দেশের আদালত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে গিয়ে আইন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলার বিচারের জন্য পৃথক আদালত গঠন করেছে। তবে অধিকাংশ জেলায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল সংকটের কারণে এ উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের জারি করা গেজেট অনুযায়ী, সারা দেশে ২০৩টি অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত ও ২৬৭টি যুগ্ম দায়রা জজ আদালত নতুনভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে একই বিচারককে আর দেওয়ানী (জমিজমা, মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ) ও ফৌজদারি (দণ্ডযোগ্য অপরাধ) উভয় ধরনের মামলার বিচার করতে হবে না।
আইন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রায় ৩৯ লাখ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। এর মধ্যে ২৩ লাখ ফৌজদারি ও ১৬ লাখ দেওয়ানী মামলা রয়েছে। আগামী ৬০ দিনের মধ্যে বিদ্যমান আদালত থেকে নতুন প্রতিষ্ঠিত আদালতগুলোতে ফৌজদারি মামলা স্থানান্তর করা হবে।
তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। দেশের অনেক জেলাতেই নতুন আদালত পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ভবন, এজলাসকক্ষ ও সহায়ক জনবল নেই।
ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী মো. হাবিবুর রহমান বলেন, জেলায় দুটি পৃথক আদালত ভবন রয়েছে। একটি জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং অপরটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন। কিন্তু কোথাও নতুন এজলাস স্থাপনের মতো জায়গা নেই। নতুন বিচারকরা কোথায় বসবেন, খাস কামরা বা সেরেস্তা কোথায় হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
গাজীপুরের চিত্রও একই। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট নাবিল আশিক বলেন, গাজীপুরে অনেক বিচারককে এজলাস শেয়ার করে বসতে হয়। এমনকি জেলা প্রশাসক ভবনের কক্ষেও আদালত পরিচালিত হচ্ছে। মহানগর দায়রা জজ পর্যন্ত অন্য একজন বিচারকের সঙ্গে এজলাস ভাগ করে নেন। এতে বিচারকাজ ব্যাহত হয়, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তিও বাড়ে।
তিনি আরও বলেন, এজলাসকক্ষে জায়গা এতটাই কম যে অনেক সময় আইনজীবীদের বসার বেঞ্চও থাকে না। অবকাঠামোগত সংকট দূর না করে নতুন পদায়ন করে কার্যকর ফল পাওয়া সম্ভব নয়।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ নজরুল ইসলামও একই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পৃথক আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি ইতিবাচক। কিন্তু ঢাকায় ৪৪টি নতুন আদালত স্থাপন করা হলেও স্থান সংকট ভয়াবহ। বর্তমানে যেসব আদালত চলছে, সেগুলোর স্থানই যথেষ্ট নয়। নতুন ভবন নির্মাণ ও সহায়ক জনবল নিয়োগ ছাড়া এ উদ্যোগ টেকসই হবে না।
তিনি আরও বলেন, আদালতপাড়ার আশপাশের সরকারি জমিগুলোর লিজ বাতিল করে নতুন ভবন নির্মাণ জরুরি। একজন বিচারক যদি অন্যের সঙ্গে এজলাস শেয়ার করে বসেন, তবে কর্মঘণ্টা বাড়বে না। ফলে মামলাজটও কমবে না।
তবে অনেকেই এ উদ্যোগকে সময়োপযোগী বলে মনে করেন। ঢাকার অভিজ্ঞ দেওয়ানী মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালত পৃথক করা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতে বিচারকরা নির্দিষ্ট ধরনের মামলায় মনোযোগ দিতে পারবেন। ফলে মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়বে এবং বিচারপ্রার্থীরা উপকৃত হবেন।
আইন মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন আদালতগুলো চালুর মাধ্যমে বিচারব্যবস্থায় গতি আসবে। তবে মাঠপর্যায়ের আইনজীবীরা মনে করছেন, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি ছাড়া এ উদ্যোগ কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যেতে পারে।
কেআই/এজে