হলের ভেতরে ঢুকতেই বড় বিস্ময়, এতো দর্শক! খানিক পরেই জানা গেল, দুইদিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবের প্রথম দিনে প্রদর্শিত হবে মোমেনা চৌধুরীর ‘লাল জমিন’। সবার আগ্রহ সে নাটক ঘিরেই।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ, জেলা প্রশাসক মনোজ কুমার রায়সহ অতিথিরা বক্তব্য দিলেন। জেলার বিভিন্ন সংগঠন তাদের গান, কবিতা, নৃত্য প্রদর্শন করলো। কিন্তু দর্শকরা যে ‘লাল জমিন’ দেখতে অপেক্ষার প্রহরে!
সেই প্রহর ভাঙলেন আবৃত্তিশিল্পী ও সংগঠক রাশেদ মাযহার। মাইকে ঘোষণা দিলেন, আর কিছুক্ষণ পরেই ‘লাল জমিন’ নিয়ে মঞ্চে উঠবেন মোমেনা চৌধুরী। মুহূর্তেই নৈঃশব্দে চুপসে যায় পুরো শিল্পকলা প্রাঙ্গণ। মোমেনা উঠলেন, মঞ্চে তখন মিটিমিটি রঙিন আলো। দেশজুড়ে যে ‘লাল জমিন’ আর মোমেনার কীর্তিগাঁথা রচিত, সেটা উপভোগের সুযোগে দর্শক সারি যেন স্থির। মোমেনা নিজেই ফুটিয়ে তুলছেন একের পর এক চরিত্র।
নাটকের বিষয়: মুক্তিযুদ্ধ। মোমেনা তার অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক সংলাপ দিচ্ছেন আর দর্শকদের চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। একক অভিনয়। মঞ্চ নাটকের এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
প্রথম দিকে মোমেনা ধীরস্থির থাকলেও খানিক পরে পাল্টে যায় তার অভিনয়ের ধরন। তখন ফুটে উঠে মঞ্চ মাতানোর মুন্সিয়ানা।
১৪ বছর বয়সী কিশোরী। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার জীবন। দুরন্ত বালিকাজীবন, বর্ণিল কৈশোর, দুঃসহ বয়ঃসন্ধিকাল। মুহূর্তেই এক কাল থেকে আরেককালে যাচ্ছেন তিনি, নিয়ে যাচ্ছেন যেন দর্শককেও। মঞ্চই বাড়ির উঠোন, খড় ছিটানো, এক্কাদোক্কা খেলা, ফসল মলনের জায়গা, পদ্ম-শাপলা ফোটা বিল। দর্শকের সামনে পুরো মঞ্চটাই যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। মোমেনার অভিনয় ধীরে ধীরে এক অনন্য উচ্চতায় উঠতে শুরু করে।
হলভর্তি সব দর্শক স্তম্ভিত হয়ে মোমেনার অভিনয় দেখছিলেন, নিশ্চুপ মুগ্ধতায়। নাটকের ঠিক মাঝামাঝিতে দেখা যায় খানখান হয়ে ভেঙে পড়া মোমেনার স্বপ্ন।
শেষে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া বাংলাদেশ যেন লুটেরাদের রাজ্য। অবাধ শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা আর প্রতারণার অভয়ারণ্য। পরিচালক মান্নান হীরা দর্শককে নিয়ে যান আরও অনেক গহীনে। তা না হলে কি প্রত্যেক দর্শকের চোখেই অশ্রু ঝরে? প্রায় এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিটের নাটকটি মঞ্চায়নের পর তাঁকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি নাট্যব্যক্তিত্ব রোকেয়া প্রাচী। অশ্রু মোছেন মঞ্চের অন্য অতিথি ও দর্শকরাও।
২০১১ সালে শূন্যন নামের রেপার্টরি দল মঞ্চে আনে মান্নান হীরার লেখা নাটক ‘লাল জমিন’, নির্দেশনার দায়িত্ব পান সুদীপ চক্রবর্তী। মোমেনা চৌধুরীর আত্মপ্রকাশ ঘটে একক অভিনেত্রী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চৌদ্দ ছুঁই-ছুঁই এক কিশোরীকে নিয়ে নাটকের গল্প। তার মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযুদ্ধ নিয়ে এগিয়ে চলে কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরীর জীবনে ঘটে যায় ভয়ানক সব ঘটনা। কিশোরীর সাদা ধবধবে জমিন-জীবন নয় মাসে কী করে একটা ‘লাল জমিন’ হয়ে ওঠে, তা নিয়েই এই নাটক।
নাটক শেষে হলে বসেই কথা হয় মোমেনা চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘লাল জমিন যেদিন থেকে শুরু করেছি সেদিন থেকে আজ অবধি আমার চিন্তা-চেতনার রাজ দখল করে আছে নাটকটিই। এটি এখন আমার জীবনেরই অংশ। ’
এরই মধ্যে নাটকটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে পেয়েছে অনুদান। দেশের বিভিন্ন জেলা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাটকটি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় ১৬০তম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় ফেনী শিল্পকলা একাডেমিতে।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৪ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৮
এসএইচডি/এইচএ/