ঢাকা: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ৫০২ কোটি টাকা সীমার অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংক লিমিটেড।
অভিযোগ রয়েছে, অনৈতিকভাবে ‘মাদার টেক্সটাইল’কে এই ঋণ সুবিধা দেওয়ায় ব্যাংকটির স্থানীয় শাখার কয়েকজন কর্মকর্তার হাত রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটি মাদার টেক্সটাইলকেই ৬৭২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ফান্ডেড ঋণ বিতরণ করেছে, যা মোট মূলধনের ৫৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাদার টেক্সটাইলের কাছে ব্যাংকের পাওনা ছিলো ৭৪১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) প্রজ্ঞাপনে (ফেব্রুয়ারি ২০১৪) বলা আছে, গ্রহীতার একক ঋণসীমা হবে মূলধনের ৩৫ শতাংশ। যার মধ্যে ফান্ডেড ঋণ হবে ১৫ শতাংশ, নন ফান্ডেড হবে ২০ শতাংশ। সে অনুযায়ী, মাদার টেক্সাটাইলের ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ হয় ১৭০ কোটি ৫৫ লাখ। রূপালী ব্যাংক অতিরিক্ত দিয়েছে ৫০২ কোটি ১ লাখ টাকা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে এসব অনিয়মের চিত্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদ বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপন আমলে না নিয়ে এভাবে ঋণ বিতরণ করে গুরুতর অনিয়ম ও বিআরপিডি’র নিদের্শনা লঙ্ঘন করেছে।
কেবল গ্রহীতার একক সীমার অতিরিক্ত ঋণ বিতরণই নয়, মাদার টেক্সটাইলের মালিক সুলতান আহমেদকে ঋণ বিতরণে আমানতের ঘাটতি, তিনবারের বেশি সময় ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস পার্টনারশিপ (আইবিপি) ও ওভার ড্রাফট সুবিধাও দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
রূপালী ব্যাংককে ভবিষ্যতে গ্রহীতার একক ঋণসীমা অতিক্রম না করে এবং ঋণ বিতরণের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদার টেক্সটাইলের ঋণ বিতরণে জামানত নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। জরিপ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ২৫শ’ শতাংশ জমি ও মিলের যন্ত্রপাতি একত্রে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫৯৪ কোটি টাকা।
২০১৩ সালের ১ এপ্রিল জারি করা রূপালী ব্যাংকের শিল্প ঋণ ইশতেহার অনুযায়ী, গ্রাহকের বা প্রতিষ্ঠানের নিরুঙ্কুশ মালিকানাধীন সম্পত্তির ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ হবে সম্পত্তির তাৎক্ষণিক বিক্রি মূল্যের ৭৫ শতাংশ এবং যৌথ বা তৃতীয় পক্ষের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ।
হিসাব মতে, ৭৪১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে জামানতের ঘাটতি রয়েছে ২৯৬ কোটি টাকা। জামানত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ইশতেহার লঙ্ঘন করেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মাদার টেক্সটাইলের ঋণটি ২০০৯, ২০১১, ২০১৩ পুনঃতফসিলিকরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহকের কাছে পাওনা ৬৩৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ২০২২ ও ২০৩০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুনঃতফসিলিকরণ অনুমোদন করা হয়েছে।
পুনঃতফসিলিকরণের শর্ত মোতাবেক ঋণ গ্রহীতা ডাউন পেমেন্টের ৩১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করবে।
এছাড়াও ৬৩৪ কোটি টাকার মধ্যে ২৪০ কোটি ২০১৭ সালে ১ জানুয়ারি, ১২৪ কোটি টাকা ২০২৩ সালে ১ জানুয়ারি, ২৭০ কোটি টাকা ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধের সময় পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন করেছে। এতে ঋণ আদায়ের ধীরগতি হয়েছে।
পুনঃতফসিলি করে যে হারে ডাউন পেমেন্টের কিস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা আদায় হলে বছরে ঋণ স্থিতির মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ আদায় হবে। উক্ত ঋণ স্থিতির বিপরীতে সুদের চেয়েও যা অনেক কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইবিপি’র ১৩টি দায় বকেয়া থাকার পরও আর্ন্তজাতিক বিভাগের ইশতেহার লঙ্ঘন করে ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার আইবিপি সুবিধার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইবিপি’র অনুকূলে মাদার টেক্সটাইলের বকেয়ার পরিমাণ ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
রূপালী ব্যাংকের ‘কর্মকর্তাদের অর্পিত ক্ষমতা তফসিল ২০১২’ অনুযায়ী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্ষমতাবর্হিভূতভাবে ১০ কোটি টাকার জামানতবিহীন সাময়িক ওভারড্রাফট (ওডি) অনুমোদন করেছেন। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাদার টেক্সটাইলের ওডি হিসাবে বকেয়ার পরিমাণ ৮ কোটি ১ লাখ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসের শেষে রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা, যা জুনে ছিলো ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ ৬৬৮ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে মাদার টেক্সটাইলের মালিক সুলতান আহমেদ বলেন, “শোনেন, আমি লঞ্চের ডেকে বইয়া বরিশাল থেইক্কা ঢাকায় আইছি। অনেক কষ্ট কইরা এই মিল করছি। এ জন্য ব্যাংক থেকে লোন নিছি। টাকা ফেরতও দিতেছি। ব্যাংকের টাকা মারার কোনো ইচ্ছা আমার নাই। আস্তে আস্তে সব দিয়ে দিমু”।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ছোট গোবিন্দপুর এলাকায় ৩৫ বিঘা জমির উপর ১৯৯২ সালে সুলতান আহমেদ ‘মাদার টেক্সটাইল’ স্থাপন করেন। ১৯৯৪ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে আর্ন্তজাতিক মানের সুতা উৎপাদন শুরু করে। রূপালী ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময় ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সময় মতো টাকা ফেরৎ দিতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, মাদার টেক্সটাইল আমাদের অনেক পুরোনো গ্রাহক। ঋণটি নিয়মিত রেখে আমরা চেষ্টা করছি টাকা আদায় করতে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৬
এটি