সত্তরের দশকের কবিদের কণ্ঠে যখন পুরনো দিনের প্রেমের কাতরানি অথবা ব্যর্থ বিপ্লবের নস্টালজিয়া- তখন একই দশকের কবি হয়েও সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল লিখে চলেছেন পৃথিবীর অগ্রযাত্রার কথা, নতুন প্রযুক্তির কথা। তিনি পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করছেন তরুণতম কবির চোখ দিয়ে।
তিনি যখন বলেন, ‘পাখিরা ভুলে যাচ্ছে উড়ালের বানান ও ভাষা, কলাকৌশল/ প্রজন্মপাখি প্রজাতি এখন উটপাখি/ প্রকৃত আর প্লাস্টিক কখনই এক নয়; আমি তোমাকে চিনি না কেনো?/ নৃতত্ত্বের আয়নায় খুঁজে পাই না নিজেকে। আমি সংখ্যালঘু, আমি কাঁদি; আমরা না। / ঘুড়িরা ফিরে আসে না। তবু লাটাই সুঁতায় লেগে থাকে মমতা মাখানো নাড়ির টান,/ ঘুড়ির শিরা-প্রতিশিরা-উপশিরায় প্রতিমহূর্তে প্রবাহিত আমার সত্ত্বা-অস্তিত্ব। /আমি তো ভুলিনি রোদে দগ্ধ পিঠে শুকিয়ে যাওয়া ঘামের লবণাক্ত নদীর নাম/ তুমি ভুলে গেলে, আউশ-আমন-বোরো ভাতের ঘ্রাণস্মৃতিনেশা!’ (প্লাস্টিক সার্জারি)
তখন আমরা দেখি অন্য এক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালকে, তিনি এক লাফে উঠে আসেন সতীর্থদের ভিড় থেকে অনেকটা পথ সামনে, সদ্য লিখতে বসা একদল তরতাজা কবিসারির অগ্রভাগে। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল কেন সত্তরের কবি হয়েও সরে এসেছেন তার সমকালীন কাব্যধারা থেকে? কারণ, তিনি হতাশ, কবিতায় নতুন তরঙ্গ তোলার অদম্য এক ঘোরে তিনি আচ্ছন্ন।
তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ক্লাশের চেয়ার-টেবিল-ব্ল্যাকবোর্ড-ডাস্টার সবই/ খই ফোটার আনন্দে এক সাথে ফোয়ারা ছড়িয়ে হেসে উঠলো,/কিন্তু এক সাথে তুমুল বৃষ্টির ভাষায় কাঁদে না। / এক সাথে না কাঁদলে কী ভাবে কবিতা হবে?/ ক্রন্দনহীন, পুষ্টিহীন আধুনিক কবিতা এখন প্রায়মৃত ব্রহ্মপুত্র’। (পুষ্টিহীন কবিতা)।
আমরা তার কবিতায় প্রচুর শব্দ ও উৎপ্রেক্ষা পাই যা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আবিষ্কারকে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি খুব সচেতনভাবেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কবিতার পরিভাষা করে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। কারণ, তিনি জানেন প্রযুক্তি আজ আর দূরের ভবিষ্যত নয়, আমাদের প্রতিদিনের জীবন যাপনেরই অংশ। তার কবিতায় প্রেম আছে কিন্তু উপস্থাপন কৌশল ভিন্ন।
‘বিছানায় স্বর্ণলতার মতো দু’টি সাপ জড়িয়ে দড়ি হয়ে আছে। / সিথানে-পৈথানে স্খলিত ক’টি নারীচুল রাজসাক্ষী মুনকির-নকিরের মতো। / সোফায় এলোমেলো প্যান্ট-শার্ট, অগোছালো শাড়ি-ছায়া নাকি থ্রিপিস মনে নেই!/ বিড়াল সাপের খেলা দেখে খুব ক্ষুধার্তবোধ করলো। / সোফার হাতলে ব্রা’কে মৃত ইঁদুর ভেবে তা নিয়ে দ্রুত দৌঁড়ে পালিয়ে গেলো। ’ (মৃত ইদুর)।
আজ সত্তরের এই মেধাবী কবির জন্মদিনে, আমার অগ্রজ ও প্রিয় এই কবিকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে তারই কবিতার উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। আমি বিশ্বাস করি, একজন কবিকে উল্লেখ করতে গেলে, শুভেচ্ছা বা ভালোবাসা প্রকাশ করতে গেলে তার কবিতা দিয়েই তা করা উচিত। শুভ জন্মদিন দুলাল ভাই। আপনি ক্রমাগত লিখে যান। আপনার হাতে বাংলা কবিতা ক্রমাগত নতুন নতুন ঢেউ তুলুক, আমরা সেই ঢেউয়ের দুলুনি উপভোগ করতে চাই।
শেষ করার আগে আর একটি কথা বলতে চাই, কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এখন পরবাসী, দেশ থেকে বহু দূরে কানাডায় তার পরবাস জীবন। এই জীবনে আনন্দ নেই আছে স্বস্তি, আর উত্তর প্রজন্মের সমৃদ্ধির স্বপ্ন, যা বহু কষ্টে কেনা। আমি নিজেও দীর্ঘদিন পরবাসী। কবি, আপনার কবিতা ধার করেই আজ আমিও আমার প্রবাস যাপনের কষ্টের কথা বলি, ‘আমার একটি নিজস্ব নদী ছিলো। পাশে ছোট্ট গ্রাম। ছিলো ব্যক্তিগত সন্ধ্যা’। এই দূর পরবাসে আমাদের সেই ব্যক্তিগত সন্ধ্যাগুলো অন্য কারও হয়ে গেছে।
আপনাকে আবারও জন্মদিনের শুভেচ্ছা। অনেক অনেক শুভকামনা।
বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৬
এসএনএস