ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (কিস্তি ৪)

ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৮ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫
সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (কিস্তি ৪) অলংকরণ : ধ্রুব এষ

তৃতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন

ট্রেন চলছিল হু হু করে। রোদ উঠছে।

যদিও রঙিন কাচের ভেতরে তার প্রতিক্রিয়া আসছে না। ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে রয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
অতনু জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি কী করেন?’
‘ভুবনেশ্বরের কলেজে পড়াতেন, অসুস্থ হওয়াতে এখন বাড়িতে থাকছেন। ওখানেই ওর পৈতৃক বাড়ি, আমারও। ’ ভদ্রমহিলা বললেন।
‘আচ্ছা। আপনি!’
‘উনি আমার দাদা। আমাদের বয়সের পার্থক্য অনেক। ’
ভদ্রমহিলা যে অবিবাহিতা তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। দাদাকে সুস্থ করতে যে চেষ্টা করছে তা প্রমাণ করছে ওঁদের সম্পর্ক খুব গভীর।
‘আপনি কী করেন জানতে পারি?’ ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।
‘আমি কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করে চাকরি করছিলাম। ’
‘করছিলাম বললেন কেন? এখন করছেন না?’
‘করছি না বলা ঠিক নয়। আপাতত করছি না। আপনি?’
‘আমি ভুবনেশ্বরের স্কুলে পড়াতাম। দাদার পাশে থাকতে—’ মাথা নাড়লেন ভদ্রমহিলা, ‘আমি প্রতিমা পাণিগ্রাহী। আপনার কাগজটা দেখতে পারি? কতদিন ওইদিকের খবর রাখি না। ’

একটু অস্বস্তি হলো। কী করে না বলবে? বাধ্য হয়ে মাথা নাড়ল অতনু। প্রতিমা কাগজটা নিয়ে প্রথম পাতার উপরের দিকে নজর রাখলেন।

‘আপনি বাংলা জানেন?
‘হ্যাঁ। পড়তে এবং বলতে কোনো অসুবিধে হয় না। ’ প্রতিমা বললেন।
অতনু অন্যদিকে তাকাল।
মিনিট দুয়েক পর প্রতিমার গলা শুনতে পেল অতনু ‘আপনি!’
‘হ্যাঁ। আমি!’ অতনু মাথা নাড়ল।
‘এটা কি সম্ভব?’
‘বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। কিন্তু পরপর কয়েকবার ঘটনাটা ঘটে গেছে। যে মানুষের মুখের ওপর আমি কালো ছায়া দেখি তার চিকিৎসা সঙ্গে সঙ্গে শুরু না হলে তাকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়। এ ব্যাপারটা প্রচারিত হয়ে যাওয়ায় আমার জীবন থেকে শান্তি চলে গেছে। একদল চাইছে আমাকে ভাঙিয়ে টাকা রোজগার করতে, হাজার হাজার লোক জানতে চাইছে তার মৃত্যু কাছাকাছি কি-না, কেউ জানতে চাইছে তাড়াতাড়ি মারা যাবে কি-না! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তার ওপর মেডিক্যাল বোর্ডগুলো গিনিপিগ বানিয়ে আমাকে নিয়ে পরীক্ষা করতে চাইছে। ভাবুন তো। আপনাকে তখন বললাম, চাকরি করছিলাম। কারণ আমি সব ছেড়ে কলকাতা থেকে এমন জায়গায় চলে যেতে চাইছি, যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই। ’

একটানা কথাগুলো বলে ঠোঁট কামড়াল অতনু। যখন শেষ করল তখন দেখল সামনের বার্থে শোয়া ভদ্রলোক চোখ খুলে এদিকে তাকালেন, তাকিয়েই চোখ বন্ধ করলেন।

প্রতিমা উঠে ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বললেন, ‘অসুবিধে হচ্ছে?’
‘ঠিক আছে। ’ গলার স্বর বেশ দুর্বল।

প্রতিমা ফিরে এসে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ তুললেন প্রতিমা, ‘যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কোথায়, মানে কোন স্টেশনে নামবেন জানতে পারি?’
‘খুরদা রোড নামক একটা স্টেশন পর্যন্ত টিটি করা আছে। ’
‘ওখানে নামবেন?’
‘দেখি। যদি তার আগে কোনো জায়গা দেখে ভালো লেগে যায়। ’
হেসে ফেললেন প্রতিমা, ‘এই মোটা রঙিন কাঁচের এপাশে বসে ওপাশের জায়গা ভালো কি মন্দ বুঝবেন কী করে? আর খুরদা হলো একটা মফস্বল শহর। যেখানে প্রচুর বাঙালি থাকে এবং এই কাগজটি পড়ে। ’
‘আমার কোনো ধারণা নেই—’
‘তার পরে পুরী। পুরীতে কিছুতেই আপনি অজ্ঞাতবাসে থাকতে পারবেন না। আপনাকে ভুবনেশ্বরে নেমে কোনো পছন্দসই জায়গায় যেতে হবে। ’
অতনু চিন্তা করল। তখনই তার চিল্কার নাম মনে পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভুবনেশ্বর থেকে চিল্কা কত দূরে?’
‘কয়েকঘণ্টা লাগবে বাসে। কিন্তু চিল্কায় ট্যুরিস্টদের ভিড় লেগে থাকে, গিয়ে দেখতে পাবেন। ’ প্রতিমা বললেন, ‘আচ্ছা এই যে আপনি অজ্ঞাতবাসে যাচ্ছেন আপনার পরিবার একথা জানেন?’
‘আমার পরিবার হলো একমাত্র মা এবং তিনি এ ঘটনা জানেন। ’

পরের স্টেশন থেকে এক ভদ্রলোক উঠলেন। এই সকাল পার হব হব সময়টাতেও তিনি স্যুট পরে উঠেছেন। হাতে একটা ল্যাপটপ ছাড়া কিছু নেই। তাকে দেখে প্রতিমা তার দাদার পায়ের কাছে গিয়ে বসলেন।

ট্রেন ছাড়তেই ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘ইজ হি সিক?’
প্রতিমা বললেন, ‘হি ওয়াজ। অপারেশনের পর দুর্বলতা যায়নি। ’
‘আইসি। ’ ভদ্রলোক অতনুর দিকে তাকালেন। চোখ ছোট হলো। কিছুক্ষণ দেখার পর বললেন, ‘আপনাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে! তাই এনি চান্স আপনাকে কোথাও দেখেছি। আর!—’ ভদ্রলোক ইংরেজিতে বিড়বিড় করলেন।
অতনুর মুখে রক্ত জমল। প্রতিমা বললেন, ‘আপনি ওর দাদাকে দেখেছেন। ’
‘দাদা?’ ভদ্রলোক মুখ ফেরালেন।
‘অবিকল একরকম দেখতে। আমরাই মাঝেমাঝে গুলিয়ে ফেলি। ’
‘হ্যাঁ মনে পড়েছে। কালই তো টিভিতে দেখাচ্ছিল। আমি অবশ্য ব্যাপারটা একদম বিশ্বাস করছি না। বিজ্ঞান যেখানে মানুষকে আউটার স্পেসে পাঠাচ্ছে, তখন কেউ মানুষের মুখ দেখে মৃত্যুর কথা বলে দিচ্ছে, তা বিশ্বাস করার কোনো যুক্তি আছে। ’ ভদ্রলোক রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে কথা বললেন।
প্রতিমা বললেন, ‘আপনি তান্ত্রিকদের কথা শোনেননি। ’
‘শুনেছি কিন্তু বিশ্বাস করি না। ’
‘বামাক্ষ্যাপা, ত্রৈলঙ্গস্বামীরা অনেক মিরাক্যাল করেছেন, বিশ্বাস করেন না?’
‘না। আমি বইতে পড়েছি। যারা লিখেছেন তারা আবেগে লিখতে পারেন। ’
‘তবু মায়ের আপনি যিশুখ্রিস্ট, বুদ্ধদেবকেও বিশ্বাস করেন না। মহাপ্রভুকেও তো চোখে দেখেননি। তাকেও না?’ প্রতিমা কেটে কেটে প্রশ্নটা করলেন।
ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর অতনুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার দাদা কি তান্ত্রিক?’
কী উত্তর দেবে অতনু। পাশ কাটাতে বলল, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। ’
‘তা ঠিক নয়। চারপাশে এত নকল তান্ত্রিক দেখা যাচ্ছে যে কাকে বিশ্বাস করব বুঝতে পারি না। ’ ভদ্রলোক হাসার চেষ্টা করল।
প্রতিমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, ওর দাদা যদি এখানে থাকতেন এবং আপনার দিকে তাকিয়ে দেখতেন মুখের ওপর কালো ছায়া পড়েছে তাহলে আপনি কী করতেন তার কথা শুনে?’
‘এ্যাঁ?’ ভদ্রলোক ভয়ানক চমকে উঠলেন, ‘না না; আমার মুখের ওপর কালো ছায়া থাকবে কেন? আমি তো বিন্দুমাত্র অসুস্থ নই!’
‘কাগজে পড়লাম যাদের মুখে ওর দাদা কালো ছায়া দেখেছেন তারা প্রত্যেকেই নিজেকে সুস্থ বলেছিলেন। তারপর!’ প্রতিমা কথা শেষ করলেন না।
‘আমি ভাবতে পারছি না। ’ রীতিমতো নার্ভাস দেখাল ওকে, ‘আমি ডাক্তারের কাছে যাব। ওঃ ভগবান, আসি, আসি!’
প্রতিমা বললেন, ‘আপনি এ রকম করছেন কেন? আপনার তো কিছুই হয়নি। তাছাড়া ওর দাদাও এখানে নেই যে আমার মুখে ছায়া দেখেছেন। একটু আগে বললেন, এসব আপনি বিশ্বাস করেন না, তাহলে কেউ কিছু না বললেও বিশ্বাস করে ফেলেছেন?’
শুনে ধাতস্থ হলেন ভদ্রলোক, হ্যাঁ, তাই তো। আসলে শুনলে এমন অসহায় লাগে। বিজ্ঞান তো এখনও সব রহস্যের সমাধান করতে পারেনি। ’
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকলেন। হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনার দাদা বোধহয় এখন অনেক টাকা উপার্জন করছেন?’
‘অনেক। আলাদা বাড়ি কিনে আমাদের ত্যাগ করে চলে গেছেন। ’ অতনু বলল।
‘এই হয়। হঠাৎ অনেক টাকা এলে মাথাই ঠিক থাকে না।   উনি নিশ্চয় গোপনে তন্ত্র  চর্চা করতেন। এখন সফল হয়েছেন। আপনাকে কিছু বলেননি?’
‘না। ’
‘এখনও টিভিতে ইন্টারভিউ দেননি। হয়তো এত টাকা চেয়েছেন যে এখানকার টিভি চ্যানেলগুলো দিতে পারছে না। কিন্তু বিবিসি বা অন্যকোনো চ্যানেল উপযুক্ত টাকা দিয়ে এক্সক্লুসিভ রাইট কিনে নেবে। ’
‘সেটাই তো স্বাভাবিক। ’
‘আপনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই?’
‘আছে। খুব কম। ’
‘যদি পুনরায়ন হয়, মানে যদি বাধ্য হই, একটা অ্যাপয়েনমেন্ট করিয়ে দেবেন? ওর যা দক্ষিণা, তাই দেব। ’
‘কার জন্যে?’
‘মানি পার্টিকুলার কারো কথা ভেবে বলছি না। ’
‘দেব। ’
‘আপনাকে কোথায় পাব?’
‘দিকশূন্যপুরে। ’
সেটা আবার কোথায়?’
‘বারুইপুরের পরে। দাদার কথা বললে দেখিয়ে দেবে যে কেউ। ’
‘থ্যাঙ্ক। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি খুদো রোডে নামব। ’
ঢোঁক গিলল অতনু, ‘আমি ভুবনেশ্বরে নামব। ’

শেষ কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।