ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

পোখারায় প্যারাগ্লাইডিং...

জান্নাতে রোম্মান তিথি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৪ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৪
পোখারায় প্যারাগ্লাইডিং...

প্রাকৃতিক দিক দিয়ে নেপাল সবসময়ই সুন্দর। তার এই সৌন্দর্যই পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে।

নেপাল ভ্রমণের আগপর্যন্ত পাহাড় থেকে সমুদ্রই আমাকে বেশি টানতো। চঞ্চল সমুদ্রের উচ্ছ্ল ঢেউগুলিকে কতই না আপন মনে হতো, অন্যদিকে পাহাড়কে মনে হতো বড্ড অহংকারি আর দাম্ভিক; কোনো কিছুতেই যেন তার কিছুই এসে যায় না। কিন্তু নেপাল ভ্রমণের পর পাহাড়ের যে সৌন্দর্য দেখি, তাতে মনে হলো- এমন সৌন্দর্য নিয়ে যে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, তার একটু আধটু অহংকার থাকতেই পারে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করি, পাহাড়ের সৌন্দর্য।

যাই হোক নেপাল ভ্রমণে আমার সঙ্গী ছিল আমার মেয়ে টুনটুন (উমাইজা), বোন মিতি, মিতির বর কল্লোল আর ওদের ছেলে অবিয়ান। ১ জুন সকালে আমরা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে যাত্রা করি। ঢাকা থেকে কাঠমাণ্ডু, সেখানে থেকে নাগরকোট। আর শেষ গন্তব্য ছিল পোখারা। কাঠমাণ্ডু থেকে পোখারার দূরত্ব ২০২ কিলোমিটার, সে পথ তো আর আমাদের দেশের মতো সমতলের পথ নয়। পাহাড়ঘেঁষা এ পথ যেমন সৌন্দর্য জাগানিয়া, তেমন ভয়ে কম্পমান হওয়ার মতো ব্যাপারও অহরহ।

পথের একদিকে পাহাড়, অন্য দিকে খরস্রোতা নদী প্রায় সহোধরা। কোনো কারণে দুর্ঘটনা হলে রক্ষা নাই। পোখরা যাওয়ার পথেই পড়ে রুপওয়ে। নদীর উপর দিয়ে কেবল কার উঠে গেছে পাহাড়ে। যাওয়ার পথে, তা মিস করাটা কি ঠিক হবে?

কেবল কারে চড়ে তাই নদীর পেরিয়ে পাহাড়েই উঠে যাই। সে পাহাড়ে আবার রয়েছে একটি মন্দির। কেবল কারে করে পাহাড়ে ঘুড়ে আসা, ত্রিশুলি নদীর পাশে কিছুটা সময় কাটানো (যদিও প্রচণ্ড রোদের কারণে ওই সময়টাকে নরকের মতো লাগছিল) সবকিছু মিলে এক আনন্দযাত্রা।

পাঁচ দিনের নেপাল ভ্রমণের পুরো সময়টাই আনন্দে কাটে। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের খাওয়া নিয়ে ঝামেলাটাকে (মহা ঝামেলা বলাই ভালো) কিছুই মনে হয়নি। পোখারা যাওয়ার পথে এবং সব শেষে পোখারা..। পাঁচ দিনের নেপাল ভ্রমণের সবচেয়ে বেশি আনন্দদায়ক আর রোমাঞ্চকর বিষয় ছিল প্যারা গ্লাইডিং। আর আমাদের নেপাল ভ্রমণের সেরা উক্তি হলো, ‘আয় বাবা, আমার বুকে আয়’ (যা উচ্চারিত হয়েছিল আমার বোনের মুখ থেকে)।

এবার মূল ঘটনা বলি। পোখরা ভ্রমণের তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় হোটেলের লবিতে বসে চা খেতে খেতে প্রস্তাবটি প্রথম আমিই দেই। মিতি আর কল্লোলকে বলি, প্যারা গ্লাইডিং করার এই চালেঞ্জটা আমাদের নেয়া উচিত। এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া ঠিক হবে না। চল, তিনজন মিলে প্যারাগ্লাইডিং করি..যা আছে কপালে!!

এটাই আমাদের জীবনের প্রথম প্যারাসুট ভ্রমণ। তাই কিছুটা ভয় কাজ করছিল। তাছাড়া প্যারাগ্লাইডিং সম্পর্কে খুব স্বচ্ছ ধারণাও ছিল না। তারপরও চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করি। কল্লোলকে বলি, তিনটা টিকেট কেটে ফেলার জন্য। সে প্রথমে রাজি হলেও পরে পিছু হটে। তার ভয় নিজের ওজন নিয়ে। ধারণা, প্যারাসুটে উঠলে যদি ছাতা আকৃতির প্যারাসুট উল্টে যদি ইংরেজি বর্ণমালা U আকৃতি ধারণ করে, আর তা যদি শা শা শব্দে পাহাড়ের নীচে নেমে যায়!

কল্লোল কোনো রিস্ক না নিয়ে দু’টো টিকিট কিনে আনে। টিকিট কেনার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও চেষ্টা চালিয়ে যায়, যাত্রাভঙ্গের। ফলে আমাকে ফোন করে বলে, ‘আপা, টিকিট কিনব তো?’

আমি দৃঢ়ভাবেই জানাই, ‘হ্যাঁ, কিনে ফেলো।

 সুতরাং ঠিকঠাক দু’টো টিকিট কেনা হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হলো, পরদিন সকালে আমি আর মিতি যাব প্যারাগ্লাইডিং-এ। ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিলাম, ভীষণ ডিটারমাইন্ড, মিতিকে বললাম, ব্যাপার না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভয় ঠিকই কাজ করছিল-কী জানি কী হয়!

একটু ভয় পেলেও কিছুটা আশ্বস্ত নিজে নিজেই ছিলাম এ কারণে যে, যেহেতু এখানে টুরিস্টরা আসে। ফলে সবক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তাই থাকার কথা। এতোকিছুর পরও মিতির অবস্থা কিন্তু শোচনীয়ই মনে হলো। সে মাঝে মাঝেই ভয় লুকানো হাসি হাসার চেষ্টা করেও ধরা খেয়ে যাচ্ছিল।

৫ জুন সকাল ১১টা। তার আগে আমরা এক সঙ্গে নাস্তা করতে উঠি হোটেলের রুপটপে। নাস্তা খেতে খেতে কল্লোল জানায়, সারারাত আতঙ্কে নাকি মিতির ঘুম হয়নি। ঘুমাতে যাওয়ার আগে যথারীতি তার চোখের ট্যাপ খুলে গেল, কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসালো। কারণ পরদিন সকালে প্যারাগ্লাইডিং এ যাবে, তাতে কী না কী ঘটে, আর যদি ফেরা না হয়...! তাই শেষবারের মতো ওর ছেলেকে বলে, ‘আয় বাবা, আমার বুকে আয়। ’
ছেলে তো বাবার বুক থেকে আসতে চায় না...মিতির কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

এদিকে আমার শঙ্কা টিকিটের জন্য জমা দেয়া ১১ হাজার টাকাও মাটি না হয়। ঘটনা যা তাতে এমন ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না।   যা হোক ১০টার দিকে আমি আর মিতি চললাম পাহাড়ের গা বেয়ে ১৫০০ ফুট উঁচুতে, যেখান থেকে লাফ দিব। পুরো রাস্তা ওকে স্বাভাবিক রাখতে নানা কথা বলতে থাকলাম (নিজের ভয় লুকিয়ে)।

মিতির ভয় দূর হলো কিনা বোঝা গেল না। ১৫ মিনিট পর আসল সেই ক্ষণ। দুজনেই লাফ দিলাম প্যারাসুট নিয়ে, সঙ্গে পাইলট। লাফ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে সব পাল্টে গেল। মনে হলো, এমন ‍অভিজ্ঞতা তো এর আগে হয়নি। অভাবনীয়, অসাধারণ, তুলনারহিত, এমন নানা শব্দ মুখ থেকে এমনি এমনি বেরিয়ে আসতে থাকে।

নিজেকে মনে হলো পাখি। হ্যাঁ, ঠিকই তো পাখি, পাখির মত উড়ে উড়ে ঘুরতে থাকলাম। অবিশ্বাস্য মনে হলো সবকিছু। প্রায় ২০ মিনিট ভেসে ভেসে মাটিতে নেমে আসি। তখন মিতি আর আমার দুজনের মুখেই হাসি, অদ্ভুত ভালোলাগার হাসি,যেন অনেক বড় বিজয় এটি।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৪ ঘণ্টা, জুন ২০ , ২০১৪

** উড়বেন নাকি পাখির মতো!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।