মূল: অগাস্ট কুবিজেক
অনুবাদ: আদনান সৈয়দ
[লেখক অগাস্ট কুবিজেক ছিলেন কুখ্যাত নাজি বাহিনীর জনক অ্যাডলফ হিটলারের ছেলেবেলার বন্ধু। তার জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ’ থেকে জানা যায়, হিটলার তার প্রথম যৌবনে গান গাইতেন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন, ছিলেন একজন প্রেমিক ও ছবি আঁকায় তার ছিলো আজন্ম ঝোঁক।
পর্ব ১৪
ষষ্ঠ অধ্যায়
অ্যাডলফ হিটলারের স্কুল জীবন
অ্যাডলফের সঙ্গে আমার যখন প্রথম সাক্ষাৎ হয় ঠিক তখন থেকেই তার স্কুলে যাওয়ায় ছেদ পড়েছিলো। সত্যিকার অর্থে তখনও সে নামমাত্র স্টেয়ারের রিয়েলস্কুলে যেতো তবে তা শুধুই তার মায়ের দিকে তাকিয়ে। তার মা সবসময় তার পেছনে শেষ চেষ্টা দিয়ে এমনভাবে লেগে থাকতেন যেনো ছেলেটা মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।
স্কুলের রেকর্ড বই ও নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, অ্যাডলফ তার স্কুল জীবনে তেমন ভালো ফল করতে পারেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে সবসময় প্রথমসারির একজন ছাত্র ছিলো। সে যখন ছোট ছিলো তখন পড়াশুনায় মন্দ ছিলো না। অন্তত তার স্কুল জীবনের কিছু চিত্র ঘেঁটে আমি তাই আবিষ্কার করেছিলাম।
ফিচলহাম বেই লেমবাচ, বয়স ছয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুল শুরু হয় মে ০২, ১৮৯৫।
শিক্ষক কার্ল মিটেরমেয়ার পরীক্ষার খাতায় তাকে পূর্ণ নম্বর দিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে শিক্ষক মিটেরমেয়ার জীবিত ছিলেন এবং তাকে যখন অ্যাডলফ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি, তিনি তখন স্মৃতি হাতড়িয়ে অ্যাডলফের ছেলেবেলা সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছিলেন। তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, খুব হালকা-পাতলা রোগা একটা ছেলে হেফেল্ড থেকে বারো বছর বয়সী তার বোন অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে স্কুলে এসেছিলো। ছোট অ্যাডলফ তাকে শিখিয়ে দেওয়া সবরকম নির্দেশ মেনে স্কুলে তার কাজ করে যাচ্ছিলো। ১৯৩৯ সালে রিখের চান্সেলর হয়ে অ্যাডলফ হিটলার তার সেই শৈশবের স্কুল পরিদর্শন করেছিলো এবং যে টেবিলে বসে সে পড়াশুনা করতো সেই একই টেবিলে বসে সে ক্লাসে অংশ নিয়েছিলো। অ্যাডলফ সেবার স্কুলটিতে নতুন দালান-কোঠা উঠিয়ে স্কুলের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে দিয়েছিলো। একজন নারী শিক্ষক যিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মিটেরমেয়ারের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন, তিনি সেদিন অ্যাডলফ হিটলারকে তার শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
১৮৯৫ থেকে ১৮৯৬
স্কুলের নিম্ন শ্রেণির ছাত্র, হেফাল্ড
১৮৯৬ থেকে ১৯৯৮
ভোকস্কুল, লেমবাক, ২য় থেকে ৩য় শ্রেণি
লেমবাকে অ্যাডলফ সাফল্যের সঙ্গে ২য় ও ৩য় ভাগ অতিক্রম করে।
১৮৯৮ থেকে ১৯০০ সাল
ভোকস্কুল, লিয়োনডিং। ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণি।
সেই সময়ের শিক্ষক সিক্সটল ও ব্রাউনিস তাদের ছাত্র অ্যাডলফ সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে সিক্সটল তার প্রাক্তন ছাত্র অ্যাডলফ সম্পর্কে শুধু এ কথাই বললেন, ‘সে সেই সময়ে অনেক শিক্ষকের চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখতো’।
১৯০০ থেকে ১৯০১
অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান স্টেট রিয়েলস্কুল, স্টেইনগেস, লিজ।
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা থেকেই অ্যাডলফের স্কুল জীবনের শিক্ষার অবনতি ঘটতে থাকে। অ্যাডলফ তার আত্মজীবনী ‘মেইন ক্যাম্ফ’-এ বিষয়টি উল্লেখ করেছে, “স্কুলের প্রতি আমার আগ্রহ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। আমি তখন বুঝতে পারছিলাম, চারুকলার প্রতিই আমার বেশি ঝোঁক। এই বিষয়ে আমি পড়াশুনা করতে চাই। সে কারণে আমার শিক্ষা ও আগ্রহের সঙ্গে যে বিষয়গুলো বেমানান তা আমি ধীরে ধীরে বাদ দিতে শুরু করি। আমার স্কুল রিপোর্ট ‘প্রশংসামূলক’ ও ‘অসাধারণ’ জাতীয় সব শব্দ দিয়ে তৈরি হতো, তা ধীরে ধীরে নেমে ‘সন্তোষজনক’ ও ‘অসন্তোষজনক’ পর্যায়ে নেমে আসে। আমার প্রিয় বিষয় ছিলো ভুগোল ও পৃথিবীর ইতিহাস। এই বিষয়ে ক্লাসে সবসময়ই আমি ছিলাম সেরাদের তালিকায়”।
অ্যাডলফের স্কুল জীবনের এই চিত্র দেখে অনেকেই হয়তো তার স্কুল জীবন নিয়ে ভুল বার্তা পেতে পারেন। সে তার স্কুল জীবন নিয়ে হয়তো অনেক কথাই বলে থাকবে তবে এ কথা বলবো যে, এজন্য আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে কখনই কোনো ছেদ পড়েনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমার সাথে তার পরিচয় হওয়ার পনের বছর পর আত্মজীবনী লেখার আগেই অ্যাডলফের বিশেষ গুণের প্রতি আমার অনুরাগ জন্মেছিলো।
প্রথমত, এগার বছরের বালক তার পারিপার্শ্বিক সবরকম বিপরীত পরিস্থিতিকে সামলে দেওয়ার জন্যে হিমশিম খাচ্ছিলো। প্রতিদিন সে লিয়োনডিং থেকে রিয়েলস্কুলে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতো। কথাটি সে প্রায় সময়ই আমাকে বলতো। আমরা মাঝে মধ্যেই যখন লিজের মাঝামাঝি জায়গায় সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম তখন অ্যাডলফ তার সেই সময়ের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতো। এক ঘণ্টারও বেশি সময় পায়ে হেঁটে সে স্কুলে যেতো এবং দীর্ঘ পায়ে হাঁটা রাস্তায় সে স্বাধীনভাবে অনেক কিছু ভাবার খোরাক খুঁজে পেতো।
তার স্কুলের সব সহপাঠীরাই ছিলো সেই সময়ের লিজ শহরের সব বড় বড় সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আসা। স্কুলের প্রত্যেক ছাত্রই তাদের পড়াশুনার আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতো। বিষয়টি নির্ধারিত হতো প্রাথমিক পর্যায় থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত একটি ছাত্র কোন বিষয়ে বেশি ভালো ফল করছে এবং ভালো আগ্রহ রয়েছে তার উপর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হিটলার কোনোরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই ক্লাস ডিঙিয়েছিলো। মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে সে তার নিজের মত ও ভাবনাগুলোর দিকে ঝুঁকে পরতে শুরু করে। এটা এ কারণেই হয়েছিলো যে, সে কখনও তার শিক্ষকের আরোপিত বিষয়গুলোর পড়াশুনা করতে আগ্রহবোধ করতো না। কিন্তু বিষয়টি তার জন্য এতো সহজও ছিলো না। সে কারণেই শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও সে তার নিজের ভাবনার জগৎকে আঁকড়ে ধরে থাকলো।
ক্লাসে সে কারও সঙ্গেই তেমন কথা বলতো না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় ধীরে ধীরে তার বন্ধুর সংখ্যা কমতে থাকে। ক্লাসে মাঝে মধ্যেই তাকে নিয়ে অন্য ছাত্ররা বিদ্রুপ করতো। ‘শহুরে ছেলো’ যে কিনা রিয়েলস্কুলে কারও সঙ্গে মিশতে জানে না, এই নিয়ে তাকে অনেক কথা শুনতে হতো। এসব কারণে অ্যাডলফ নিজেকে আরও বেশি তার সহপাঠীদের কাছ থেকে গুটিয়ে রাখতো। এটা সত্য যে, তার সেই সময়ের কোনো সহপাঠী সে কারণে অ্যাডলফের সঙ্গে তাদের আন্তরিক সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব হয়েছে এমনটা কেউ দাবি করতে পারতো না।
প্রধান শিক্ষক হেনস কমেনডা যিনি স্কুলে গণিত পড়াতেন, তিনি অ্যাডলফের পরীক্ষার খাতায় ‘অসন্তোষজনক’ মন্তব্য করে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করলেন। প্রাকৃতিক ইতিহাসের শিক্ষক মেক্স এংস্টলারও একইরকম মন্তব্য করে তার স্কুলের রিপোর্ট তৈরি করলেন। হিটলার তার মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষ দু’টো ‘অসন্তোষজনক’ খেতাব নিয়ে পড়াশুনা শেষ করলো। এর ফল যা হওয়ার তাই হলো। তাকে আবার সেবছর নতুন করে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্যে নোটিশ দেওয়া হলো। অ্যাডলফ এই বিষয়টি আমাকে কখনও বলেনি। তবে তার এ ধরনের পরীক্ষার ফলের কারণে তার বাবা কী রকম আচরণ করেছিলেন তা সত্যি অনুমেয়।
১৯০১ থেকে ১৯০২।
রিয়েলস্কুল, লিজ, পুনরায় ক্লাস, ১ম বছর
অতএব হিটলারকে আবার নতুন করে ক্লাসে অংশ নিতে হলো। এবার অ্যাডলফ হিটলারের নিবিড় পরিচর্যায় শিক্ষক নিয়োজিত হলেন অধ্যাপক এডওয়ার্ড হুইমার। তিনি জার্মান ও ফ্রান্স ভাষার অধ্যাপক ছিলেন। অনেকটা জোর করে হিটলারের মনের বিরুদ্ধে জার্মান এবং ফ্রান্স ভাষা ও সাহিত্য তার বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হলো। কিন্তু এবার আর যাইহোক সে পরীক্ষায় কৃতকার্য হলো।
১৯০২ থেকে ১৯০৩
রিয়েলস্কুল, লিজ, ২য় বছর
গোটা সময়টাই ছিলো অ্যাডলফের জন্য কঠিন এক বছর। এবারও সে গণিত পরীক্ষায় খুব খারাপ ফল করলো। তার বাবা মানসিক দুঃখ নিয়ে সেই ‘অসন্তোষজনক’ রিপোর্টে সই করলেন। হিটলার গণিতকে ঘৃণা করতো। তার ধারণা, বিষয়টি খুব রসকষহীন। হিটলার বুঝতে পেরেছিলো, স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশুনা করতে হলে তাকে গণিত শিখতেই হবে। তবে গণিতের প্রতি তার এই ঘৃণা সে মনের ভেতর সবসময়ই পোষণ করে রেখেছিলো।
১৯০৩ থেকে ১৯০৪
রিয়েলস্কুল, লিজ, ৩য় বছর
৩য় বছরে অ্যাডলফ হিটলার গণিত এবং জার্মান ভাষায় আবারও খারাপ ফল করে এবং সে বছরই তার বাবা মারা যান। অধ্যাপক হুয়েমার চিঠিতে তার মাকে জানিয়ে দিলেন যে, রিয়েলস্কুলের জন্য তার পুত্র মোটেও উপযুক্ত নয়। এবং তাকে যদি আরও পড়াশুনা করানোর ইচ্ছা থাকে তবে অ্যাডলফকে যেনো রিয়েলস্কুল থেকে বদলি করিয়ে অন্য একটি সাধারণ স্কুলে পাঠানো হয়। অতএব এ কথা সত্যি নয় যে, অ্যাডলফকে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করেছিলো। বরং বলা যায়, তার মেধা যেহেতু স্কুলটির পর্যায়ে ছিলো না, সে কারণে তাকে অন্য স্কুলে বদলি করা হয়েছিলো।
১৯০৪ থেকে ১৯০৫
রিয়েলস্কুল, স্টের, ক্লাস ফোর, ১৯০৫। স্কুলে পুনরায় ভর্তী
স্কুল কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সিদ্ধান্তে হিটলার মোটেও সুখী ছিলো না। সে সিদ্ধান্ত নিলো যে, এবারও যদি এমন খারাপ ফল করে তাহলে তার এমন পড়াশুনার আর প্রয়োজন নেই। যেহেতু স্কুল তাকে তার মতো করে বড় হতে সাহায্য করছে না অতএব এমন স্কুলে না থাকাই ভালো। সে নিজেই নিজেকে শিক্ষিত করার কাজে নেমে গেলো। চিত্রকলায় সে নিজেকে ডুবে দিলো। ছবি আঁকায় তার দক্ষতা দেখে সে নিজেই ভাবতে শুরু করলো যে, সে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ভালো কোনো আঁকিয়ে হয়ে উঠবে। চিত্রকলার সঙ্গে স্কুলের বিষয়ভিত্তিক পড়াশুনার তুলনা করলে তা কতোই না ধূসর আর যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়! অ্যাডলফ সব কিছু থেকে বাধামুক্ত হয়ে নিজের মতো করে মানুষ হওয়ার চেষ্টায় নেমে গেলো। সে তার সমসাময়িক সহপাঠীদের ঘৃণা করতে শুরু করলো এবং নিজের মতো করে নতুনভাবে মানুষ হওয়ার চেষ্টায় নিজেকে যুক্ত রাখলো।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৬ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৬
এসএনএস
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-২)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৩)
**দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৪)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৫)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৬)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৭)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৮)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৯)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১০)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১১)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১২)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১৩)