সানাউল হক খান: একজন স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পী
কাজী জহিরুল ইসলাম
ছন্দ-মাত্রায় শব্দকে বেঁধে ধ্বনি-তরঙ্গের মুগ্ধ আবেশে পাঠককে বিমোহিত করার ক্ষমতা কবি সানাউল হক খানের রয়েছে। কেউ কেউ তার মুকুটে ছড়াকারের একটি বাড়তি পালক বসিয়ে দিয়েছেন বৈকি।
পাহাড়িয়া নদী ওরে বাঙালিয়া নদী
চেনাজলে জোয়ার-ভাটা, চেনা ক্ষয়ক্ষতি
কাদানীল নদী ওরে লালকাদা নদী
পলিমাটিহীন তোর কতো দুর্গতি
নীড়হারা পাখি দ্যাখে পাখি হারা নীড়
শকাব্দ-শকুনিরা করে আছে ভিড়
মনের অরণ্য খোঁজে অরণ্যমন
মন ছেড়ে উধাও সব সাধনভজন
বারুদিয়া নগরে কি নগরবারুদ
মানবিক বিধান ভুলে হয়ে গেছি ভূত
পাহাড়িয়া মেঘ ওরে মেঘের পাহাড়
কতো আর সইবে ওরা বারুদের ভার
লালে লাল খালবিল নদী-নালা লাল
মাত্রা-গোনা মৃত্যু ঠোকে কাহারবা তাল।
(মৃত্যুকাহারবা)
এই কবিতা পড়তে পড়তে ছেলেবেলার বিতর্ক প্রতিযোগিতার কথা মনে পড়ে যায়, ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ?’ যেনো সেই প্রশ্নটিই তিনি বাংলা কবিতার পাঠককে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন এই বলে, ‘চেনাজলে জোয়ার-ভাটা, চেনা ক্ষয়ক্ষতি’। জল আমাদের ভাসিয়ে নেয় জেনেও আমরা জল ভালোবাসি। চেনা মানুষ দুঃখ দেয় জেনেও আমরা চেনা মানুষই খুঁজি। নদী ভাঙা নারী জানে জল কতো ভয়ঙ্কর। অথচ মাত্র এক ঘড়া জলের জন্য এক কালো নারী পাড়ি দেয় প্রত্যুষের অন্ধকারে কয়েক মাইল মরুপথ। কবিতাটি কেবল প্রতি এবং বৈপরীত্যেই শেষ হয়ে যায়নি, পাঠককে নিয়ে যায় আরও দূরে, আরও গভীরে, যখন তিনি বলেন, ‘মানবিক বিধান ভুলে হয়ে গেছি ভূত/ পাহাড়িয়া মেঘ ওরে মেঘের পাহাড়/ কতো আর সইবে ওরা বারুদের ভার’। এখানে এসে আমরা পেয়ে যাই এক মানবিক কবিকে, যার বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টের বারুদ বিস্ফোরিত হয়ে মন ও মনন‘লালে লাল খাল বিল নদী-নালা লাল’ হয়ে যায়। যখন তিনি বলেন, ‘মনের অরণ্য খোঁজে অরণ্যমন/ মন ছেড়ে উধাও সব সাধনভজন’ তখন আমরা কবির তির্যক দৃষ্টির খোঁজটিও পেয়ে যাই। সাধন-ভজন যখন মন ছেড়ে উধাও হয়ে যায়, তখন এ সাধনে আর প্রেম থাকে না, থাকে কেবল লোভের গনগনে আগুন।
শেষতক আমারই দেহান্তরী দেহ
লড়াইয়ের মঞ্চ বানাল দুই প্রাণী:
মানুষ আর জিন
পরী এলো না খেলা দেখতে
এলো পাখি তার পাখা দুটো উপহার দিতে
এলো হরিণ তার মাথার শিং উপহার দিতে
এমনকি পোষা বিড়ালটি
তুলতুলে পা ক'টি উপহার দিতে
লড়াই তবু থামে না
শরীর বড্ড খারাপ জিনিস
সবাই এখানে আড্ডা দিতে আসে
পাড়ের মাটি চিবিয়ে খেতে খেতে
নদীও কেমন খলবলিয়ে হাসে...
দুই
প্রমাণ দিতে দিতে জাহান্নামের সব আগুনই
শেষ হয়ে যাবে : আমি একটু খাঁটি কি-না
এত দিন তবে কী কথা হলো, কী তবে খোঁজাখুঁজি
নাকি কথার আভরণে কেবলই ঘৃণা আর ঘৃণা
প্রকৃতই আমি খাঁটি কি না।
(দু’টুকরো)
এই কবিতার ইমেজটিকে প্রথমত আমরা একটি পারিবারিক কলহের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করতে পারি। ‘পরী এলো না’ মানে লোকটির স্ত্রী আসেনি, ‘এলো পাখি তার পাখা দুটো উপহার দিতে’ খুব সঙ্গত কারণেই এটি তার কন্যা, ‘এলো হরিণ তার মাথার শিং উপহার দিতে’ নিঃসন্দেহে এটি তার পুত্র, ‘এমন কি পোষা বিড়ালটিও/ তুলতুলে পা ক’টি উপহার দিতে’ বাড়ির কাজের লোক অথবা আশ্রিত কোন দূরাত্মীয়। নারীটি, মানে ভদ্রলোকের অর্ধাঙ্গিনী, না আসাতে সভাটি হয়ে ওঠে অর্থহীন আর তাই এই খেদোক্তি, ‘সবাই এখানে আড্ডা দিতে আসে/ পাড়ের মাটি চিবিয়ে খেতে খেতে/ নদীও কেমন খলবলিয়ে হাসে। ’ কবিতাটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে এসেই তিনি খোলাসা করেন স্ত্রীর সঙ্গে পুরুষটির টানাপড়েনের কথা। ‘কথার আভরণে কেবলই ঘৃণা আর ঘৃণা’ শব্দগুচ্ছের মধ্য দিয়েই তিনি আমাদের সামনে পারস্পরিক অবিশ্বাসের এক জটিল চিত্র তুলে ধরেন। এবং এখানে এসেই পারিবারিক চিত্রটি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের চিত্র। এটিই এই কবিতার সার্থকতা। খুব ব্যক্তিগত অনুভূতি দিয়ে শুরু হয়ে একটি কবিতা যখন রাষ্ট্রের অবকাঠামোতেও প্রযোজ্য হয় তখনই এটি আর একার না থেকে হয়ে ওঠে সকলের কবিতা। সানাউল হক খানের কবিতায় বাড়তি পাওনা হিসেবে যেটি পাওয়া যায় তা হলোছন্দের দ্যোতনা এবং সুখপাঠ্য অন্তমিল। এই কবিতাতেও পাঠক এই উপরি থেকে বঞ্চিত হননি।
ইতিহাস আমাদের রক্তে-ঘামে গড়ে নিতে চায়
আমরা ইতিহাস ভেঙে করি খান খান
নদী আমাদের হাতে তুলে দ্যায় কাদামাটির গহনা
আমরা ফিরিয়ে দিই নদীর আবেগ, স্রোতোমন্ত্রদান
আকাশ আমাদের থালা ভরে দ্যায় মিছরিদানায়
থালা উজাড় করে আমরা হয়ে যাই দীনভিখারি
ভূগোল আমাদের বারবার বলে ভাঙনের কথা
আমরা তাকে দায়বদ্ধ রাখি শান্তির শিকারি
চেতনা আমাদের উজ্জীবিত করে বারবার
আমরা নিষ্ক্রিয় তবু, ভেসে থাকি নিথর জলে
শিখছি শুধুই দায়সারা কত ভালোবাসা
কীভাবে করব দাবি—আমরা মনুষ্যত্বের দলে
(ইতিহাস)
কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতা কতোখানি? আদৌ আছে কি? কবিতায় উপদেশ দেওয়া কতখানি সঙ্গত? এমন বিতর্ক অন্তহীন। সর্বকালের অন্যতম একজন সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ‘ইমাজিনেশন ইজ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান নলেজ’। আর সাহিত্যে ইমাজিনেশনের অর্থাৎ কল্পনার চারণভূমি হচ্ছে কবিতা। সেই কল্পনা যদি হয় অর্থহীন ক্ষতি নেই। আজকাল প্রায়শই শোনা যায়, ‘কোনো কিছু না বুঝেই যা ভালো লাগে তা-ই কবিতা’। আর যদি বুঝে ভালো লাগে? আমি বলি, সেটা ভালো কবিতা। ‘ইতিহাস’ কবিতায় কল্পনা আছে এবং সেই সঙ্গে আছে মানুষের দায়িত্বহীনতা এবং অকৃতজ্ঞতাবোধের প্রতি ইঙ্গিত যা পৃথিবীকে ক্রমশই বাস-অযোগ্য করে তুলছে। ‘আকাশ আমাদের থালা ভরে দ্যায় মিছরিদানায়’ আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন কল্পনা মনে হতে পারে কিন্তু এ চিত্রকল্পটি প্রকৃতপক্ষে কল্যাণের বারিবর্ষণের কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যা আমাদের ফসলের মাঠকে করে ফলবতী, আমাদের থালা ভরে ওঠে মিছরিদানায়, খাদ্যকণায়। আর এই নতুন মিলেনিয়ামে আকাশতো আরও কতোভাবেই আমাদের সমৃদ্ধ করছে, আমরা আজকাল জ্ঞানভাণ্ডারকে ঝুলিয়ে রাখি আকাশেরই তাকে, সার্চ ইঞ্জিনে খোঁচা দিয়ে নামিয়ে আনি প্রয়োজন মতো। ‘নদী আমাদের হাতে তুলে দেয় কাদামাটির গহনা’ পঙক্তিটিতে আমরা শুনতে পাই সাতশো নদীর কলধ্বনি। যে দেশের বুকে সাতশো নদী সারাক্ষণ খলবল করে কথা বলে সেই দেশের এক কবির কলমে নদীর স্রোতধারা খুবই সঙ্গত। কিন্তু প্রতিনিয়ত অকৃতজ্ঞের মতো ‘আমরা ফিরিয়ে দিই নদীর আবেগ, স্রোতোমন্ত্রদান। ’ বারবার প্রমাণ করেছি, ‘আমরা ইতিহাস ভেঙে করি খান খান। ’ ‘ভূগোল আমাদের বারবার বলে ভাঙনের কথা/ আমরা তাকে দায়বদ্ধ রাখি শান্তির শিকারি। ’ আমরা ‘শিখছি শুধুই দায়সারা কত ভালোবাসা/ কীভাবে করব দাবি—আমরা মনুষ্যত্বের দলে?’ মানুষের বিবেক জেগে উঠুক, ‘চেতনা...উজ্জীবিত করে বারবার। ’ কবি এই প্রত্যাশাই শেষ পর্যন্ত ব্যক্ত করেছেন।
‘পিছুডাক’ কবিতায় খানিকটা কবিসুলভ অভিমান প্রতিফলিত হয়েছে। কোন বন্ধুর মৃত্যুতে অভিমানী কবি বলছেন, আমারওতো কাজ শেষ, আমিও যাই, আমরা সবাই যাই। প্রকৃতির জবাবটিও তৈরি, ‘একসাথে চ’লে যাওয়ার কোনো বিধান নেই’। কোনো মানুষ যখন আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয় তখন তার মনের মধ্যে যে দ্বিধার পেন্ডুলাম দুলতে থাকে সেই সংশয়টি এই কবিতায় বেজে উঠেছে।
অনেকের মুখেই শুনেছি এবং শুনছি:
কত কিছুই তো হলো, কত সীমানাই তো ভাঙলে
পাঠশালা, বিদ্যাপীঠ, সম্মানের সীমানা
প্রেমের সীমা-পরিসীমা ভেঙে, ভালোবাসার ওলটপালট শব্দ
ঠিকঠাক সাজিয়েগুছিয়ে, যৌনতার বিপদসীমা-উপচানো শব্দ
সঠিক শরীরের কাছে সোপর্দ করে বললাম:
আমাদের কাজ শেষ হয়েছে, আমরা এবার চললাম
হঠাৎ কে পিছু ডাকে আমাদের:
একসাথে চ’লে যাওয়ার কোনো বিধান নেই এ জগতে
তুমি থাকো, ও থাকুক, তাকেও রাখো...
নদীর পেখম-তোলা নৃত্য আছে
বাতাসের ফিসফিস মন্ত্র আছে
রৌদ্র তোমাদের হলুদ পরাতে বৃষ্টিকে থামিয়ে রাখে
তোমরা জানো কি?
মনঘড়ি দেহঘড়ির আড়ালে খিলখিলে হাসিগুলো কুড়িয়ে নিতে
তোমরা তো ভুল করে পাত্রটাই আনোনি...
(পিছুডাক)
আগেই বলেছি অন্তমিলহীন গদ্যকবিতায়ও কবি সানাউল হক খান সমান পারদর্শী। সেইরকম একটি কবিতা ‘আমার ছুটির দিনের শব্দগুলো’ পাঠকদের জন্য নিচে উপস্থাপন করা হলো। আমি একসময় পশ্চিমআফ্রিকার একটি দেশ আইভরিকোস্টে কাজ করতাম। দেশটিতে ছিলাম সাড়ে পাঁচ বছর। এই দীর্ঘসময়ে ওখানকার আচার-সংস্কৃতির অনেকখানি গভীরে প্রবেশের সুযোগ ঘটেছে। আইভরি কোস্টের ছেলে-মেয়েরা নাচে খুব পারদর্শী। এই নাচ ওদেরকে কোনো ইনস্টিটিউটে গিয়ে শিখতে হয় না। ওদের রক্তে নাচ, ধমনীতে নাচ, মস্তিস্কের কোষে কোষে নাচ। নাচের জন্য, এমনকি, মিউজিকেরও প্রয়োজন হয় না। প্রত্যন্তগ্রামে–গঞ্জে ঘুরে ঘুরে দেখেছি শিশু-কিশোরেরা হাঁটতে হাঁটতে ‘ফিঙ দিয়া দেই তিনদোল’এর মতো চারকদম হেঁটেই পঞ্চমকদমে গিয়ে তিড়িং করে একটা নাচের মুদ্রা তুলে ফেলে। এবং এই মুদ্রা অত্যন্ত আকর্ষণীয়, ব্যাকরণসমৃদ্ধ। কবি সানাউল হক খানেরও রক্তে-মজ্জায় ছন্দ। তিনি গদ্য কবিতা লিখতে শুরু করলেও কোথাও না কোথাও গিয়ে কয়েকলাইন সমিল পদ্য লিখে ফেলেন। ‘আমার ছুটির দিনের শব্দগুলো’ কবিতার শেষের দিকে গিয়েও তিনি ১২টি পঙক্তি সমিল পদ্যে সাজিয়ে ফেলেছেন। আমি তার এই দক্ষতাটির প্রশংসা করি। এই বৈচিত্র্য পাঠককে আনন্দ দেয়।
একটি আধুনিক কবিতার সকল বৈশিষ্ট্যিই বিদ্যমান এই কবিতাটিতে। যখন তিনি বলেন, ‘আমার ছুটির দিনের একটি শব্দ/ কোথাও যোগ দিয়েছে একটু বেশি বেতনে’ অথবা ‘একটি শব্দ জাতীয় যাত্রা দলে ঢুকেছে/ গেরস্থ-বাপকে ‘ত্যাজ্যপিতা’ বলে/ সমাজের কানে-কানে ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে’ তখন আমরা একজন পরিপূর্ণ আধুনিক কবির অবয়বই অবলোকন করি। কবিতায় পারদর্শিতার স্থান হয়তো রয়েছে কিন্তু মূলত এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত শিল্প। সানাউল হক খানের হাতে শব্দেরা স্বতঃস্ফূর্ত।
আমার ছুটির দিনের শব্দগুলো
সেই-যে ছুটিতে গ্যালো
আর ফিরলো না
ওরা আমার অনুভূতি নিয়ে লুকোচুরি খেলছে
তামাশা করছে, কী মজাই-না করছে
ওরা চাল-ডাল, লবন-মশলা ছিটিয়ে গান ধরেছে:
তবু খুশি থাকো...
তোমার দুঃখ সহজ ক’রে খুশি থাকো
শহরের পাশেই আমার গ্রাম, গ্রাম তো নয়
বলা যায় শহরতলি
ইটভাটার ধোঁয়া বলছে, খুব তো দুঃখ-দুঃখ লেখো
তাই না? দুঃখের বারো আনাই লুকিয়ে রেখেছি
নিজের দুঃখের কতোটাই-বা জানো
দুঃখনিয়ে তোমাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি নিতে হবে
আরেক জন্মে
আমার ছুটির দিনের একটি শব্দ
কোথাও যোগ দিয়েছে একটু বেশি বেতনে
তার আশা করে লাভ নেই
বরং একটি বিকল্প শব্দ খুঁজি:
যে নিজেই হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে
ঠিক তাকে
চোখের ভেতর উঁকি দিচ্ছে চোখ
তার রেটিনার মধ্যে আরেকটি চোখ
কালো ডিম জুড়ে আরেকটি চোখ
বেদনার্ত কর্ণিয়ার ভেতর আরেকটি চোখ:
আমার জন্যে কারোরই অশ্রু নেই
ওরা কাঁদবে কোন্ দুঃখে
কী-এমন দায়ভার ওদের
আমার ধলেশ্বরীর একটি শাখা মধুমতি
একটি শাখা ইছামতি
একটি শাখা কালিগঙ্গা...
আমার ছুটির দিনের একটি শব্দ
সেখানে সাঁতার কাটছে পোনা মাছের সঙ্গী হয়ে
সে ভুলে গ্যাছে ফিরে আসবার দিনক্ষণ
না-কি চাকরি-বাকরি বাদ দিয়ে খুঁজছে
পাল-তোলা নাও
একটি শব্দ বিক্রমপুরের পশ্চিম-প্রান্ত থেকে
প্রান্তহীন পথ রেখা হয়ে কারও পথ আগলে
দাঁড়িয়ে বলছে: আর এগোবে না, খবদ্দার
যাও, আপিসে ফিরে যাও, তোমার শহরে...
আর হাঁ, আমার পাওনাগুলো বুঝিয়ে দিয়ো
মিটিয়ে দিয়ে গানে-গানে সব বন্ধন ঘুঁচিয়ে
একটি শব্দ জাতীয় যাত্রাদলে ঢুকেছে
গেরস্থ-বাপকে ‘ত্যাজ্য পিতা’বলে
সমাজের কানে-কানে ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে
সেও নাকি শহরে ফিরতে নারাজ
দিন-তারিখহীন একটি পদত্যাগপত্র হাতে নিয়ে
মুখস্থ-মুখের মানুষ খুঁজছে
তার কোনো পাওনা-প্রাপ্তির আব্দার নেই
ঝড়ে উড়ে-যাওয়া ঘরের চালাখানা পেলেই খুশি
কারও আশ্বাসেই তার আস্থা নেই
সে ডাকাতদলে যোগ দেবে না ভিখারির দলে
এই ভেবে চুল ছিঁড়ছে ক্রমাগত
মুখস্থ-মুখের মানুষ খুঁজছে:
এই নাও আমার দীর্ঘশ্বাসের সমবয়সী কাগজখানা
এই তো আমার পদত্যাগপত্র
আমার ছুটির একটি-একটি শব্দ
আমার আস্ত একটি কবিতার হাত-পা-ডানা
ভেঙ্গে দিয়ে
ঝাপ্টা মেরে হাত থেকে বলপেনটা কেড়ে নিতে
যে কোনোদিন হামলা দিতে পারে
যে কোনোদিন...
আমার ছুটির দিনের শব্দগুলো-
শোনে না আর লক্ষ্মীসোনা ডাক
শোনে না গানের কলি-ফোটা সুরতরঙ্গ
আমি একাই বুঝি বিস্ময়ে হতবাক
আমি ছাড়া আক কে দেবে ওদের সঙ্গ
আমার ছুটির একটি-একটি শব্দ
গো ধরে আছে না-ফেরার যাদুমন্ত্রে
সূতালি-নদীর অভিমানে এখন জব্দ
ভাঙবে তবু মচকাবে না ষড়যন্ত্রে
আমার ছুটির দিনের শব্দগুলোর আয়ু
জোট বাঁধবার কাজে গভীর মগ্ন
খুঁজছে আগুন, খুঁজছে বাতাস, মাটি এবং বায়ু
আমার ছুটি দিনের শব্দগুলো অন্যকাজে মগ্ন
আমার ছুটির দিনের শব্দগুলো
সেই-যে ছুটিতে গ্যালো
আর ফিরলো না
সানাউল হক খান সত্তরের দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের নদী, জল, বৃক্ষ, পাখি এবং নগর জীবনের নানান জটিলতার গলি-ঘুপচিকে উপজীব্য করেই প্রবাহিত হয়েছে তার কবিতা, প্রবহমান নদীর মতোই সাবলীল সেই ধারা। তার কবিতায় সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি প্রবল কিন্তু তাতে শিল্পগুণ ম্লান হয়নি একটুও। সানাউল হক খানের কবিতায় ছন্দের কারুকাজ আছে, আছে শব্দের দ্যোতনা। স্যামুয়েল কোলরিজের ‘শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস’র অনেকখানি দাবিই মিটিয়েছেন কবি সানাউল হক খান।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৬
এসএনএস