংবাদিকরা তার কাছে পৌঁছে যাবে।

একটু গম্ভীর মুখে ফিরে এলো অতনু। এসে দেখল তার সহযাত্রী দুজনের একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। পুরুষটিকে ইতোমধ্যে শুইয়ে দিয়েছেন মহিলা। দুজনের বয়সের ব্যবধান রয়েছে। টিটি এসে টিকেট দেখে চলে গেলেন। ভদ্রমহিলা ইংরেজিতে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, ইনি খুব সুস্থ নন। আমরা ভেলোরে গিয়েছিলাম। কাল রাতে কলকাতায় ফিরে এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। ওকে একটু শুতে দিলে উনি আরাম পাবেন। তাই’—।

ট্রেন ছাড়ল। অতনু ইংরেজিতেই বলল, ‘কোনো অসুবিধে নেই। ওঁকে ভালোভাবে শুইয়ে দিন। আর আপনি ইচ্ছে করলে এই পাশে বসতে পারেন। অনেক জায়গা রয়েছে। ’

ভদ্রলোকের পা লম্বা করে দিয়ে শরীরের ওপর চাদর টেনে দিলেন মহিলা। তারপর অতনুর ওপাশে এসে বসলেন। এঁরা গতকাল রাত্রে কলকাতায় ফিরেছেন, এতদিন ভেলোরে থাকায় নিশ্চয়ই কলকাতার খবর রাখতে পারেননি। অসুস্থ মানুষকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অন্যদিকে মন দেওয়াও সম্ভব নয়। যখন কোনো খবরের কাগজ দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ তাকে নিয়ে যে এত কথা হচ্ছে তা এঁদের জানা নেই। একটু স্বস্তি পেল অতনু।

কিছুক্ষণ ট্রেন চলার পর চা এবং ব্রেকফাস্ট এলো। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘উনি ডিম খাবেন না। ওটা নিয়ে যান ভাই। ’ লোকটি চলে গেলে ভদ্রমহিলা এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘একটু উঠুন, ব্রেকফাস্ট সেরে নিন। ’

অতনুর মনে হলো ভদ্রমহিলা কথাগুলো বললেন ওড়িয়া ভাষায়।

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে কিছু বললেন। ভদ্রমহিলা হাসলেন, না খেলে আরও দুর্বল হয়ে পড়বেন। একটু উঠে বসুন। টোস্ট আর চা খেয়ে নিন।

মনে হলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভদ্রলোক উঠে বসলেন। তারপর ভদ্রমহিলার এগিয়ে দেওয়া প্লেট থেকে টোস্ট নিয়ে ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেয়ে নিলেন। তারপর অর্ধেক চা খেয়ে মাথা নাড়লেন, যার অর্থ আর খাবেন না।

ভদ্রমহিলা ফিরে এলে অতনু জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে ওঁর?’
‘প্রথমে কিডনিতে স্টোন ধরা পড়ে। ভুবনেশ্বরের নার্সিংহোমে অপারেশন করে স্টোন বের করা হয়। কিন্তু তাতেও উনি সুস্থ হলেন না। পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে মাঝে মাঝেই। হিমোগ্লোবিন কমে গেছে। ওঁকে নিয়ে ভেলোরে গিয়েছিলাম। ওখানে আমরা কুড়িদিন ছিলাম। আবার অপারেশন করেন ওঁরা। দেখা গেল তখনও দুটো স্টোন থেকে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যথাটা পুরোপুরি কমল না। ওঁরা ওষুধ দিয়েছেন। বলেছেন ব্যথা না কমলে দুমাস পর আবার ওঁকে নিয়ে যেতে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, উনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বলছেন, আর কখনও সুস্থ হবেন না। গতকাল থেকে বলছেন খুব বেশিদিন বাঁচবেন না। মৃত্যু কাছে এসে গেছে। ওঁর মনের জোর কমে যাওয়ায় শরীরে তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। ’ ভদ্রমহিলা খুব নিচু গলায় কথাগুলো বললেন।

অতনু ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাল। পরিষ্কার মুখে একদিনের না কামানো দাড়ি। কোনো কালো ছায়া মুখের ওপরে নেই। সে সজোরে মাথা নাড়ল, ‘অসম্ভব ওঁর মৃত্যুভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রত্যেক মানুষের একসময় মৃত্যু হবে। কিন্তু উনি কিছুতেই কাছাকাছি সময়ের মধ্যে মারা যাবেন না। আমি জোর দিয়ে একথা বলছি। ’
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে অতনুর দিকে তাকালেন, ‘আপনি জোর দিয়ে বলছেন?’
‘হ্যাঁ, বলছি। ’ মাথা নাড়ল অতনু।
‘আপনি কি ডাক্তার?’
‘না না। ’
‘তাহলে?’
অতনু জবাব দিতে পারল না। ভদ্রমহিলা একটু অপেক্ষা করার পর বললেন, ‘আপনার কথা সত্যি হলে আমরা সবাই খুব খুশি হব। ’

চতুর্থ কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।