মৃত্যু চেতনা
আমি পাঠকদের মৃত্যু সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে চাই। মৃত্যু কোনোমতেই এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়।
আমি নিশ্চিত, এ লেখাটি পড়ার পর আপনার মৃত্যুভয় কমবে, বাড়বে না। মৃত্যুকে নিয়ে সর্বাঙ্গীন ও কার্যকরী প্রস্তুতির প্রধান ও সহজতম অস্ত্রটিই হলো, ‘মৃত্যুর পর আরেকটি জীবনে বিশ্বাস করা’। আমি নিজে এটা বিশ্বাস করি।
বর্তমান ও গত শতাব্দীতে যে সব বিদগ্ধ মৃত্যুবিষয়ক গবেষক এ ব্যাপারে চমকপ্রদ আবার যৌক্তিক তথ্যাবলী দিয়েছেন, তা জানার পর অনেকেই ধর্মবিরোধী না হয়েও মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে পারেন। আনন্দ ও খুশীর সঙ্গে পরম বন্ধুর আগমনের আন্তরিকতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে এর যথাযথ আবাহনের প্রস্তুতিও নেওয়া সম্ভব।
আমি মনে করি, আমাদের দরিদ্র দেশের বিরাট সংখ্যক জনসাধারণ এখনও মারা যান বিনা চিকিৎসায় বা অচিকিৎসায়। মৃত্যুর সময় যদি আপনার জ্ঞান থাকে ও আনুষঙ্গিক শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো (মস্তিষ্ক, জিহ্বা, স্পর্শ, দৃষ্টি, শ্রবণ) সক্রিয় থাকে এবং সবচেয়ে জরুরি, মনের জোরটি, যা মরার আগে আপনাকে কিছু বলার জন্য আন্দোলিত করতে পারে, তাহলেই আপনার ‘মনের লুকানো কথাটি’ বেরিয়ে আসতে পারে। সেইসঙ্গে পাশে যদি শোনার মতো হৃদয়বান আর সহানুভুতিশীল সঙ্গী থাকে। সারা বিশ্বেই অধিকাংশ মানুষ মৃত্যুকে সবসময় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। মৃত্যুকে একটি শাস্তি ও কষ্টকর ব্যাপার মনে করা হয়। মনে মনে সবাই ভাবতে চান, সবাই মরলেও, তার মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। শিশুসুলভ বা অযৌক্তিকভাবে অনেক সময় এ চিন্তাও মনে আসে, হয়তো আমাকে মরতে হবে না।
যে ব্যক্তি সারাজীবন সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, মরণকে আমার কোনো ভয় নেই। তার যখন আসার, আসবে। এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই- কিন্ত মৃত্যু যখন আসে, চিকিৎসক বলেন, আর সময় নেই, এবার দেহত্যাগ করতে হবে। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বিশ্বাস করে না তার কথা। সর্বশক্তি দিয়ে সে মৃত্যুকে ঠেকানোর উদ্যোগ নেয়। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার ৫০ থেকে ৬০ বার হয়েছে। শরীরটি যখন ভালো ছিলো, বড় গলায় আমাকে বলেছে, ‘আপনার সব কথাই ঠিক। মৃত্যু আসুক। আমি মাথা পেতে নেবো’। কিন্তু পরদিন নাভিশ্বাস ওঠার পরেই পাগলের মতো চেঁচিয়ে বলেছে, ‘জলদি ডাক্তার ডাকুন, আমি এখনি মরতে চাই না’! এর ব্যতিক্রমও দেখেছি, সহজ-স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার। মৃত্যুর সময়, যেনো কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, সেভাবে আমার কাছে বিদায় নিয়েছে। ‘আচ্ছা আসি আবদুল্লাহ। আমাকে দেখাশোনার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ওইপারেই আবার দেখা হবে। ভালো থেকো’। তবে তাদের মতো সাহসী ব্যক্তিত্ব সর্বত্রই বিরল। মুক্তচিন্তা, সুশিক্ষা, মুক্তসমাজ, সহজ ও গোঁড়ামিহীন ধর্মচেতনা এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা- মৃত্যুকালীন স্বচ্ছচিন্তাধারার জন্য আবশ্যিকভাবে জরুরি। যদি মৃত্যুর শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত শারীরিক কারণে অসহ্য ব্যথা থাকে, চেতনা হারিয়ে যায়, তাহলে কথা বলার আর অবকাশ কোথায়? দুর্ঘটনায় যারা মারা যান, তাদেরও শেষ কথা বলার সুযোগ হয় না। ইউরোপ ও তথাকথিত উন্নত বিশ্বে জরা ও বয়সের জন্যই মৃত্যু হয় বেশি। যার দরুন রোগী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন। কথা বলায় বা বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার জন্য হজপিসকর্মী তাকে উৎসাহিত করে। আমাদের দেশে মৃত্যুর সময় পরিবারের সবাই মিলে (পাড়া-প্রতিবেশীরাও) রোগীকে ঘিরে কান্নাকাটির এমন একটা মহাদৃশ্য ঘটায় যে, মৃত্যুপথযাত্রী আসন্ন মৃত্যুকে আরও বেশি ভয় পায়। তারপর সবাই মিলে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসবের ঠেলায় বেচারির নিজের কথা বলার সুযোগটি কোথায়?
জার্মানি তথা ইউরোপে মৃত্যুপথযাত্রীর শয্যাপাশে, বিশেষ করে রাতে কেউ থাকার মতো নেই বলেই আমাদের (হজপিসকর্মী) ডাক আসে। আমি যতোগুলো মৃত্যুর সঙ্গ দিয়েছি, কদাচিৎ এক-আধজন আত্মীয় শেষ মুহূর্তে আমার সঙ্গে ছিলো। আমি লক্ষ্য করেছি, আত্মীয়স্বজন কেউ কাছে থাকলে, রোগী কথা বলতে চায় না। হজপিস ট্রেনিংয়ে আমাদের বলা হয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী সাধারণত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের (স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা-সন্তান) কাছে কনফেশান (দোষ-ত্রুটির স্বীকারোক্তি) করতে চান না। কে আর তার বৌকে মরার সময় বলবে, সে এক সময় দ্বিরাগমন করেছিলো? স্বাভাবিকভাবেই সন্তানের প্রতি করা অন্যায় বাবা-মা মৃত্যুশয্যায় তাকে সরাসরি বলতে দ্বিধাবোধ করে। এজন্যই তার অপরিচিত শেষ যাত্রার সঙ্গীকে (হজপিস-কর্মী) সে অনেক সময়ই তার ভেতরের কথাটি বলতে চায়।
আমরা অল্প কয়েক রাতেই যাত্রীর বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্ট করি। তার সঙ্গে একটা আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সব কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। ধৈর্য ও সহনশীলতা, নিরপেক্ষভাবে শোনার ক্ষমতা (কানটি সব সময় জাগ্রত রাখতে হয়), যথাসময়ে যথাযথ প্রশ্নটি করতে পারার উপরই রোগীর বিশ্বাস অর্জন করার সম্ভাবনা বেশি। আমি যে সবসময় সফল হয়েছি, তা নয়। নিয়ম হলো, কর্মী কথা বলবে কম, প্রয়োজনের বাইরে কোনো অতিরিক্ত প্রশ্ন করা নিষেধ এবং আগ্রহ নিয়ে শুনবে বেশি। রোগী যেনো তার মধ্যে একজন সহানুভূতিশীল সুহৃদকে দেখতে পায়।
আমি জার্মানিতে গত ১৯৯৭ সাল থেকে আজ অবধি শতাধিক মৃত্যুপথযাত্রীকে (প্রায় সবাই নারী) তাদের শেষ যাত্রায় সঙ্গ দেওয়ার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছি। আমার প্রথম প্রকাশিত বই ‘প্রবাসে দৈবের বশে’-তে এ সম্পর্কে তিনটি কাহিনী আছে। আরও দু’টি বইতে খণ্ড খণ্ড কাহিনি আছে। যদি আবার সুযোগ আসে, ইচ্ছে আচে সবকটিই লিখবো।
সংক্ষেপে বলা যায়, মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ কথা শোনার অবকাশ এখানে যতোটা রয়েছে, আমাদের দেশে তার এক শতাংশও নেই। মনে রাখতে হবে, ধর্মের সাধারণ নিয়মকানুন মৃত্যুর সময়ে অপরিচিতের সঙ্গ দেওয়াকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশে বা কোনো মুসলিম প্রধান দেশে কি এক নারী মৃত্যুপথযাত্রীকে কোনো পরপুরুষ তার মৃত্যুর সময়ে সঙ্গ দিতে পারে? আর এখানে নারীরা বরাবরই পুরুষ হজপিসকর্মী চান (পুরুষরা নারী)। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে।
আসলে জীবন ও মৃত্যুর সংজ্ঞা কী, এর রহস্য, কোথায় তার ব্যাখ্যা- আমরা কেউই তা সঠিক এখনও জানি না।
‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’। লালনের এই বিখ্যাত দর্শন আমাদের প্রতিনিয়তই ভাবিয়ে তোলে। তার গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছেও তিনি এ প্রশ্নই করে গেছেন আমরণ। বিশ্বকবিও বলেছেন, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়, দেখতে আমি পাই নি’। এই দেখতে না পাওয়ার ব্যর্থতা কার? আমার ভেতরের কেউ কী আমাকে প্রতিনিয়তই তাকে না দেখার জন্য বাধার সৃষ্টি করছে, নাকি তাকে দেখার জন্য, তাকে খোঁজার জন্য আমার ভেতরে যতোটুকু আকাঙ্ক্ষার শক্তি থাকার প্রয়োজন,তার অভ্যুদয়টি কখনই ঘটে না! যদি তাই হয়, তাহলে এ অপরাগতা কার? আমার ভেতরের আমার না অদৃশ্য কারও? প্রশ্নগুলো আমাকে একদিন আমার এক বন্ধু করেছিলেন। আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। কেউ কি পারবে?
এ জিজ্ঞাসাটি পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন জিজ্ঞাসা। বিবর্তনের (ধার্মিক ব্যাখ্যা উহ্য রাখুন) পর থেকেই মানুষ যেদিন থেকে ভাবতে শুরু করেছে, এই প্রশ্নটি তাকে নিরন্তর বিদ্ধ করে। কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাচ্ছি? দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক, কবি, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক সব জ্ঞানী-মহাজ্ঞানীরাই এই প্রশ্নের হাজারো উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সঠিক জবাবটি আজও মানুষের অজানা। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ পৃথিবীতে জীবিত থেকে মানুষ কখনই এর চূড়ান্ত উত্তরটি পাবে না! আবহমানকাল থেকে এবং একেবারে বিবর্তনের গোড়া থেকেই এই শাশ্বত প্রশ্ন দু’টিও জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নের দু’টি পিঠ। আসলে জিজ্ঞাসাটা একই।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, বেহেশত-দোযখ কোথায় তা বিজ্ঞানী জানে না, তবে মহাশুন্যে এর স্থান খুঁজতে তার আপত্তি নেই!
ধর্ম সম্পর্কে একটা কথা আছে, মানো তো দেবতা, না মানো তো পাথর! এই বিশ্বাসই হলো সবচেয়ে বড় কথা।
রবিঠাকুর একবার বলেছেন, ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’, আবার এও বলেছেন, ‘মরিতে চাহিনা আমি এ সুন্দর ভুবনে’! এর মধ্যে কোন কথাটি সত্য? এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে যেসব তথ্য আমার কাছে এ যাবত জমা হয়েছে, তা আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলেও শেষ করতে পারবো না।
মৃত্যুপথযাত্রায় সঙ্গ দিয়ে আমার যেসব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং বিভিন্ন ভাষায় এ সম্পর্কে নানা বইপুস্তক পড়ে, অনেক সেমিনার ও বৈঠকে অংশ নিয়ে, আমার এ বিষয়ে যে ধারণা ও বিশ্বাস জন্মেছে, যতোটা সম্ভব তা থেকে আকর্ষণীয় বিষয়গুলো এ লেখাটিতে পাঠকদের জানানোর আনন্দলাভই আমার এই লেখার মুল প্রেরণা। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়ে কথা বলতে আমার খুবই ভালো লাগে!
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৬
এসএনএস
** আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে (পর্ব-৩)
** আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে (পর্ব-২)
**আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে (পর্ব-১)
**মৃত্যু নিয়ে আবদুল্লাহ আল-হারুনের ধারাবাহিক বাংলানিউজে