ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ব্যাংকিং

শর্তের বেড়াজালে প্রণোদনা প্যাকেজ, বাস্তবায়ন নিয়ে ধোঁয়াশা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২০
শর্তের বেড়াজালে প্রণোদনা প্যাকেজ, বাস্তবায়ন নিয়ে ধোঁয়াশা

ঢাকা: করোনা ভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবাখাতের প্রতিষ্ঠানসমূহকে চলতি মূলধন বাবদ ঋণ-বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের উপকারভোগীদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা জারি করেছে, তাতে ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা নির্ধারণের শর্তগুলোর কারণে বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখতে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণের ও ব্যাংকগুলোতে থাকা সরকারি আমানতের সুদ মওকুফ করার দাবি উঠেছে।

প্রণোদনা তহবিল থেকে বর্তমান ঋণ খেলাপিরা, অতীতে তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করা প্রতিষ্ঠান কেন ঋণ পাবে না এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অদক্ষতার কারণে নীতিমালাটি সার্বজনীন হয়নি।

এছাড়াও রয়েছে সুশাসনের অভাব। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরামর্শ না নেওয়ায় প্যাকেজ বাস্তবায়ন হবে না। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা সুবিধা পাবে না। যাদের সঙ্গে ব্যাংকের যোগাযোগ ভালো তারাই সুবিধা পাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো খেলাপিকে ঋণ প্রদান করা যাবে না। কিন্তু খেলাপি হওয়ার সময় উল্লেখ করা হয়নি। এতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেমন কোনো প্রতিষ্ঠান ১০ বছর ধরে ভালোভাবে ব্যবসা করে আসছে এবং ঋণও পরিশোধ করেছে নিয়মিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কারণে খেলাপি হয়ে গেছেন তাদের জন্য কী পদক্ষেপ থাকবে সেটা উল্লেখ করা হয়নি।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কীভাবে চিহ্নিত করা হবে সে বিষয়েও বিশদ কিছু উল্লেখ না থাকায় বিষয়টি ব্যাংকগুলোর জন্য জটিল প্রক্রিয়া বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও কোনো কোম্পানি তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করে থাকলেও ঋণ সুবিধা পাবে না। এখন তিনবার বলতে কখন বা কত বছরে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় উল্লেখ নেই। পাঁচ বছর আগে যদি তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করে কিন্তু এখন অনেক ভালো প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা করছে তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা রয়েছে সেটাও কেউ বলতে পারছে না। যদিও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় প্রণোদনার কথা বলা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, নীতিমালা করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দু-একজন বিশ্লেষকের পরামর্শ নিতে পারতো। অথবা নীতিমালা করার‌ জন্য একটি প্রতিষ্ঠানেকে নিয়োগ দিতে পারতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক ঘাটতি আছে। এটা কোনো কথা হলো, একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা এক সময় খারাপ হতেই পারে। তখন সে খেলাপি ছিল। এখন তো ভালো করছে। তাহলে সে কেন ঋণ পাবে না?

নীতিমালায় বলা হয়েছে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত  যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ঋণের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল স্থিতির সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নতুন ঋণ সুবিধা প্রাপ্ত হবে। এক্ষেত্রে ফানডেড ও নন ফানডেড ঋণের স্থিতির ওপর সবটুকু ফানডেড নেওয়া যাবে কি-না তা উল্লেখ করা হয়নি।

অন্যদিকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থিতির ওপর নতুন ঋণ প্রদানের বিষয়টি নিয়েও বেশ জটিলতা রয়েছে। কারণ ৩১ ডিসেম্বর প্রত্যেকটি ব্যাংক বার্ষিক আয়-ব্যয় ও মুনাফার চূড়ান্ত হিসাব করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক তাদের প্রত্যেক গ্রাহককে দায়-দেনা সমন্বয় করার জন্য তাগিদ দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা সমন্বয় করেন। তাই বেশিরভাগ গ্রাহক ওই ঋণ সমন্বয় করলেও পুনরায় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে জানুয়ারি মাস থেকে লিমিটের আওতায় পুনরায় সর্বোচ্চ ঋণ সুবিধা ভোগ করেন। এক্ষেত্রে স্থিতির ওপর হিসাব করা হলে গ্রাহকদের প্রকৃত প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলানিউজকে বলেন, একজন গ্রাহকের ভালোমন্দ দুএকমাসে যাচাই করা সম্ভব না। এজন্য ঋণ গ্রহিতার কম করে হলেও এক বছরের ঋণের স্থিতির হিসাবায়ন দেখা উচিত। প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি আমলে নেওয়া উচিত।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজারের কারণে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু কোনো একটি ব্যাংকে উক্ত প্রতিষ্ঠান তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করে অন্য ব্যাংকে যদি না করা হয় তাহলে ওই প্রতিষ্ঠান এসব ব্যাংকে এ সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতার মধ্যে পড়বে কি-না তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নীতিমালায় নেই। তাছাড়া ঘোষিত প্রণোদনার সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাপনে সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার নীতিমালা অনুসরণের নির্দেশ রয়েছে। এতে বড় গ্রুপ অব কোম্পানি ব্যাংকগুলোতে তাদের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের নামে দীর্ঘ মেয়াদী ও স্বল্প মেয়াদী ঋণ থাকাতে এসব গ্রুপ অব প্রতিষ্ঠান নতুন করে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হবে। বিশেষ করে গ্রুপ অব কোম্পানির বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে লকডাউনের কারণে দীর্ঘ দুইমাস সব ব্যাংকের ক্রেডিট-বিনিয়োগ এবং প্রধান কার্যালয়ের যে বিভাগ-কার্যালয়ের মাধ্যমে ঋণ কার্যক্রম পরিচালিত হয় তা বন্ধ থাকার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণ প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই সময় উৎপাদনের সঙ্গে সরবরাহ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় কোনো অর্থ আয় করতে পারছে না শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, পুরো প্যাকেজটি ব্যাংক খাত নির্ভর করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে না। তাই এতে কোনো লাভ হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য বাড়াতে সিআরআর ও এসএলআর ছাড় দিয়েছে। এটার প্রয়োজন ছিল না। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এই সুবিধা পাবে না। দুঃখজনক হলেও খারাপ লাগে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সুশাসনের অভাবে এই প্যাকেজ বাস্তবায়ন হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক ঘাটতি আছে।

শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বাধ্যতামূলক, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, এবং দীর্ঘ মেয়াদী ও স্বল্প মেয়াদী সব ঋণের সুদ অব্যাহত থাকায় প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা দিশেহারা। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে টিকে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।  

এমতাবস্থায় উদ্যোক্তাদের দাবি, প্রণোদনার পাশাপাশি চলতি বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণের ওপর সুদ আরোপ না করা এবং সরকারি সব আমানতের সুদ প্রদান না করা। তা না হলে নিশ্চিত সব শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস তো হবেই সঙ্গে বেকার হয়ে যাবে এসব প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ কর্মী। ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে দেখা দেবে সামাজিক বিপর্যয়ও।

এছাড়াও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে যে লম্বা ছুটি দেওয়া হয়েছে তার কারণে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ সভা দুই মাস ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ফলে আটকে আছে ঋণ গ্রহিতাদের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রস্তাবের সিদ্ধান্ত।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২০
এসই/এইচএডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।