ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ৩০ মে ২০২৫, ০২ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

যে কারণে নির্বাচনী রোডম্যাপ দিচ্ছে না সরকার 

সাগর আনোয়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৫০, মে ২৯, ২০২৫
যে কারণে নির্বাচনী রোডম্যাপ দিচ্ছে না সরকার  প্রতীকী ছবি

চলতি বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচনের দাবিতে অনড় দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বুধবার (২৮ মে) আল্টিমেটাম দিয়ে সরকারকে অনেকটা চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।

এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকেও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল বিএনপি।  

অন্যদিকে সরকারও বার বার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচনের কথা বলছে। সরকারের মতে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই দায়বদ্ধতা শেষ করেই নির্বাচনে যাবেন তারা। সরকারের এমন ঘোষণাতে সমর্থনও রয়েছে জামায়াত, ইসলামপন্থি ও অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া তরুণদের দল এনসিপি’র।  

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির দাবি, সরকার নির্বাচন প্রলম্বিত করতে চায়। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের মতো নির্বাচন ছাড়াই তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছে। সংস্কার নির্বাচন প্রলম্বিত করার বাহানা ছাড়া আর কিছুই না। আর এজন্যই সরকার নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করছে না।  

রাজনৈতিক দলগুলোর এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে জনমনে ধারণা, নির্বাচন কি আদৌ ডিসেম্বরে কিংবা সরকার ঘোষিত ডিসেম্বর থেকে আগামী বছর জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে? এছাড়া নির্বাচনের বাধা কোথায়?  

বুধবার রাজধানী ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মনে হয় এরইমধ্যে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। এরই ভেতরে জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে এবং বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। ’ 

তারেক রহমানের এমন বক্তব্যের কয়েকদিন আগেই সরকার এক প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, শত বাধার মাঝেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সকল কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।  

প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে। অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।  

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের প্রেসবিজ্ঞপ্তির পর তারেক রহমানের বুধবারের কঠোর বক্তব্যে এখন মুখোমুখি অবস্থানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন নির্বাচনপন্থি দলসমূহ এবং সরকার ও সংস্কারের পক্ষে জামায়াত, ইসলামপন্থি ও এনসিপি।  

জনমনেও প্রশ্ন জাগছে- তাহলে বিএনপি কি আবারও ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নামবে? দেশ কী আবারও সংঘাতের রাজনীতিতে ফিরবে?

নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় বাধা কোথায় -এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. খন্দকার রাশেদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘এই সরকার এমন কারো কাছে ক্ষমতা দিয়ে যাবে না যারা ক্ষমতায় বসে এই সরকারের উপদেষ্টাদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলবে। তাছাড়া এই সরকার গঠনের পর সবচেয়ে বড় দাবি ছিল জুলাই গণহত্যার বিচার ও সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। আমার মনে হয়, নিজেদের নিরাপদ প্রস্থান, বিচার প্রক্রিয়ায় সাজা দৃশ্যমান ও সংস্কারের বিষয়ে সকল দলের চূড়ান্ত ঐক্যমত্যের পরেই সরকার নির্বাচনের দিকে যাবে। এর আগে নির্বাচন নিয়ে সরকার ঝুঁকি নেবে না। বিএনপি বড় দল। এখন নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। বিচার ও সংস্কার চূড়ান্তকরণ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এখন যারা সরকারে আছেন তাদের জীবনের ঝুঁকি থাকবে না এমন নিশ্চয়তা কে দেবে? এই ব্যাপারগুলো সুরাহা হলেই সম্ভবত নির্বাচন হবে। ’

জানা গেছে, ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বে সংস্কার কমিটি কয়েক দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে সংস্কার বিষয়ে দলগুলোর অবস্থানও গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে। কমিশন আরেক দফা বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক করছে। শিগগিরই আরেক দফা বৈঠকের পর আগামী জুলাই মাসে জুলাই সনদ ঘোষণা করা হবে।  

সংস্কার কমিশন থেকে পাঠানো সারসংক্ষেপে দেখা যায় - অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি ও অন্যান্য দলের বিপরীতমুখী অবস্থান। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ‘প্রধানমন্ত্রীর দুইবারে’ বিএনপির আপত্তি রয়েছে, নির্বাচন পদ্ধতিতে জামায়াত ও ইসলামপন্থিরা সমানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি দাবি করলেও বিএনপি ‘না’ বলেছে। প্রধানমন্ত্রীর সংসদ নেতা হওয়া নিয়ে অন্যান্য দল আপত্তি তুললেও বিএনপি ‘হ্যাঁ’ বলেছে। বিভিন্ন দল সংখ্যানুপাতিক উচ্চকক্ষের দাবি জানালেও বিএনপি ‘না’ বলেছে। এছাড়া জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন, নারী আসনে সরাসরি  ও সংবিধান সংশোধনে গণভোটেও বিএনপি আপত্তি জানিয়েছে। এছাড়া বর্তমান কমিশন প্রণীত সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য জামায়াত, ইসলামি দলসমূহ গণভোট ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি গণপরিষদের দাবি জানালেও বিএনপি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদের ওপর ভরসা রাখার কথা বলেছে।  

এছাড়া হ্যাঁ, না পদ্ধতির এই সংস্কার প্রক্রিয়ার পদ্ধতি নিয়েও আপত্তি রয়েছে বিএনপির। তারা বলছে, তাদের ঘোষিত ৩১ দফার আলোকে সংস্কার করা হবে। আর জনগণের ম্যান্ডেট একমাত্র নির্বাচিত সংসদ। সেখান থেকেই সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এমন পরিস্থিতি গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া তরুণদের মনে ভয় ও সংশয় কাজ করছে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সরকার ঘোষিত সংস্কার প্রক্রিয়া ও বিচারিক কার্যক্রম চলমান না রাখলে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তারা তাদের দলের প্রতিনিধিও সংসদেও দেখতে চায়। এজন্য তাদের দল এনসিপির বিভিন্ন আসনে জয়ের নিশ্চয়তা, সংস্কার ও বিচারের পর তারা সরকারকে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় দেখতে চায়।  

এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাকিল আহমাদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেশে তো সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশই নেই। নির্বাচন কমিশনও নিরপেক্ষ নয়। এই কমিশন স্বৈরাচার হাসিনার ফ্যাসিবাদী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে। এই নির্বাচন কমিশন, সার্চ কমিটির সুপারিশের আগেই গঠন করা হয়েছে। কাজেই জাতীয় বা যেকোনো নির্বাচনের আগে বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে, জুলাই শহীদদের হত্যার বিচার করতে হবে, সংস্কার ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের পর আমরা নির্বাচন চাই। ’

তিনি আরো বলেন, ‘এই সরকার তো শুধু নির্বাচনের জন্য নয়। সংবিধানে লেখা, ৯০ দিনের পূর্ববর্তী সময়ের মধ্যে শিডিউল ঘোষণা করতে হবে। এখন শিডিউল বা রোডম্যাপ ঘোষণা করলে তা হবে সংবিধানের লঙ্ঘন। তাই এখন এমন ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ নেই। ’ 

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, ‘সরকার কেন রোডম্যাপ ঘোষণা করছে না সেটা সরকারই ভালো জানে। তবে সরকার রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে সরকারকে সহযোগিতা করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। আমরা এখনই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামছি না। তবে, ভবিষ্যতে নামবো না তাও বলছি না। ’  

জনগণের এমন উদ্বেগ আর দোলাচলে দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে বাড়তি সন্দেহ সৃষ্টি করেছে ইউএনডিপি ও নির্বাচন কমিশন স্বাক্ষরিত গতকালের (বুধবার) একটি চুক্তি। এদিন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে,  সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে একসঙ্গে কাজ করবে। এজন্য  তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প ‘ব্যালট’ নেওয়া হয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।