[ভারতীয় কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব হাবিব তানভির। ২০০৯ সালের ৮ জুন ৮৫ বছর বয়সে এই নাট্যস্রষ্টা প্রয়াত হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘রাজর্ষি’ ও নাটক ‘বিসর্জন’-এর বিষয়বস্তুকে নিয়ে একত্রে একটি নাটক নির্মাণ সম্ভব, এই বিষয়টি কীভাবে এবং কখন আপনার ভেতরে ক্রিয়াশীল হয়েছিল?
হাবিব তানভির: লক্ষ করে থাকবেন, আমিও রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকের অন্যান্য নির্দেশকের মতো এটি মঞ্চে আনার চেষ্টা করেছিলাম। আমার আগেও অনেক নির্দেশকই নাটকটির বিষয়বস্তুতে আকর্ষণ বোধ করেছেন এবং তার মূল্য তাঁরা উপলব্ধি করেছেন। শম্ভু মিত্র থেকে শুরু করে নবীন নির্দেশক (অবশ্যই আমি তাদের কোনো প্রযোজনা দেখিনি) সবাই এই নাটকের চোরাবালিতে সহজভাবেই ডুবে গেছেন। এ বছরের শুরুর দিকে আমার থিয়েটার কোম্পানি ও ঊষা গাঙ্গুলির ‘রঙ্গকর্মী’ মিলে যৌথভাবে ‘বিসর্জন’ প্রযোজনা করেছিলাম। ওই সময়ে আমি নাটকটির ছাঁচ ভাঙছিলাম, দৃশ্য ও দৃশ্যের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেণ করছিলাম, এবং যে কোনো কারণেই বিষয়টি আমার মনঃপূত হচ্ছিল না। এমন কী প্রযোজনাটির কারিগরি বিষয়গুলোতেও ক্রমশ আমি বিরক্ত বোধ করতে থাকি। আলো নিয়েও সন্তুষ্ট ছিলাম না, কিন্তু তারপরও বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত করতে সম হই। দর্শকরা প্রয়োজনাটি গ্রহণ করেছিল, কিন্তু বেশ কজন কাছের বন্ধু তাদের সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এমন কী আমিও নিদারুণ ব্যর্থতার একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম।
এভাবে নাটক নির্মাণের প্রকৃত পরিকল্পনাটি কার? আপনার না রঙ্গকর্মীদের?
হাবিব তানভির : এটা আমার পরিকল্পনা। ধর্ম ও মানবিক মতের দ্বন্দ্বনির্ভর আকর্ষণীয় বিষয়বস্তুর কারণে, দীর্ঘ সময় ধরেই আমি এই নাটকটি করতে চেয়েছি। শম্ভু মিত্র সত্যিকার অর্থেই একজন ভালো অভিনেতা ছিলেন, এমন কী তাঁর স্ত্রী তৃপ্তি মিত্রও ছিলেন একজন মেধাবী অভিনেত্রী। বিসর্জন নাটকটি তাঁরা হাউসফুল শো করেছেন। এরপরও চার কিংবা পাঁচটি শো করার পর শম্ভু মিত্র প্রয়োজনাটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ প্রযোজনাটি ছিল ত্র“টিপূর্ণ। আমিও আবিষ্কার করি নাটকটিতে কিছু ঝামেলা রয়েছে। তখন শৌমিক ব্যানার্জি আমাকে বললেন, নাটকটির মূল অনুভূতিগুলোকে আমার পরিকল্পনার সাথে একাত্ম করে নতুন ভাষ্য নির্মাণের মাধ্যমেই শুধু এটি সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপন সম্ভব। আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম, যারাই বিসর্জন নিয়ে কাজ করেছেন, তারা প্রত্যেকেই কীভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, এটি নিয়ে এখন নতুনভাবে লেখা যেতে পারে, কেননা গ্রন্থস্বত্ববিষয়ক সমস্যটি আর মাথার ওপর ঝুলে নেই। কিন্তু আমি বেশ শঙ্কিত-ভারাক্রান্ত ছিলাম এই ভেবে যে, আমি কিছু বাঙালির সংকীর্ণ আচরণের শিকার হবো, যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে রীতিমতো পুজো করেন এবং রবীন্দ্রনাথ যাঁদের আদর্শ। যাই হোক, আমি প্রাজ্ঞব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ করি এবং আমার লেখা শুরুর সিদ্ধান্ত নিই।
উপন্যাস ‘রাজর্ষি’ এসবকিছুর সঙ্গে কীভাবে একাত্ম হলো?
হাবিব তানভির : আমি সে প্রসঙ্গে আসব। কিন্তু প্রথমে আমাকে এই অ্যাডাপটেশনের নেপথ্যের সম্পূর্ণ পরিপ্রেতি বলতে দিন। রবীন্দ্রনাথ বাংলায় ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটি লেখার পর ‘স্যাকরিফাইস’ (বিসর্জন) ইংরেজিতে লেখেন। বিসর্জন রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক, সে কারণে হতে পারে এতে অনেক ত্রুটি ছিল। উপন্যাসটি তিনি লেখেন ১৮৯০ সালে আর নাটকটি লেখা হয় ১৮৯৩ সালে। তিনি সেখানে রাণীর (গুণবতী) চরিত্র যোগ করেন যা উপন্যাসটিতে ছিল না। এমন কী অপর্ণার চরিত্রও তিনি নাটকটিতে এনেছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস, নাটকটির অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট ধারণা ছিল। যদিও প্রথমে আমি আমার প্রযোজনাটিকে ‘বিসর্জনের’ সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নামাকরণ করেছিলাম ‘বলিদান’। আপনি ল করে থাকবেন, রবীন্দ্রনাথ নিজের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীতে। তাঁর সর্বাঙ্গীন পূর্ণতা শুরু হয় ১৯২০-র সময় থেকে। তিনি জিনিয়াস ছিলেন, কিন্তু যতই অভিজ্ঞতা তাঁর ভাণ্ডারে জমা হচ্ছিল, ততই তিনি মতাশালী হয়ে ওঠেন। যখন ‘বিসর্জন’ লিখেন নিতান্তই তরুণ ছিলেন। অবশ্যই তিনি নাট্যিক মাধ্যমটি নিয়ে গবেষণা করেছেন। অথচ তারপরও এ নাটকের চরিত্রগুলো ও বিষয়বস্তু এখনও আকর্ষণীয়। ‘বিসর্জন’-এর যা আমাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে তা রঘুপতির চরিত্র, যিনি ছিলেন পুরোহিত এবং জয়সিংহ যে কিনা রঘুপতির অনুসারী ও পালিত পুত্র। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্র দুটিকে যাবতীয় আচারের ঘেরাটোপে বন্দি করে ধারালরূপে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু রাণীর চরিত্রটি সুবিবেচনায় লিখিত নয়, যে কারণে রাজার চরিত্রটিতেও ঘাটতি রয়ে গেছে। উপন্যাসে রাজার চরিত্রের যে ঔজ্জ্বল্য, এমন কী তাঁর ছোট ভাইয়ের যে চরিত্র, তা পূর্ণাঙ্গ। উপন্যাসটিতে রঘুপতির সঙ্গে রাজনৈতিক গোপন দ্বন্দ্ব রয়েছে, যে কিনা রাজা গোবিন্দমাণিক্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজা ঋষিতে পরিণত হন, যে কারণে উপন্যাসের নামাকরণ হয় ‘রাজর্ষি’। চরিত্রগত দিক থেকে এর কাহিনী অনেকটাই কূটরাজনীতি নির্ভর, যেমনটি দেখা যায় ‘চাণক্য’র মাঝে। অ্যাডাপটেশনে রাণী গুণবতীর চরিত্রটির বিকাশ ঘটাতে আমি রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি পরিচিত উপন্যাস ‘চারুলতা’ থেকে ইঙ্গিত গ্রহণ করেছি [আসলে ‘চারুলতা’ নামে রবীন্দ্রনাথের কোনো উপন্যাস নেই, আছে তাঁর একটি ছোটগল্প, নাম ‘নষ্টনীড়’। এর মূল চরিত্র চারুলতা। এটি অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের আলোচিত চলচ্চিত্র ‘চারুলতা’। এ কারণে অন্যভাষী হাবিব তানভির বিভ্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। -সম্পাদক]। চারুলতার মতোই রাণী তার স্বামীর কাছ থেকে অবহেলার শিকার হয়, এবং ক্রমেই তার মনোযোগ দেবরের প্রতি ধাবিত হয়। আমি দেখাতে চেয়েছি রাজা ও রাণীর মধ্যে তিক্ততার সম্পর্ক, হতে পারে তাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত নেই, এই বিষয়ের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু মূল নাটকে এটা পরিষ্কার নয়, কেন রাণী একটি সন্তানের জন্য এত মরিয়া হয়ে ওঠেন। রাণীর শুধু মনে হয়, যদি দেবী কালির উদ্দেশ্যে পশু ‘বলি’ দেওয়া যায় তবেই সে সন্তান লাভ করতে পারবে। পাশাপাশি এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, একজন রাজা রক্তারক্তির বিষয়ে অভ্যস্ত ছিলেন না। যুদ্ধে রক্তবন্যার অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। কিন্তু যখন শিশুটি কালিমন্দিরে একটি পশু বলি দেয়ার পর ছড়ানো রক্ত দেখে রাজাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এতো রক্ত কেন...’, তখন রাজার ভেতরে রূপান্তর ঘটে। শিশুর দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থান থেকে এই আচার বিষয়ে রাজার ভেতর প্রশ্ন দেখা দেয়, যিনি নিজেও দিনান্তে মৃত্যুবরণ করেন। বিসর্জন ও রাজর্ষি নিয়ে আমার অ্যাডাপটেশন চরিত্রগুলোকে অনেক বেশি দায়িত্ববান ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে, তবে তা মূলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে যায়নি। আমি সত্যিই মনে করি, আমার অ্যাডাপটেশনের ফলে মূল নাটক একটি ছন্দোবদ্ধ ও যৌক্তিক অবয়ব লাভ করেছে।
আপনার কাছে কি কোনো তৈরি পাণ্ডুলিপি ছিল যার ওপর নির্ভর করে আপনার অভিনয়শিল্পীরা কাজ করেছে, নাকি মহড়ার সময় ধীরে ধীরে নির্মিত হয়েছে?
হাবিব তানভির: না না, আমি প্রথমে পাণ্ডুলিপি লিখেছি। এটা আমাকে ওইভাবেই করতে হয়েছে। তবে অবশ্যই আমি নাটকটির বিষয়বস্তু নিয়ে আমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এমন কি শারীরিক সমতাবিষয়ক প্রশ্ন নিয়েও কথা বলেছি, যে কারণে রাণী সন্তান ধারণ করতে পারেন না। আমার পারফর্মারদের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমি তাদের আমাদের সঙ্গে কাজ করে এমন একজন অভিনেতা মুরলির উদাহরণ দিয়েছি। একটি সন্তানের আকাক্সায় সে তিনটি বিয়ে করেছে, অথচ এখনো পর্যন্ত সন্তানের মুখ দেখেনি। আমি মুরলিকে বলেছি, সে যেন বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করে যে, তার কোনও সমস্যা থাকতে পারে, এটি নিয়ে দুঃখবোধ না করে তার রক্ত পরীা করে। আমি উপন্যাসটিও আমার পারফর্মারদের পড়িয়েছি, আলোচনা করেছি। তারা বুঝতে পেরেছিল কেন আমি আমাদের নাটকে উপন্যাসটির কিছু কিছু অংশ ব্যবহার করেছি।
নাটকে ব্যবহৃত গানগুলো কীভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, বিশেষ করে নাট্যচরিত্র অপর্ণার কণ্ঠে গাওয়া বাংলা গানগুলো?
হাবিব তানভির: গানগুলো রবীন্দ্রনাথের নয়। ওগুলো ছিল বাউল এবং যোগীর সংমিশ্রণ। ওগুলো লোকগান, যার একটি আধ্যাত্মিক চারিত্র আছে। গানগুলো অপর্ণার জন্য গ্রহণ করা হয়েছিল, কেননা চরিত্রটির মধ্যে একটি আধ্যাত্মিকতা রয়েছে। তার সঙ্গে জয়সিংহের সংলাপ আমাকে গানগুলো নির্বাচনে সহায়তা করেছে। ঘটনাচক্রে এ বিষয়ে কেউ একজন আমাকে প্রশ্নও করেছিল, কেন আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যবহার করিনি, আমি তাকে ওনেস্টলি বলেছি, আমি রবীন্দ্রনাথের সব গান পছন্দ করি না। এর মাঝেও যা ভালো আমি তাকে স্বর্গীয় বিবেচনা করি, কিন্তু কিছু কিছু আছে যা ভীষণ কিশে আর শস্তা ভাবাবেগে পূর্ণ।
নাটকে ছত্তিশগড়ির সঙ্গে সামান্য হিন্দি ব্যবহারের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল কী?
হাবিব তানভির: আমার বেশ কয়েকটি নাটকে হিন্দি ভাষা ব্যবহার করেছি, আর এখন আমার অভিনয়শিল্পীরা হিন্দি ভাষা বেশ ভালোই পারে, যেমনটা পারে ছত্তিশগড়ি। না, এই দুই ভাষা ব্যবহারের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। কিন্তু এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, সংলাপের ওঠানামার বিষয়টি আমি পর্যবেক্ষণ করেছি। সেগুলো আসলে মাঝারি মানের ছিল। যারা এখন সংলাপের ওঠানামার বিষয়ে ল করেন, তারা লেখকের সামর্থ্য সম্পর্কে উপলব্ধিই করতে পারবেন না, যা তুলসি দাস, মিরা বাঈ, কবির পারতেন। এবং এখানে আমি মাত্র কয়েকজন শ্রেষ্ঠ কবির নাম উচ্চারণ করেছি। সংলাপের ওপর নজর দিতে গেলে হিন্দি ভাষা এবং এর সমৃদ্ধ সম্প্রসারণের ব্যাপারে মানুষ নিরুৎসাহিত হতে পারে। সুতরাং হিন্দিকে আমি অন্যান্য অনেক শাখার মতোই বিবেচনা করেছি। মধ্যপ্রদেশেই আপনি উর্দু, বাগেরি, ছত্তিশগড়ি প্রভৃতি ভাষার সমাহার দেখতে পাবেন। আর সেকারণেই আমি কখনোই একটি থেকে অন্যগুলোকে পৃথক করে দেখি না।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৪৫০, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১০