ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

পাঠকের হাতে বই, প্রকাশকের মুখে হাসি

আদিত্য আরাফাত ও আসাদ জামান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
পাঠকের হাতে বই, প্রকাশকের মুখে হাসি ছবি: দীপু মালাকার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১০ম দিন বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৩টা। মেলার সোরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের ফোয়ারার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন মো. ফারুক হোসেন।


 
হাতে পেটমোটা তিনটি ব্যাগ। তিনটিতেই মেলা থেকে কেনা নতুন বই। আরও বই কেনার জন্য কাঙ্ক্ষিত প্রকাশনীর প্যাভিলিয়ন-স্টল খুঁজছেন হয়তো।
 
পেশায় সামরিক কর্মকর্তা মো. ফারুক হোসেন উত্তরা থেকে মেলায় এসেছেন নিজের ও সন্তানদের জন্য বই কিনতে। নিজের জন্য কিনেছেন বাংলা একাডেমির বেশ কয়েকটি অভিধান, গবেষণা গ্রন্থ, ইতিহাস ও রাজনীতির বই। বাচ্চাদের জন্য কিনেছেন সায়েন্স ফিকশন, রূপকথা, শিশু সাহিত্য ও ছড়ার বই।

কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলেন, সারাবছরই বই কেনা হয়। তবে বইমেলার সময় বাংলা একাডেমি থেকে অভিধান ও অভিজাত প্রকাশনী থেকে বের হওয়া নতুন বইগুলো কিনে থাকি। আজ কিছু কিনলাম, আরও কিনবো।

ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘মাশরাফি’ বইটি কিনে ফিরছিলেন মুন্সীগঞ্জের আবুল বাসার। বইয়ের সঙ্গে মাশরাফি পোস্টার পাওয়া যাবে কি না-? হঠাৎ মনে পড়তেই আবার ফিরলেন ঐতিহ্যের স্টলে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আমজাদ হোসেন কাজল বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, বইয়ের সঙ্গে কোনো পোস্টার দেওয়া হচ্ছে না, একটা খাম নিয়ে যেতে পারেন।

পোস্টারের বদলে খাম নিয়ে ফের যখন গমনোন্মুখ আবুল বাসার, ঠিক তখন বাংলানিউজের অনুরোধে একটু থামলেন। বই কেনা ও মেলায় আসার অনুভূতি জানতে চাইলে ক্রিকেট পাগল বাসার বলেন, মেলায় আসি শুধু কেনার জন্য। ঘোরা-ঘুরি করে আনন্দ উপভোগের বয়স এখন নেই। সময়ও নেই।
 
মিরপুরের পল্লবী থেকে ৬ বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে মেলায় এসেছেন নুসরাত আমীন। নিজের জন্য ও বাচ্চার জন্য দুই ব্যাগ বোঝাই করে বই কিনেছেন। পছন্দের আরও বই কেনার জন্য মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ স্টল থেকে ও স্টলে ঘুরছেন।
 
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আলতাফ মাহমুদ চত্বরে দেখা হয় নুসরাত আমীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, যানজট ঠেলে, ধূলা-বালি মাড়িয়ে মেলায় আসার মূল উদ্দেশ্য বই কেনা। বইমেলার আশপাশে বাসা হলে হয়তো বেড়ানোর জন্য বা আনন্দ উপভোগের জন্য মেলায় আসতাম। এতোদূর থেকে যখন আসি, বই কেনার জন্যই আসি।

বুধবার মেলার ১০ম দিনে পাঠক-লেখক-দর্শনার্থীর ভিড় আহমরি কিছু না থাকলেও রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে থেকে যারা মেলায় এসেছেন তাদের বেশির ভাগই কিনেছেন বই।
 
আর পাঠকের হাতে হাতে বই দেখে যারপরনাই খুশি বইয়ের প্রকাশক, প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্টল-প্যাভিলিয়নে কর্মরত বিক্রয়কর্মীরা।

অন্যপ্রকাশের সহকারী ম্যানেজার তুষার খান তুহিন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এখানে বরাবরই ভালো বিক্রি হয়। দিন যত যাচ্ছে, বিক্রিও তত বাড়ছে। প্যাভিলিয়ন ভিজিট করা প্রায় ৬০ শতাংশ লোক বই কেনেন। এটাকে ভালো বিক্রিই বলা চলে।

হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ বইয়ের প্রকাশনী অন্যপ্রকাশের বিক্রি-বাট্টা সব সময়ই ভালো থাকে। তবে অন্য অভিজাত ‍প্রকাশনা সংস্থার বই বিক্রির খবরও সন্তোষজনক বলে মনে হলো।
 
ঐতিহ্য প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী আমজাদ হোসেন কাজল বাংলানিউজকে বলেন, বিক্রি খারাপ না। ভালোই বিক্রি হচ্ছে। আগামী শুক্রবার থেকে বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়বে।

মানসম্মত বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) প্যাভিলিয়নে মেলার শুরু থেকেই প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছে। মেলার দশম দিনেও ইউপিএল থেকে প্রচুর বই বিক্রি হতে দেখা গেছে।
 
অ্যাডর্ন প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নেও বই ক্রেতার ভিড় ছিলো চোখে পড়ার মত। এই প্যাভিলিয়ন ভিজিট করা প্রায় ৪০ শতাংশ লোক বই কিনছেন বলে জানালেন মো. রেজাউল করীম।
 
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা শুক্রবারের (১২ ফেব্রুয়ারি) অপেক্ষায় আছি। ওই দিন থেকে মূলত বই বিক্রি বাড়বে। তবে এখন পর্যন্ত যা বিক্রি হচ্ছে, তাকে খারাপ বলা যাবে না।
 
কিন্তু মেলায় এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। যেসব প্রকাশনা সংস্থা মানসম্মত বই আনতে পারেনি, তাদের বিক্রি সন্তোষজনক নয়। ভালো বইয়ের প্রকাশকরাই বই বিক্রির দিক থেকে সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছেন।
মোড়ক উন্মোচন
বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি ডিআরইউ স্টলের সামনে কুদরাত-ই খোদার ‘একটি কুকুরের মৃত্যু ও জীবন সংগ্রাম কাহিনী’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। এসময় উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক সাবান মাহমুদ, সোহেল হায়দার চৌধুরী, আবু জাফর সূর্য। এছাড়াও ছিলেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি জামাল উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ।
 
নতুন বই:
এ পর্যন্ত মেলায় নতুন বই এসেছে প্রায় সহস্রাধিক। দশম দিন এসেছে ১০৫টি।
 
এরমধ্যে গল্প ১৯ উপন্যাস ২১, প্রবন্ধ ৩, কবিতা ২৮, গবেষণা ১, ছড়া ৬, জীবনী ৪, মুক্তিযুদ্ধ ২, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ১, সায়েন্সফিকশন ১, ও অন্যান্য ১৮টি।
 
উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে রাত্রী প্রকাশনীর সৈয়দ শামসুল হকের ‘বাবার সাথে যাওয়া ও অন্যান্য কিশোর গল্প’, অন্বেষা প্রকাশন এনেছে আনিসুল হকের ‘ কিশোর সাত গোয়েন্দা’, আন্দালিব রাশদীর ‘ ভুট্টোকে আখরি দিনও অন্যান্য রচনা’, পার্ল পাবলিকেশন্স এনেছে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার প্রাচীন ও
নবীন প্রেমের গল্প’, ঐতিহ্য এনেছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লিফ স্টর্ম’, উৎস প্রকাশন এনেছে সুব্রত দাশের ‘উড়ে চলার বিদ্যে’, সময় প্রকাশন এনেছে হাসান হাফিজের নির্বাচিত ১০০ ছড়া’, কথা প্রকাশ এনেছে আরজুমন্দ আরা বানুর ‘সাহিত্য কথনিকা’, নালন্দা এনেছে মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের ‘ষড়ঋতুর কবিতা ছড়াগান,’ চন্দ্রদ্বীপ এনেছে মাহবুব তালুকদারের ‘গল্পসমগ্র ১,’ সাহিত্য বিলাস এনেছে শহীদুজ্জামানের ‘বাংলার বিবেক’, অনুপম প্রকাশনী এনেছে ‘মিলন নাথের বঙ্গবন্ধুর কিশোর জীবন’, কটেশ্বর বর্ণন এনেছে আহমদ রফিকের ‘সময়ের দর্পণে সময় ও রাজনীতি,’ অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স এনেছে রহমান মাহবুবের ‘শেক্সপিয়র থেকে কীটস, রবার্ট থেকে ইলিয়ট’।

মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে শিশুসাহিত্য চর্চা: অতীত থেকে বর্তমান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শাহীন আখতার। আলোচনায় অংশ নেন আসলাম সানী, রাশেদ রউফ ও সুজন বড়ুয়া। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট লেখক রশীদ হায়দার।

প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকে প্রায় সর্বপ্রান্তস্পর্শী। তবুও একটি দিকে ঘাটতি থেকে গেছে। শিশুসাহিত্যের সৌধে চড়বার প্রথম সোপানটিতেই আছে দুর্বলতা। লেমিনেটেড কাগজে রং-চঙা বর্ণপরিচয়ের বই আজকাল ঢাকার রাস্তায় বিকোয়। কিন্তু তাতে আদৌ বাঙালিত্ব বা দেশজ আবহ আছে কিনা, তা ভাববার বিষয়। প্রাক-বিদ্যালয় পর্বের বই বলে এগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রকাশনার আওতায় পড়ে না।

তিনি আরও বলেন, বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমি যৌথ উদ্যোগে দেশের প্রথিতযশা লেখকদের সহায়তায় এ জাতীয় পুস্তিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারে। বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগেই শিশু যেন ভালোবাসতে পারে ভাষাশহিদদের রক্তে রাঙানো বর্ণমালাকে, যেন চিনতে পারে দেশকে, তার সত্যকার পরিচয়ে।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবুল ফারাহ্ মো. তোয়াহা-এর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর’ এবং হাসান আব্দুল্লাহ্-এর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক শিশু-কিশোর সংগঠন ‘ঘাসফুল শিশু-কিশোর সংগঠন’-এর শিল্পীরা।

বৃহস্পতিবারের আয়োজন
মেলার ১১তম দিনে বিকেল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী: অমর একুশে গ্রন্থমেলা- অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বদিউদ্দিন নাজির। আলোচনায় অংশ নেবেন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, ড. জালাল আহমেদ এবং খান মাহবুব। সভাপতিত্ব করবেন ইমেরিটাস প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমদ। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
এডিএ/এজেড/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।