ড. আম্বিয়া পারভিন, জন্ম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। ২০১২ সাল থেকে ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও নিজ দেশ মিয়ানমারে সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের আন্দোলন করছেন।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন ও সমসাময়িক আরাকান ইস্যুতে আম্বিয়া পারভিনের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলানিউজ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের জার্মানি প্রতিনিধি সাগর আনোয়ার।
ইউরোপীয় রোহিঙ্গা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ড. আম্বিয়া পারভিন
বাংলানিউজ: বাংলাদেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের কি কোনো অগ্রগতি হয়েছে?
আম্বিয়া পারভিন: অর্থপূর্ণ কোনো অগ্রগতি হয়নি। শুধুই প্রতীকী। বর্তমানে অর্থনৈতিক সহায়তা বজায় থাকলেও প্রত্যাবাসন বা অন্যান্য অধিকার রক্ষার রাজনৈতিক কোনো অগ্রগতি নেই। এটাই আসলে বেশি প্রয়োজন।
বাংলানিউজ: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি শুধুই মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করেছিলেন, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল?
আম্বিয়া পারভিন: সেই সময় বেশ কিছু গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু মানবিক কারণে নয় বরং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার আশায়, এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জনের সম্ভাবনাতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ ছাড়াই বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। যদিও সে সময়ে সংকটের ভয়াবহতা ও জরুরি মানবিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অনেকেই এসব গুজবে গুরুত্ব দিতে চাননি। তার সময় সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে তেমন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। অনেকে এখন তার রোহিঙ্গা বিষয়ে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপগুলোকেও নতুনভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ করছেন।
বাংলানিউজ: আপনি কি এখনো রোহিঙ্গাদের সম্মানজনকভাবে নিজ দেশে (আরাকান) ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী?
আম্বিয়া পারভিন: হ্যাঁ, আমি এখনো আশাবাদী। কারণ আশা ছেড়ে দেওয়া মানেই ন্যায়ের পথ থেকে সরে যাওয়া। সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন এখনও সম্ভব—যদি মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আইনগত সুরক্ষা, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির অনিচ্ছা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনাগ্রহ এবং রাখাইন রাজ্যে চলমান গণহত্যার কারণে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তারপরও, আন্তর্জাতিক মেকানিজম, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর উদ্যোগ ও কঠোর জবাবদিহিই একমাত্র রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের পথ তৈরি করতে পারে।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন?
আম্বিয়া পারভিন: আমি সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে না থাকলেও ক্যাম্পের রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। সবশেষ আমি এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেই বাংলাদেশ সফর করি। তখনকার অভিজ্ঞতা ও তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি গত এক বছরে মারাত্মকভাবে অবনতি হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিলও কমে গেছে। যার কারণে, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টির হার ২০২৪ সালের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে (উৎস: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ)। অনেক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু এনজিও বিভিন্ন সেবা সীমিতও করেছে। শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যও এখন ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
বাংলানিউজ: কিছুদিন আগে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। এ পরিদর্শন কি আশার বার্তা বহন করে?
আম্বিয়া পারভিন: যদি প্রতীকী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে অবশ্যই আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মার্চে কক্সবাজার সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবিক সহায়তা কমানোর বিষয়টিকে ‘অপরাধ’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন এবং সহায়তা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর উপস্থিতি আমাদের নিজ দেশে ফেরার মনোবল বাড়িয়েছে। কিন্তু প্রতীকী এসব কথাবার্তা ছাড়াও আমাদের এখন দরকার জরুরি বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ, মিয়ানমারের ওপর আরও আন্তর্জাতিক চাপ, ক্যাম্পগুলোতে মানবিক সাহায্য বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। সেটার কিছুই হচ্ছে না।
বাংলানিউজ: আরাকান আর্মি এখন রাখাইন বা আরাকানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে—এমন খবর আসছে। আরাকান কি মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে?
আম্বিয়া পারভিন: হ্যাঁ, আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট আছে এবং এর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। আরাকান আর্মি রাখাইনকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাস্তি রাষ্ট্র বা ‘ডি ফ্যাক্টো’ স্বাধীন রাষ্ট্র করতে যাচ্ছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হবে কি না, তা নির্ভর করবে যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা ও রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর। আমার ভয় হয়, যদি এই স্বায়ত্তশাসন বা নতুন রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে করা হয়, তবে তা আমাদের আরও রাষ্ট্রহীন ও অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দেবে।
বাংলানিউজ: এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাহলে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী?
আম্বিয়া পারভিন: পুরোটাই নির্ভর করছে আরাকান আর্মির ওপর। তারা কি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি গ্রহণ করবে নাকি রোহিঙ্গাদের বাদ দেওয়ার নীতি গ্রহণ করবে—এটার ওপর সব কিছু নির্ভর করছে। যদি তারা রোহিঙ্গাসহ সব সম্প্রদায়কে সমান অধিকার দেয়, তবে আশার আলো আছে। কিন্তু যদি তারা বাদ দেওয়ার পথেই থাকে, তাহলে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন, উদ্বাস্তু ও এমন নিপীড়িতই থাকবে।
আরাকান আর্মি
বাংলানিউজ: আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায় কেন?
আম্বিয়া পারভিন: এটা আসলে ঐতিহাসিক বিদ্বেষ। রাখাইন জাতীয়তাবাদ, রাখাইন জনগণের চাপ—এসবই মূল। এ অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সাহসী আভ্যন্তরীণ আলোচনা-সমঝোতা ও আন্তর্জাতিক চাপ দরকার।
বাংলানিউজ: এই সমস্যা সমাধানে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে কী আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে?
আম্বিয়া পারভিন: হ্যাঁ, ব্যাক চ্যানেলে ও স্থানীয় উদ্যোগ রয়েছে। উদ্দেশ্য হলো—অধিকারভিত্তিক সংলাপ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি করা। তবে তাদের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনার সম্মতি মেলেনি।
বাংলানিউজ: তাহলে রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রত্যাবর্তনের পথ কি বন্ধ করে দিল নাকি আশার আলো আছে?
আম্বিয়া পারভিন: এখনই এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্বান্তে আসা কঠিন। যদিও তারা (আরাকান আর্মি) কিছু অংশে সামরিক জান্তাকে হটিয়েছে কিন্তু তাদের রোহিঙ্গাদের প্রতি অবস্থান আগের মতোই অস্পষ্ট। আরাকান আর্মি মূলত আরাকানের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর বাহিনী এবং তারা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কখনোই রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় আন্তরিক ছিল না। বরং রোহিঙ্গা গণহত্যায় তারা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখনও তারা নির্মমভাবে রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে। রাখাইন জনগোষ্ঠী, আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক দল ইউএলএ-এর নিষ্ঠুর ও নির্মম সহযোগিতা ছাড়া মিয়ানমার সরকারও এই ভয়াবহ গণহত্যা চালাতে পারতো না। তাই এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গাদের ফেরা বা স্বীকৃতি পাওয়ার ইতিবাচক সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি না।
বাংলানিউজ: তাহলে রোহিঙ্গাদের কি সহসাই ফেরা হচ্ছে না?
আম্বিয়া পারভিন: না ফেরার মূল কারণগুলো তো এখনো অপরিবর্তিত। মিয়ানমার আমাদের নাগরিকত্ব ও পূর্ণ আইনি অধিকার দিচ্ছে না। নিরাপত্তারও কোনো বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা নেই। রাখাইনে সহিংসতা ও অস্থিরতা এখনও বিদ্যমান। আরাকান আর্মিরও তো মনোভাব একই। এই মূল সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে প্রত্যাবাসন অনিরাপদ ও স্থবিরই থেকে যাবে। একটা কথা সবার মনে রাখা উচিত, আমাদের প্রত্যাবাসন কোনো দান বা দয়া নয়—এটা আমাদের জন্মগত অধিকার।
বাংলানিউজ: আপনি বলছিলেন, ব্যাক চ্যানেলে আরাকান আর্মি বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। এই যোগাযোগের জন্য রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে কি কোনো নির্দিষ্ট নেতৃত্ব রয়েছে?
আম্বিয়া পারভিন: দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের একক বা নির্দিষ্ট নেতৃত্ব নেই। আসলে দীর্ঘদিনের গণহত্যা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা ট্রমা, দেশের বাইরেও রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিভাজন—এসব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব খুবই দুর্বল। এই বিভক্তিই রাজনৈতিক আলোচনায় আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করে।
বাংলানিউজ: তাহলে এখন আপনাদের বা রোহিঙ্গাদের পক্ষে এখন কে বা কারা যোগাযোগের ভূমিকা পালন করছে?
আম্বিয়া পারভিন: আমাদের কমিউনিটির অনেক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও সংগঠক রয়েছে বিভিন্ন দেশে। যেমন ERC, FRC, ARU, BROUCK। আমরা জাতিসংঘের সঙ্গেও কাজ করছি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ বা বৈধ প্রতিনিধি আমাদের নেই। এমনকি উখিয়া ক্যাম্পেও নেই।
বাংলানিউজ: তার মানে প্রত্যাবাসন ইস্যুতেও রোহিঙ্গা সমাজ বিভক্ত যেহেতু বৈধ রাজনৈতিক প্রতিনিধি নেই।
আম্বিয়া পারভিন: বেশিরভাগ রোহিঙ্গা ফিরে যেতে চায়। বিভাজনটা মূলত সময় ও আস্থাকে কেন্দ্র করে। কেউ কেউ নিরাপত্তা ছাড়া ফিরতে চায় না। আবার কেউ কেউ ক্যাম্পের কষ্টের জীবন থেকে যেনতেনভাবে মুক্তি চায়। তবে আমি বলব, আমরা একমুখী, আমাদের উদ্দেশ্য এক। আমরা ঐক্যবদ্ধ না থাকলে কীভাবে আমাদের সমস্যা নিয়ে সবাই একসঙ্গে কথা বলব?
বাংলানিউজ: প্রত্যাবাসন ইস্যুতে এই ভিন্নমত কি আপনাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই আরও বিলম্বিত করছে না?
আম্বিয়া পারভিন: হ্যাঁ, সত্যিকথা বলতে এই ভিন্নমত আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করছে। তবে এই বিভক্তি বা ভিন্নমত ইচ্ছাকৃত নয়—বরং এটা দীর্ঘদিনের নিপীড়নের ফল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ আমাদের নেতৃত্বকে আস্থায় নিলে ও সহযোগিতা করলে আমরা ঐক্য গড়তে পারব।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে একজন হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ দিয়েছে। এই প্রতিনিধি নিয়োগ কি আপনাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনে সহায়ক হতে পারে?
আম্বিয়া পারভিন: এই উদ্যোগ খুবই সম্ভাবনাময় ও ইতিবাচক পদক্ষেপ। যদি তিনি শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ না করে আন্তরিকভাবে রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট সব গূরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলোর মতামত শোনেন তাহলে ইতিবাচক ও টেকসই পরিবর্তন হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা মাঠ পর্যায়ে তার কার্যক্রমের কোনো বিশেষত্ব দেখিনি, যা আমাদের আশান্বিত করবে।
বাংলানিউজ: এই নিয়োগের পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যু তোলা হচ্ছে, এটা তো সত্যি…
আম্বিয়া পারভিন: ওনার আগ্রহ কিছুটা দেখা যাচ্ছে, তবে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ, রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান ও অর্থায়ন ফিরিয়ে আনা, মিয়ানমার ও আরাকান আর্মিকে রাজনৈতিক চাপ দেওয়া—এখন এগুলো প্রয়োজন। যার কোনোটিই হচ্ছে না। আসলে ফোকাস হওয়া উচিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন। এটাই দরকার, যা হচ্ছে না।
বাংলানিউজ: মিয়ানমারের জান্তা ও চীন সরকারের সম্পর্ক গভীর। এ অবস্থায় চীনের ভূমিকা আপনারা কীভাবে দেখেন বা আপনাদের প্রত্যাশা কী?
আম্বিয়া পারভিন: আসলে রাখাইন রাজ্যে চীনের কৌশলগত ও বিপুল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ রয়েছে। চীন স্থিতিশীল রাখাইন চায়, এজন্য তারা মানবাধিকারের চেয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। যদি চীন অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করতো, তাহলে তারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারতো। কিন্তু তা না করায় ও তাদের এই ভূমিকা রাখাইনে উল্টো নেতিবাচক ফল বয়ে আনছে।
বাংলানিউজ: আপনারা কি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা প্রত্যাশা করেন?
আম্বিয়া পারভিন: আসলে ভারত মূলত তাদের প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে বেশি চিন্তিত। তারা কিছু মানবিক সহায়তা দিলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ও ভূমিকা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্র আগে সবচেয়ে বেশি অনুদান ও সাহায্য দিতো। কিন্তু ২০২৫ সালে ট্রাম্প প্রশাসন তহবিল কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গা কাম্পের সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালোভাবে যুক্ত হওয়া দরকার। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসের জন্য জাতিসংঘকে অবশ্যই নেতৃত্ব দিতে হবে। মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মিকে জবাবদিহির পথ তৈরি করতে হবে এবং কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সংকট এখন দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়েছে, অনেকটা এশিয়ার ‘প্যালেস্টাইন সংকট’-এ পরিণত হয়েছে। তাই খণ্ডিত নয়, সবার সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার।
বাংলানিউজ: তাহলে জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহায়তা একেবারে বন্ধ করে দিলে কী হবে বা রোহিঙ্গারা তখন কী করবে?
আম্বিয়া পারভিন: তখন মানবিক বিপর্যয় শুরু হবে। খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
বাংলানিউজ: এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ছাড়াও আসিয়ানভুক্ত অন্য দেশগুলো থেকে সাহায্যের কোনো অগ্রগতি হয়েছে?
আম্বিয়া পারভিন: দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ান অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সাহায্য ও বিভিন্নভাবে কিছুটা সংহতি দেখালেও কূটনৈতিক নেতৃত্ব দরকার। যেটা একেবারেই অনুপস্থিত।
বাংলানিউজ: ওআইসি‘র পক্ষ থেকে…
আম্বিয়া পারভিন: শুধু বিবৃতি দেওয়া হয়। আমরা শক্তিশালী ও কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করি।
বাংলানিউজ: তাহলে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ কী আসলেই নেওয়া হয়নি বা হচ্ছে না?
আম্বিয়া পারভিন: মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, আর্জেন্টিনার মাধ্যমে ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন এবং আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিকে) মামলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফেরার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এটাই দরকার ছিল।
বাংলানিউজ: রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য মানবিক করিডোরের অনুরোধ কী করা হয়েছে?
আম্বিয়া পারভিন: হ্যাঁ। রাখাইনে থাকা কমিউনিটি নেতৃত্ব ও বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন ও সাহায্য সংস্থা বারবার মানবিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করেছে। কিন্তু রাখাইনের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রিত। রাখাইন সম্প্রদায়, আরাকান আর্মির ব্যাপকভাবে রাজনীতিকীকরণের কারণে সেখানে কী হচ্ছে, তা আমরা জানি না। আগের মতোই সেখানে রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরু হয়েছে, এমন খবরও আমরা পাচ্ছি।
বাংলানিউজ: মানবিক করিডোর কি রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়ক হতে পারে?
আম্বিয়া পারভিন: মানবিক করিডোর রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়ক হবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে যদি তা নিরপেক্ষ, নিরাপদ ও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকে তাহলে এর সুফল রোহিঙ্গারা পেতে পারে। তবে এটা যেন দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধানের বিকল্প না হয়ে ওঠে, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট শুধুই মানবিক নয়—এটা রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত। মিয়ানমার সংকট ও রোহিঙ্গা সংকট এবং সমাধান একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাংলানিউজ: যদি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়, রোহিঙ্গারা কী ধরনের রাজনৈতিক অধিকার ও মর্যাদা চায়?
আম্বিয়া পারভিন: আমরা পূর্ণ নাগরিকত্ব, সমান অধিকার ও সাংবিধানিক সুরক্ষা চাই। আমরা স্বায়ত্তশাসন চাই না—আমাদের লক্ষ্য হলো সম্মান, নিরাপত্তা এবং আমাদের জাতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠা।
এমজেএফ