কালাছড়া বিট (মৌলভীবাজার) থেকে ফিরে: আবারও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ছয়টি মূল্যবান সেগুন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। লাউয়াছড়ার কালাছড়া বিটে সম্প্রতি এ গাছ কাটা কেন্দ্র করে চা শ্রমিক ও ভিলেজারদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা।
যে কোনো প্রভাবশালী সংঘবদ্ধ ভিলেজারদের হামলার শিকার হতে পারেন নিরীহ চা শ্রমিকরা। বন বিভাগ দু’পক্ষের দু’জনকে আটক করে মামলায় জড়ানোর ফলে অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।
গাছ কাটা ভিলেজারদের সঙ্গে স্থানীয় বিট কর্মকর্তা একত্রিত হয়ে এই অপকর্মে তাদের সহযোগিতা করারও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর কালাছড়া বিট থেকে গাছ কাটা ও পাচারের মিথ্যা অভিযোগে লেনাট তিকী নামের এক নিরীহ চা শ্রমিকের কিশোর সন্তানকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। কালাছড়া চা বাগানের শ্রমিক লেনাটের বাবা বাছিল তিকী।
এ ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়া এলাকার চা শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে ভিলেজারদের গাছ কাটা অবস্থায় ধরার জন্য পার্শ্ববর্তী কালাছড়া বিটে গোপনে পাহারা দিতে থাকেন।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার (ঈদের আগের দিন) রাতে আট/দশ জন ভিলেজার সংঘবদ্ধ হয়ে কালাছড়া বিটে গাছ কাটতে গেলে চা শ্রমিকরা তাদের আটক করার জন্য ধাওয়া করে। পালানোর চেষ্টার সময় দিলীপ নামের এক ভিলেজারকে তারা আটক করে বন বিভাগের কর্মকর্তার হাতে তুলে দেয়।
সেই রাতেই ভিলেজাররা কালাছড়া বিটের সাইড থেকে ছয়টি সেগুন গাছ কেটে ফেলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ও এলাকার এক চা শ্রমিক জানান, আটকের সময় দিলীপ বন কর্মকর্তাদের বলেন, গাছগুলো কাটার আগে তারা আরও একগাড়ি গাছ পাচার করেছেন।
লেনাটের মা কলেসটিকা অভিযোগ করে বাংলানিউজকে বলেন, কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের জন্মসনদ অনুযায়ী আমার ছেলের বয়স চৌদ্দ। তাছাড়া আমার ছেলে সেদিন মাঠে গরু খুঁজতে গিয়েছিলো। প্রভাবশালী ভিলেজার ক্ষীরদ ও হরি একত্রিত হয়ে আমার ছেলেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আটক করে তার নামে মামলা দিয়েছে।
গ্রামবাসী রামসুন্দর কর্মকার ও রবার্ট ওরাও বলেন, ভিলেজাররা আমাদের ছেলেদের গাছ কাটার সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য প্রায়ই ডাকে। আমরা তাদের এমন অপরাধমূলক কাজে সহযোগিতা করি না বলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আছে আমাদের উপর। মিথ্যা মামলায় আমাদের হয়রানি করে থাকে তারা।
ওই এলাকার মুক্তি ওরাও, দুর্গামণি ওরাও, মনিমালা ওরাও এবং কারমেলা ওরাও বলেন, আমাদের উপর ভিলেজাররা হামলা করবে বলে নানাভাবে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) দুপুরে দুর্গম কালাছড়া বিটে সরেজমিন গিয়ে গেছে, মাঝারি থেকে বিশাল আকৃতির ছয়টি সেগুন গাছের মোথা (গাছের গুড়ি) পড়ে রয়েছে। মোথাগুলো তাজা। গাছগুলো মাটিতে পড়ে আশপাশের গাছগুলোরও ক্ষতি করেছে।
জানা যায়, ভিলেজারদের সঙ্গে হাত করে মূল্যবান গাছ কাটাসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত থাকার অভিযোগে কালাছড়ার বিট অফিসার মোশারফ হোসেনকে চাকরি থেকে সম্প্রতি সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার স্থলে চালতলি বিটের বিট অফিসার মিজানুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কালাছড়া বিটের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মহালদার আবরু মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ভিলেজাররা নিজেরা রাতের অন্ধকারে গাছ চুরি করে দোষ দেয় বিট সংলগ্ন বসবাসকারী চা শ্রমিকদের উপর। এ যেন এক নির্মম রসিকতা।
কালাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মতলিব বলেন, ভিলেজাররা নিজে কালাছড়ার গাছ কেটে নিরীহ চা শ্রমিকদের উপর দোষ চাপায়। শুধু তাই নয়। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এক কিশোরকে আটক করিয়ে দিতে সহযোগিতা করেছে ভিলেজাররা।
মৌলভীবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) মো. সাহেব আলী সেগুন গাছ কেটে ফেলার কথা স্বীকার করে বলেন, ভিলেজার মানে হচ্ছে তারা বনে বসবাস করে বন রক্ষার কাজে সহায়তা করবে। পাশাপাশি তারা বনের পরিত্যক্ত জমিতে চাষবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করবে।
তিনি আরও বলেন, কিন্তু বর্তমানে বনের গাছপালা কেটে ফেলার ব্যাপারে তাদের উপরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি একজন ভিলেজারকে আমরা আটক করে থানায় দিয়েছি।
সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) সৈয়দ আলী বাংলানিউজকে বলেন, কালাছড়া বিটের গাছকাটাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও বৈরী ভাবাপূর্ণ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। কোনোভাবেই যাতে বনের গাছপালা ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি না হয় ব্যাপারটি আমরা এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৫
বিবিবি/এএ