ঢাকা, রবিবার, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৫ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

এক বছরে আর্থিক খাতের দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে: ড. জাহিদ হোসেন

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৫৭, আগস্ট ৮, ২০২৫
এক বছরে আর্থিক খাতের দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে: ড. জাহিদ হোসেন ড. জাহিদ হোসেন

আর্থিক খাতের সবচেয়ে দুর্দশার মধ্যেই দায়িত্ব নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর কেটে গেছে এক বছর।

ব্যাংক খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ এরইমধ্যে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব উদ্যোগ প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছে, তা নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট জাফর আহমদ

বাংলানিউজ: আর্থিক খাত নিয়ে অনেক সমালোচনা ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর দায়িত্বকালে ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলো আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

জাহিদ হোসেন: ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি সংস্কার দেখা গেছে। একটি আতঙ্ক ছিল এতগুলো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক নিয়ে আর্থিক খাতের ওপর মানুষ আস্থা রাখবে কীভাবে! সেখানে অনেকগুলো ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে গঠন করা হলো। তারপর তারল্য সহায়তা দেওয়া হলো। আইন সংস্কার করা হলো, যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা কেমন তা বের করা যায়। ছয়টি ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি নির্ণয় করা হলো। আরও ১১টি ব্যাংকের করা অ্যাসেট কোয়ালিটি নির্ণয় করা হবে।

নিষ্পত্তির কোনো মডেল এখনো সামনে আনা যায়নি। যে ছয়টি ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে, এর মধ্যে একটি বাদ। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে যেহেতু বিদেশি বিনিয়োগ আছে, সেটি বাদ দিয়ে বাকি পাঁচটি একীভূত করা হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। সেটি ব্যাংক রেগুলেশন অর্ডিনেন্স (বিআরও) বাস্তবায়ন করবে। তারা বলছে, আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে একটি মডেল দাঁড় করানো যাবে।

অন্যদিকে রেগুলেশনের ক্ষেত্রেও এনপিএল (নন-পারফরমিং লোন বা খেলাপি ঋণ), রিকগনিশন ক্রাইটেরিয়া এসব বদলেছে। ২০১৯ সালে যেটি শুরু করে পিছিয়ে যাওয়া হয়েছিল, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ৯০ দিনে সেটি ক্রাইটেরিয়ায় চলে এসেছে। কমপ্লায়েন্সটা উন্নত করার জন্য প্রভিশনে কিছু সরলীকরণ করা হয়েছে। আরও একটি সার্কুলার হয়েছে, ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত রিপোর্ট করতে হবে— আসলে বেনিফিশিয়ারি কারা। আর যারা রিলেটেড পার্টি, ব্যাংকের মালিকানা সম্পর্কিত, তাদের কত ঋণ দিতে হবে তার একটি সীমা আছে। এসব অনুসরণ করতে হবে।

বাংলানিউজ: সংস্কার কার্যক্রম চলছে। এই কার্যক্রম কতটা আস্থা তৈরি করতে পেরেছে?

জাহিদ হোসেন: দেখুন, এক বছরের চার মাস শুধু ঘর গোছাতে চলে গেছে। অনেক ব্যাংকের মালিক নিজে পালিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হাওয়া হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রেসিডেন্ট নেই। এই সব প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা যদি বিবেচনায় আনি, তাহলে দেখব এই সরকার আসলে সময় পেয়েছে সাত-আট মাস। গত ১০ বছরে কোনো সংস্কার তো করা হয়ইনি বরং উল্টো পথে চলেছে। সেদিক থেকে বলব সরকারের উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ফিনিশিং লাইনে পৌঁছাতে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে।

আর এই সরকারের সময়ে সব কাজ সম্পন্ন হবে বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকার যে অবস্থায় পেয়েছিল, তা ছিল অনেক ভঙ্গুর; পরবর্তী সরকার অনেক বেটার অবস্থায় পাবে। কিন্তু তাদেরও অনেক কাজ করতে হবে। এখানে করপোরেট সুশাসন নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হবে। এই সরকার শুরু করেছে। শুরুটা ধরে রেখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই হবে তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ খেলাপি ঋণের পরিমাণ তো বাড়ছে।  
আগে খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হতো— এখন তথ্যগুলো বেরিয়ে আসছে। এগুলোর পাশাপাশি নতুন সার্কুলার জারি হয়েছে। এখন থেকে ঋণ ৯০ দিন পরই খেলাপিতে ঢুকে যাবে। কাজেই আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমার ধারণা খেলাপি ঋণের অংকটা বাড়তেই থাকবে। তারপর বোঝা যাবে নতুন খেলাপি যোগ হচ্ছে কি না, আসলে খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি ঘটছে কি না।

বাংলানিউজ: তারপরও আস্থার জায়গা তৈরি করছে। সেটি কীভাবে দেখছেন?

জাহিদ হোসেন: তা করছে। কিন্তু ১৫ থেকে ২০টি ব্যাংক একেবারে দেউলিয়া। আমি কিন্তু শুধু ব্যাংকের কথা বলছি। নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও খারাপ। এই ব্যাংকগুলোকে একটা না একটা সমাধানের পথে নিয়ে যেতেই হবে। হয় এগুলোকে অন্যটির সঙ্গে একীভূত করতে হবে, না হয় কোনো বিনিয়োগকারী আগ্রহী থাকলে বিক্রি করে দিতে হবে।

সব ব্যাংকেরই মূলধনের ঘাটতি আছে, সবারই তারল্য সমস্যা। একীভূত করা হবে নাকি বিক্রি করে দেওয়া হবে, নাকি সরকার নিয়ে নেবে, নাকি বন্ধ করে দেবে, অবসায়নের দিকে যাবে— ব্যাংক রেগুলেশন অর্ডিনেন্সে বিভিন্ন অপশনের কথা বলা আছে। কোনটির ক্ষেত্রে কোনটি প্রযোজ্য হবে, সেটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যে কাজগুলো হয়েছে সেগুলোতে রেগুলেটরি সংস্কার হয়েছে। এই যে সিএল, প্রভিশনিং— এসবের বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে।  

প্রস্তুতিমূলক কাজ ছাড়া নিষ্পত্তির কোনো কাজে যাওয়া যায়নি। বিশেষ করে এসব দুর্দশাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। অবশ্য এটি অল্প সময়ে মধ্যে সম্ভবও না। বিশ্বব্যাংক বলছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খারাপ। এগুলোও ভবিষতে দেখার বিষয়।

বাংলানিউজ: রিজার্ভ, ডলারের বিনিময় হার এবং আমদানির ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। এই পরিবর্তনকে কীভাবে দেখছেন?

জাহিদ হোসেন: এগুলো দৃশ্যমান এবং উন্নতি দেখা যাচ্ছে। ডলারের বাজারে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ছিল, সেখানে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এখন এই উন্নতি দুটো দিক থেকে দেখতে পারেন। তার একটি হলো, মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা, দ্বিতীয়টি হলো বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ডলারের মজুত বেড়েছে। বিনিময় হার স্থিতিশীল আছে।

এই যে উন্নতি— এর পেছনে দুটো ইতিবাচক কারণ আছে, আর একটি নেতিবাচক কারণ আছে। সবচেয়ে ইতিবাচক হলো রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন। রেমিট্যান্সের কথা ধরুন, আগে ১৭০ থেকে ১৮০ কোটি ডলার এলেই ধরে নেওয়া হতো ভালো হয়েছে। এখন ২৫০- কোটি ডলারের নিচে গেলেই ভাবা হয় এবার ভালো হয়নি। মানে রেমিট্যান্সের স্তরটা উঠে গেছে। দ্বিতীয়টি হলো, ১৫ দিন বা ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় চলে আসছে। এই দুটি হলো ইতিবাচক। তার মানে জোগানটা বেড়েছে। গত জুন মাসে এককালীন যোগান এসেছে; বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের দুই কিস্তি ছাড় হলো, এডিবি থেকে ডলার যোগ হলো। সব মিলিয়ে ৩৫০ কোটি ডলার গত জুন মাসে যোগ হয়েছে। এটি হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ ছাড় হওয়ার কারণে।

এক্ষেত্রে যোগানটা বেড়েছে, চাহিদা কিন্তু দুর্বল। এটি একটি নেতিবাচক দিক। মানে বিনিয়োগের স্থবিরতা। বিনিয়োগ স্থবির বললেও বোধ হয় কম বলা হবে। কারণ ঋণপত্র নিষ্পত্তি, ঋণপত্র খোলা ইত্যাদি নেতিবাচক। এর অর্থ হলো আগের বছরের তুলনায় কম। এর কারণে ডলারর চাহিদাও দুর্বল। এটিও ডলারের মজুত বেড়ে যাওয়া, বিনিময় হারে স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখছে।

বাংলানিউজ: রেমিট্যান্সের এই যে উল্লম্ফন, এর কারণ কী? পাচার কমে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেজন্য?

জাহিদ হোসেন: হ্যাঁ। বিশেষ করে রেমিট্যান্সের এই যে উল্লম্ফন, এর পেছনে অন্য কোনো ব্যাখ্যা খাটে না। এমন তো না যে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের আয় বেড়ে গেছে হঠাৎ করে, বা ব্যয় কমে গেছে, সেজন্য সঞ্চয় বেড়ে গেছে।  আর তারা দেশে বেশি টাকা পাঠাচ্ছে— বিষয়টি এমনও নয়। সংখ্যাস্ফীতি যেটা ঘটেছে, সেটা তো কোভিডের পর থেকেই ঘটেছে। রেমিট্যান্সে কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। তার মানে প্রবাসীদের ডলার বর্ডার ক্রস করত না। প্রবাসীরা ডলার পাঠাত না, এমন না।  হুন্ডির মাধ্যমে সেই লেনদেনটা হতো। কাজেই পরিবর্তনের পরে বড় বড় পাচারকারীরা নিজেরাই পাচার হয়ে গেছে। এর ফলে হুন্ডি-পাচারে বড় মন্দা এসেছে। এখন একটা শঙ্কাও থেকে যায়। আগামীতে নতুন খেলোয়াড় এসে পুরাতন খেলা শুরু করবে কি না। তাহলে এই স্বস্তিটা থাকবে না।

বাংলানিউজ: এসব নিয়ে তো এখন আলোচনা শুরু হয়েছে।

জাহিদ হোসেন: কিছু ক্ষেত্রে পুরোনোরা সরে গেছে, কিন্তু তাদের জায়গা নিতে নতুনদের খুব বেশি সময় লাগেনি। তবে পাচারের ক্ষেত্রে পুরোনোদের জায়গা নিতে সময় লাগে। ‘রেজিম চেঞ্জ’ হতে কিছুটা সময় লাগবে। যেটা ঘাটে-মাঠে হয়, সেটা ছোটখাটো বিষয়। কিন্তু বড় ধরনের পাচার আন্তর্জাতিক বিষয়— এগুলো বদলাতে সময় লাগে। এগুলো রাঘব বোয়ালদের কাজ। আসলে কী হয়, সেটা দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

বাংলানিউজ: সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনের পর নতুন সরকার আসবে, রাজনৈতিক সরকার আসবে। তখন এই সংস্কার ধাক্কা খাবে কি না, এক্ষেত্রে কী পরামর্শ দেবেন?

জাহিদ হোসেন: নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে, তারা তো অন্তর্বর্তী সরকার যে অবস্থায় দায়িত্ব নিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় পাবে। সব জায়গায় প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর, প্রতিষ্ঠানগুলো মাথাবিহীন, রাস্তায় অস্থিরতা, প্রতিদিন আন্দোলন। নির্বাচনের পর নতুন সরকার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে না।  নতুন সরকারের কাছে শুধু এসব কাজ নয়, যেগুলোতে হাত দেওয়া যায়নি, সেগুলোও সহজ হওয়ার কথা। যদিও চ্যালেঞ্জ থাকবে, সদিচ্ছা সক্রিয় থাকবে কি না, তা নতুন সরকারের ভিশনের ওপর নির্ভর করবে।

জেডএ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।