ঢাকা: ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মুখে ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালানোর পর নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র এক ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে, যা ভারতের ‘দাদাগিরিকে’ নাকানিচোবানি খাইয়েছে। এরপর থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে নানা মিথ্যা সংবাদ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া প্রচারণা চলমান।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দেশের স্বার্থ ও জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতের প্রতি কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও ভূরাজনীতি বিএনপির কাছে বরাবরই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের নাক গলানো এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া সমর্থন ভালোভাবে নেয়নি সাধারণ জনগণ। সেই সময়গুলোতে একমাত্র বিএনপিই চেষ্টা চালিয়ে গেছে জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে। কিন্তু নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা, গুম, খুনের মাঝে খুব একটা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। তবে ১৬ বছর একপ্রকার কারাবন্দি থেকেও আন্দোলন জারি রেখেছিল বিএনপি। আর তাতে লন্ডন থেকে সাহস যুগিয়ে গেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতের ভূমিকাসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে বরাবরই সংরক্ষণশীল নীতি অনুসরণ করেছে বিএনপি। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করলেও তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যা ও ট্রানজিট ইস্যুতে টানাপড়েন তৈরি হয়।
বিএনপি বারবার প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করলেও তেমন সফলতা পায়নি। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করলেও ভারত সরকার তোয়াক্কা করেনি।
তবে ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টাকে সাধারণ জনগণ ও বিএনপির অনেক সমর্থক খুব ভালোভাবে নেয়নি। বিএনপি যখন থেকে ভারতের আনুগত্য পাওয়ার চেষ্টা করেছে, তখন থেকে ভারতবিরোধী মনোভাবাপন্ন বিএনপির সমর্থকরা নীরবে দলটি থেকে সরে যেতে থাকে।
বর্তমানে বিএনপির ভারতের ‘বড় দাদা’ সাজার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াকে আবার গ্রহণ করতে শুরু করেছে সর্বসাধারণ। সাধারণ মানুষ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভারত আমাদের স্বার্থের কথা কখনই ভাবেনি, তারা কখনোই আমাদের বন্ধু ছিল না, বরং তারা নিজ স্বার্থ উদ্ধারে বাংলাদেশের সাবেক সরকারকে টিকিয়ে রেখেছিল, যারা গণহত্যা চালিয়ে পালিয়েছে। ভারত যদি আমাদের কথা ভাবতো, তাহলে এতো বছর বিনা ভোটের নির্বাচনকে সমর্থন করতো না।
তবে সম্প্রতি ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ও উপ-হাইকমিশনার প্রভন বাঁধকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। ভারতের এই উদ্যোগ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, দিল্লি এবার বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ খুঁজছে, বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে।
অন্যদিকে, বিএনপি দিল্লির বুকে স্বস্তি খুঁজছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। দলটির নেতারা বলছেন, তারা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সংগঠিত এবং শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। ৫ আগস্টের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখার চেষ্টা চলছে বলে দলের অভ্যন্তরে আলোচনা রয়েছে।
বিএনপির সাম্প্রতিক অবস্থান খুবই স্পষ্ট, দলটি ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লালমনিরহাটে তিস্তা রেলসেতু এলাকায় ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাও’ আন্দোলনের কর্মসূচিতে বলেন, ভারতের উচিত ‘বড় দাদাসুলভ ও মাস্তানির আচরণ’ বন্ধ করা। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, তবে তা হবে সম্মানের ভিত্তিতে। তিস্তার পানি ও সীমান্ত হত্যা ইস্যুতে বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে।
অন্যদিকে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় বিএনপি, তবে তা হতে হবে দেশের স্বার্থ সুরক্ষার ভিত্তিতে। ভারত যদি পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়, তাহলে জাতিসংঘে যাওয়ার বিকল্প পথ খুঁজবে বিএনপি।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বিএনপি এখন শক্ত অবস্থানে রয়েছে এবং দিল্লির বুকে স্বস্তি খোঁজার পরিবর্তে বরং ভারতের সঙ্গে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক নতুনভাবে নির্ধারণের কৌশল নিচ্ছে।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ বাংলানিউজকে বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। ভারতের বিষয়ে বিএনপির জায়গা একদম পরিষ্কার।
তিনি বলেন, বিএনপির ফরেন পলিসি (বৈদেশিক নীতি) অনুযায়ী আমরা যে কোনো দেশের সঙ্গে মাল্টি ইকোনমিক রিলেশন (বহুমুখী অর্থনৈতিক সম্পর্ক), দ্বিপাক্ষিক ও ট্রেড রিলেশনের (ব্যবসায়িক সম্পর্ক) দিকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছি। ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ এবং বৃহৎ দেশ, তাদের বাদ দিয়ে তো আমরা এই অঞ্চলে এগোতে পারবো না। তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে।
কথা উঠেছে, ভারত বিএনপিকে কাছে টানতে চাচ্ছে, তারা নিজ স্বার্থের কারণে চাচ্ছে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে- এ প্রসঙ্গে শামা ওবায়েদ বাংলানিউজকে বলেন, ভারতের এটি ভুল ফরেন পলিসি (বৈদেশিক নীতি), বরং ভারত এই অঞ্চলে অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ভুল ফরেন পলিসি নিয়ে চলছে। তারা একটি দলকে সব দিয়েছে বিগত বছরগুলোতে, তার পরিনাম এখন আমরা দেখছি। ভারত তো একটা সার্বভৌম দেশে নিজের পছন্দ মতো সরকার বসাতে পারে না।
বিএনপির ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপির পররাষ্ট্র নীতি একটি স্ট্যাবল ইকোনমি (স্থিতিশীল অর্থনীতি)। বর্তমানে দেশের ইকোনমি স্ট্যাবল না। আমরা সব দেশের সঙ্গে মাল্টি ইকোনমি, ট্রেড ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর জোর দিচ্ছি। নেপাল, ভুটান, চীন, সবাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। সকলের চোখ আগামী নির্বাচনের দিকে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্ত করবে।
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভারতের বিরুদ্ধে বিএনপি আগামীতে কঠোর থাকবে কি না, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপির একটাই নীতি, ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’। এর বাইরে কোনো কথা নেই।
ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে কি না, বা আগামীতে কী সম্পর্ক হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হবে তিনটি ভিত্তির ওপর। এক- ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা’, দুই- ‘পারস্পরিক কল্যাণ’ এবং তিন- ‘কোনও হস্তক্ষেপ নয়’।
তিনি বলেন, বিএনপি ভারত বিদ্বেষী নয়, তারা বাংলাদেশপন্থী একটি রাজনৈতিক দল।
আগামী দিনে বাংলাদেশের সার্বোভৌমত্বের স্বার্থে আপনার কি মনে হয় বিএনপির উচিত হবে ভারতের সঙ্গে কঠোর হওয়া? এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. এস এম রেজা বাংলানিউজকে বলেন, ট্র্যাডিশনালি বিএনপি ভারতঘেঁষা কোনো দল নয়, তারা বাংলাদেশপন্থী একটি দল, যা আমরাও চাই। ভারতকে সাইডলাইনে রেখে আপনি কিছু করতে পারবেন না, আবার ভারতও বাংলাদেশকে উপেক্ষা করে কিছু করতে পারবে না।
‘এমন পরিস্থিতিতে যেটা বিএনপিকে আগামী দিনে করতে হবে তা হলো, বাংলাদেশ ফার্স্ট নীতি অনুসরণ করা। বিএনপির উচিত হবে বাংলাদেশের স্বার্থকে রিপ্রেজেন্ট করা,’ বলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষক।
ভারত গত ১৬ বছরে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে তোয়াক্কা করেনি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের কাছে কি বিএনপির গুরুত্ব তৈরি হয়েছে? এমন প্রশ্নে এস এম রেজা বলেন, ভারত রাজনৈতিকভাবে খুবই ম্যাচিউরড (পরিপক্ক) একটা দেশ, স্বাভাবিকভাবেই তারা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করবে, যেহেতু বর্তমানে বিএনপিই প্রধানতম রাজনৈতিক দল। এখন এটি বিএনপিকে বিবেচনা করতে হবে তারা ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়, আওয়ামী ঘরানার নাকি বিএনপির নিজস্ব ঘরানার।
তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থে ভারতকে ইগনোর (উপেক্ষা) করা সম্ভব না। তবে আপনার রাজনীতি হতে হবে এমন যেন ভারত বাধ্য হয় আপনার মতো করে ভাবতে। একটা উইন উইন সিচুয়েশন থাকতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২৫
এসকে/এজে