ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বুদ্ধদেব বসুর ভাষান্তরে কালিদাসের ছন্দ আর বোদলেয়ারের বিষাদ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৬
বুদ্ধদেব বসুর ভাষান্তরে কালিদাসের ছন্দ আর বোদলেয়ারের বিষাদ

সাহিত্যের প্রত্যেক শাখায় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করা বুদ্ধদেব বসু যখন অনুবাদে হাত দেবেন তখন সেটা ভিন্ন ভাষার অসোয়াস্তি ভেঙ্গে সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষার সম্পদ হয়ে উঠবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

বুদ্ধদেব বসুর ভাষান্তরে কালিদাসের ছন্দ আর বোদলেয়ারের বিষাদ
সুমাইয়া মাশরুফা


সাহিত্যের প্রত্যেক শাখায় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করা বুদ্ধদেব বসু যখন অনুবাদে হাত দেবেন তখন সেটা ভিন্ন ভাষার অসোয়াস্তি ভেঙ্গে সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষার সম্পদ হয়ে উঠবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বাংলা ভাষার উপর যে আত্মবিশ্বাসী দখল বুদ্ধদেব বসুর আছে সেটা তার উপযুক্ত শব্দ নির্বাচনেই স্পষ্ট।

কিন্তু শুধু ভাষায় দখল থাকাই নয়, যে সংবেদনশীলতা একটি অনুবাদকে ভিন্ন একটি ভাষাতেও হৃদয়গ্রাহী হওয়ার ক্ষমতা করে দেয় সেটাও তার আছে। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ করা কালিদাসের মেঘদূত এবং শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা, দুটোই এর আদর্শ উদাহারণ হতে পারে।

পাশ্চাত্যে যেভাবে প্রাচীন সাহিত্য, সমগ্র সাহিত্য শরীরে অন্যসব সাহিত্যের মতো একইভাবে প্রবাহিত, বাংলায় তার প্রকট অভাব। গ্রীক বা লাতিন সাহিত্যের ক্লাসিক বলে স্বীকৃত লেখাগুলোর প্রচুর অনুবাদ ছড়িয়ে আছে। হোমার, সফোক্লিস, অ্যারিস্টোফানিস বা য়ুরোপিডিস এর লেখা অনুবাদের ফলে তার যে বিপুল প্রভাব সমস্ত সাহিত্য জগতে পড়েছে তার সুফল রেনেসাঁর মতো নবজাগরণ জানিয়ে যায়। ক্লাসিক এর যে বৈশিষ্ট, সেটা ভিন্ন সময়ে এবং সমাজেও প্রাসঙ্গিক এবং মানব অনুভূতি ছুঁতে পারার মতো সেটা অনুবাদের মাধ্যমেই আস্বাদের সুযোগ হয়। বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে মেঘদূত সেই অভাব অনেকটা পুরণ করে দেয়। যে প্রাচুর্য পড়ে রয়েছে প্রাচীন সাহিত্যে, বুদ্ধদেব বসু সেতু নির্মাণ করে দিয়েছেন সেখানে নির্বিবাদে ভ্রমণের জন্যে।  

বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘যা আমরা একেবারেই বুঝি না তাতে আমরা আনন্দ পাই না; যা আমরা সম্পূর্ণরূপে বুঝে ফেলি তাতেও আমরা আনন্দ পাই না। ’ মেঘদূতে ভাবগম্ভীর সংস্কৃতের ছায়া অক্ষুণ্ন রেখে বাংলায় প্রতিটি শ্লোকের ভাষান্তর করা হয়েছে। কালিদাস যেরকম একটি শ্লোকের একাধিক অর্থ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রেখেছেন আর সব উচু দরের সাহিত্যের মতোই, অনুবাদেও সেই রূপ দেখা যায়। মেঘদূতের ছন্দ, ধ্বনি যে আবেদন সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে পাঠকের মনে, সেই অমৃত অনুবাদে ক্ষুণ্ন হয়নি।  

বুদ্ধদেব বসু মেঘদূতের খাঁটি অনুভূতি টিকিয়ে রাখতে ন্যায্যতভাবেই কালিদাসের বোধ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন এবং সেক্ষেত্রে অনুবাদকের নিজস্ব বিচার ও স্বাদ উঠে এসেছে। আবার ভাষা বা স্টাইল ধরে রাখার ব্যাপারটিও আছে। সংস্কৃত বা প্রাকৃত শব্দের মাত্রাবিতরণ, কাব্যিক রীতি বা পুরনো ভাষা বজায় রেখে বোধগম্য বাংলায় শ্লোক ভাষান্তর করা হয়েছে। যতদূর সম্ভব আধুনিক বাংলায়ই অনূদিত হয়েছে মেঘদূত। সংস্কৃতের যে ঝংকার আছে সেটা প্রবাহিত করার জন্যে অম্বু, অম্বজ, দ্বিরদ এরকম শব্দও রয়েছে। আবার যবে, পুন, যেথা এরকম পুরনো কাব্যিক শব্দও স্থান পেয়েছে। কিছু দীর্ঘ সমাসও আছে অলংকারের মতো, ‘যুবতী-জল-কেলি-সৌরভ’, ‘মন্দাকিনী-বারি-স্পৃষ্ট’।

বুদ্ধদেব বসুর বিরুদ্ধে গুরুচণ্ডালের অভিযোগ এসেছে মেঘদূত অনুবাদে। ‘নাসিকারন্ধ্রের মধুর বৃংহতি গন্ধ নেয় তার হাতির পাল’ বা ‘চটুল পুটিমাছ লাফিয়ে চলে যে, দবল কুমুদের কান্তি’, এরকম অনুবাদের ফলে একথা আসেই। বুদ্ধদেব বসু নিজেও স্বীকার করেছেন উপরোক্ত চরণে ‘হাতির পাল’ না বলে ‘হস্তীযূথ’ বা ‘পুটিমাছ’ না বলে ‘শফরী’ বলার সুযোগ ছিলো। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু  নিজেই তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, একেবারে চলনসই বাংলা শব্দে দাড়িয়ে যাওয়া শ্লোকটিতে চিত্রবহতা অনেক বেশি। এবং সেক্ষেত্রে ব্যাকরণের চেয়ে ঊর্ধ্বে শ্লোকের ভাববোধ। এখানেই বুদ্ধদেব বসু স্বার্থক অনুবাদে, যে তিনি  ভাববোধ রক্ষাকেই সবথেকে বেশি প্রশ্রয় দেন।  

মেঘদূত অনুবাদে বুদ্ধদেব বসু সহায়ক হিসেবে পেয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষদের। এদিক থেকেও তার এতটা চমৎকার ভাষান্তরের কারণ টের পাওয়া যায়। তখনকার সংস্কৃত কাব্যরীতির চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য বাহুল্যতা হওয়া সত্ত্বেও কালিদাসের রচনায় যে মিতাচার রয়েছে তার নিটোল রূপান্তর ঘটেছে অনুবাদেও। সূচনার সঙ্গে সমাপ্তির সঙ্গতি, শ্লোকের মধ্যকার সম্পর্ক, যক্ষের আরাধনা ও মেঘের প্রবাহে যে অসাধারণ চিত্রকল্প কালিদাস ফুটিয়ে তুলেছেন, সেই জগতে আমন্ত্রণ বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ। এখানে জানালা খোলা আহ্বানে দেখা যায় ‘সেথায় বাতায়নে, কেশের প্রসাধনে গন্ধধূপ উদগীর্ণ’।

শার্ল বোদলেয়ারের নির্বাচিত কিছু কবিতা স্থান পেয়েছে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে। বুদ্ধদেব বসু তার এই অনুবাদ  নিয়ে বলেছেন, ‘এই গ্রন্থ তাদেরই উদ্দেশ্যে রচিত, যারা আমাদের মতোই সাধারণ পাঠক, কবিতা ভালোবাসেন বলেই কবিতা পড়ে থাকেন’। সম্ভবত ভাষান্তরে অনুবাদকের নিজের সত্তারও যে প্রতিফলন ফুটে উঠে সেটার দায় স্বীকার করে তিনি একথা বলেছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, কবিতা পাঠে যে স্বভাবজাত আনন্দ, যে সূক্ষ্ম ব্যথা, যে গভীর বোধ তা স্বার্থক করে পেতে কবিতার ভাবের সঠিক রূপান্তর প্রয়োজন। যে তীব্র সৌন্দর্যবোধ এবং কোমলতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু অনুবাদ করেছেন বোদলেয়ারকে সেটা অপরিহার্য ছিলো বৈকি। শার্ল বোদলেয়ারকে বিষাদের কবিই বলা যায়। তার সৌন্দর্যও তীব্র ব্যথার হাত ধরে আসে। বাংলা বর্ণমালায় সেই অকৃত্রিম বিষাদের বোদলেয়ারকেই খুঁজে পাওয়া যায়।  

‘নির্জীব বিশ্ববোধ’ থেকে পরিত্রাণ এবং অন্য ভাষা ও সমাজের কবির মুখেও সেই একই অনুভূতি যা সমস্ত মানুষকে ছুঁতে পারে, সেই উত্তরণ খুঁজে পাওয়া বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে। বুদ্ধদেব বসু বাংলা ভাষার স্বভাবগুণকে কাজে লাগিয়ে মূলকে লঙ্ঘন করা এড়িয়েছেন, যেটা ইংরেজি অনুবাদেও আটকেছে হয়তো। ছন্দের বৈচিত্র্য, চিত্রকল্প, উপমা বা স্তবকসজ্জা ঠিক রেখে বোদলেয়ারের ভাবনা বা ‘অভিপ্রায়’ থেকেও বিচ্যুত হয় না অনুবাদ।  

এক কবি আরেক কবির কাব্য অনুবাদ করবেন মানেই সেখানে সফল হবেন এমন বলা যায় না। অনুবাদ করতে হলে শব্দজ্ঞান অসাধারণ হতে তো হবেই, কিন্তু তারপরও ফাঁক থেকে যায়। মিতচারী শব্দের ব্যবহার করেও বোধের গভীরতা আনা, এ এক কঠিন কাজ। উদাহরণ হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুবাদ উল্লেখ্য, যেখানে তিনি অনুবাদ করেছেন- ‘আমি ভালবাসি মেঘ, যে সব মেঘেরা ভেসে যায়, ঐ ওখানে,’ এখানে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘আমি ভালবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...ঐ উঁচুতে...ঐ উঁচুতে...’ , সুস্পষ্ট পার্থক্য এখানেই। ‘চলিষ্ণু মেঘ’ চিত্রকল্পটিই অনেক কিছু বলে দেয়।

আধুনিক কবিতার জন্ম দেওয়া বোদলেয়ার নিজেও এডগার এলান পো’র কবিতা অনুবাদ করেছিলেন, যা অত্যন্ত সুখপাঠ্য হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদও তাই। যে বোদলেয়ার বলেন ‘পাপকর্মের চৈতন্যই মহত্তর রতিসুখসার’, যে বোদলয়ার ‘দস্তয়েভস্কির প্রিন্স মিশকিনের মতো’, যে মনে করতো ‘রূপসী’ ও ‘বিষাদময়ী’ প্রায় সমার্থক, যিনি বলতেন ‘মানুষ দুঃখী, কিন্তু সে জানুক সে দুঃখী, মানুষ পাপী, কিন্তু সে জানুক সে পাপী; মানুষ রুগ্ন, কিন্তু সে জানুক সে রুগ্ন’, সেই নিদারুণ আত্মোপলদ্ধি বুদ্ধদেব বসু বাংলা বর্ণমালায় তুলে এনেছেন অবিকৃতভাবে। এবং বোদলেয়ায়ের কথাতেই বলা যায়, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ, তার কাব্যে মাতাল করে দেওয়ার ঐশ্বরিক শক্তি রাখে!

‘সুরা, কবিতা, পুণ্য- যার দ্বারাই হোক, মাতাল হও!’ (শার্ল বোদলেয়ার)

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।