ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্যাংকিং

ঋণের নামে বিশ্বব্যাংকের পুকুর চুরি!

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
ঋণের নামে বিশ্বব্যাংকের পুকুর চুরি!

ঢাকা: ঋণ দেওয়ার পর  ‌নানা কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। আবার ‌ঋণের টাকার মধ্যে প্রকল্পের কোন খাতে কতো টাকা ব্যয় করা হবে এসবও নির্ধারণ করে দিচ্ছে সংস্থাটি।

বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বিশেষত পরামর্শক সেবা খাতে এবং নিজেদের নির্ধারিত ঠিকাদারদের দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের মাধ্যমে ঋণের টাকার বড় অংশ চলে যাচ্ছে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের পকেটেই। অথচ সুদাসলে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকেই।     

এটিকে ঋণের নামে ‘পুকুর চুরি’ বলছেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন প্রকল্পে ঋণ দিলেও নানা কৌশলে সংস্থাটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।  

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে ২ হাজার ৮৮৯ কোটি ৫ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। অথচ প্রকল্পের কোন খাতে কতো টাকা ব্যয় করা হবে সবই নির্ধারণ করছে নিজেরাই। প্রকল্পের পরামর্শক সেবা খাতে ৩৭৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। এ খাতের সব টাকাই যাবে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের পকেটে।

প্রকল্পের আওতায় ৩০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নৌ-পথ পারফরমেন্স বেজড কন্ট্রাক্টের (পিবিসি) মাধ্যমে ড্রেজিং করা হবে। প্রচলিত পদ্ধতির ড্রেজিংয়ের পরিবর্তে পিবিসি’র মাধ্যমে ডেজিংয়ের যৌক্তিকতা নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ ড্রেজিংয়ের পরিমাণ (ঘনমিটার) ক্রয় পরিকল্পনা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) উল্লেখ নেই।

অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের অধিকাংশেই ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হয় না। সেক্ষেত্রে লিস্ট অ্যাভেলেবল ডেপথ অর্জনের আওতায় মনগড়া ব্যয় দেখিয়ে প্রকল্প থেকে অর্থ তুলে নেবে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের একটি অংশে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে তারও কোনো ভিত্তি নেই।

প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌ-করিডোরে ৩০০ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হবে। অথচ প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি না করে নামকওয়াস্তে সার্ভে করেই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। নামকওয়াস্তে সার্ভে করতেও ৩২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংস্থাটি। চারটি প্যাকেজে প্রকল্পের ভৌত কাজ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্যাকেজ-১ এ পিবিসি ড্রেজিংয়ের আওতায় নদী খনন করা হবে। এ ধারণা বাংলাদেশের জন্য প্রথম। এতে করে প্রকল্পটিতে দেশীয় কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে না। বাধ্য হয়ে বিদেশি কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৬শ’ কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পিবিসি ড্রেজিংয়ের অর্থ হচ্ছে ৩০০ কিলোমিটার জুড়ে নৌ-চলাচলের উপযোগী করা। ৩০০ কিলোমিটার নৌ-পথের অনেকাংশেই ড্রেজিং করা লাগবে না। তারপরও গড় ড্রেজিং হিসাব দেখিয়ে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাকা উঠিয়ে নেবে। এতে করে কাজ না করেও ঋণের টাকা যাবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পকেটে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হলে সকল শাখায় তদারকি করবেন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি। এতে করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদারকি করার কোনো সুযোগ থাকবে না। অথচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুদাসলে টাকা পরিশোধ করতে হবে নৌ-মন্ত্রণালয়কেই।

ঋণের টাকা নানা অজুহাতে হাতিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে নানা অহেতুক সাইডও আবিষ্কার করেছে বিশ্বব্যাংক। ক্রয় পরিকল্পনায় ২১টি প্যাকেজে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, ১১টি প্যাকেজে ব্যক্তি পরামর্শক এবং দু’টি প্যাকেজে নন কনসালটিং সার্ভিস হিসেবে সর্বমোট ৩৫টি সেবা প্যাকেজে ৩৭৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকার ক্রয় প্রস্তাব করা হয়েছে। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।

প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা নেওয়া হবে। ঋণ সহায়তায় বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত বিনিয়োগ প্রকল্পের পরামর্শকের জন্য ১২ দশমিক ১০ শতাংশ ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে জানান অর্থনীতিবিদেরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা এবি আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘কোনো প্রকল্পে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ পরামর্শক ব্যয় আদৌ প্রয়োজন পড়ে কি? এ বিষয়ে সরকারের উচিত, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নেগোশিয়েট করা। আগেও আমরা নৌ-পথ খনন করেছি। তখন কতো কোটি টাকা পরামর্শক খাতে ব্যয় করেছি তা খতিয়ে দেখতে হবে। তবে এতো টাকা পরামর্শক খাতে ব্যয় হওয়ার কথা নয়’।

পিবিসি ড্রেজিং পদ্ধতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে আগে ক্রাইটেরিয়া ঠিক করতে হবে। তা না হলে ঋণের টাকার অপচয় হবে। কতোটুকু খনন করতে হবে, কতো ঘনমিটার মাটি কাটতে হবে তার একটা প্রাক্কলন প্রয়োজন। ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে অপচয় হবে। কারণ, সব ড্রেজিং সমান না। নৌকা চলাচলে এক ড্রেজিং, বড় জাহাজ চলাচলে অন্য ড্রেজিং এবং কার্গো চলাচলে আবার ভিন্ন ড্রেজিং করতে হবে। সুতরাং, ধারণা নয়, আগে মানদণ্ড ঠিক করেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে’।

প্রকল্পের অধীনে ৩৬ জন জনবলের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ বিভাগের ধরন ও সংখ্যা নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ ডিপিপি’তে সংযোজন করা হয়নি। ৯০ কোটি টাকা ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ সংস্থান রাখা হলেও এর স্থান ও পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। অথচ ডিপিপি প্রক্রিয়াকরণ পরিপত্র অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্থান নির্বাচনসহ ডিসি অফিসের ব্যয় প্রাক্কলন এবং প্রাক্কলনের তারিখ ডিপিপি’তে সংযোজন করা প্রয়োজন।

অন্যদিকে নতুন ধারণা ভিত্তিক প্রকল্পের সময় অহেতুক বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৮ বছর। অথচ এমন একটি প্রকল্প ৪ বছরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। প্রকল্পটির আওতায় ক্যাপিটাল ও মেইনটেনেন্স ড্রেজিং করা হবে। এ কাজকে পৃথক করা হলে প্রকল্পের সময় হ্রাস পাবে।

বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের অধীনে সার্ভে ভেসলে ৭০ দশমিক ৪০ কোটি টাকা, মাল্টি-বিম ইকো সাউন্ডারে ২৬ দশমিক ৪০ কোটি টাকা, লিডার সার্ভে ইক্যুইপমেন্টে ১৭ দশমিক ৬০ কোটি টাকা, বাসা ভাড়ায় চার কোটি টাকা, বিজ্ঞাপনে তিন কোটি টাকা, সেমিনারে এক কোটি টাকা, ট্রেনিংয়ে সাড়ে ৩ কোটি টাকা এবং মডার্ন টিচিং খাত বাবদ ৩৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করেছে। অথচ কিসের ভিত্তিতে এ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে তা জানাতে পারেনি সংস্থাটি।

প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩ হাজার ৯৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা দেবে ২ হাজার ৮৮৯ কোটি ৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের সার্বিক উদ্দেশ্য হচ্ছে- অগ্রাধিকারমূলক নৌ-রুট চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ করিডোরে সুষ্ঠু ও নিরাপদ যাত্রীবাহী, পণ্যবাহী অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সার্ভিস বৃদ্ধি করা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল এবং ভোলা জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। নৌ-পরিবহন রুট সহজ ও পরিবেশবান্ধব করতেই এ উদ্যোগ।

প্রকল্পের আওতায় ছয়টি স্থানে জাহাজের জন্য বড় আশ্রয়কেন্দ্র, একটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ও একটি কার্গো টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। ১৪টি ল্যান্ডিং স্টেশনও নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্পের নানা অঙ্গ বিশ্বব্যাংকের চাহিদার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। তবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে আলোচনা করেই ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-প্রধান (পরিকল্পনা) এনায়েত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংক বড় ধরণের ঋণ দিলেও আমরা যৌথভাবেই প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করছি। আমাদের সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তেই প্রকল্পটি বাস্তাবায়ন করা হচ্ছে’।

পারফরমেন্স বেইজড কন্ট্রাক্ট (পিবিসি) ড্রেজিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা নতুন ধারণা। এর আগে আমরা ক্যাপিটাল ড্রেজিং করেছি। দেখা যাক এ পদ্ধতিতে কেমন হয়? তবে পিবিসি ড্রেজিং ভালোই হবে। কারণ, এটা শুধু ড্রেজিং না, সংরক্ষণও বটে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
এমআইএস/বিএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।