সবশেষ প্রকাশিত দীর্ঘমেয়াদী ‘জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে’ বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ। ১৯৯৭-২০১৬ সময়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এ সূচক।
শুধু সিআরআই-ই নয়, এরকম আরও পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেই। ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু জলবায়ু নিয়ে সম্প্রতি সবচেয়ে বড় চিন্তার খবর হলো বিগত আট লাখ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে বায়ুমণ্ডলে নির্গত হওয়া কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। একটি ব্রিটিশ গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
তারা বলছে, ২০১৬ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তাই আমরা ধারণা করতে পারি, দূষণের মাত্রা কমাতে না পারলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এ রেকর্ড প্রতিবছর না হলেও প্রায়শই ভাঙবে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন, কার্বন নিঃসরণ বা বৈশ্বিক উষ্ণতার যে মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা নির্ধারিত সময়ের আগেই সামনে এসে উপস্থিত হবে। এতে বিশ্ব মানবতা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে। যেখান থেকে জলবায়ুকে ইতিবাচক সূচকের দিকে নিয়ে আসা হবে দুঃসাধ্য। তাই দূষণের হালে এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা না হলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্য পড়বে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো।
বাংলাদেশ এমনিতেই একটি দুর্যোগপূর্ণ দেশ। আবহাওয়া ও জলবায়ু সংশ্লিষ্ট নানা দুর্যোগ সারা বছরই লেগে থাকে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অকাল বন্যা, বন্যা, খরা ও বৃষ্টিপাতের ফলে আমাদের নানা ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরতে না পারলে ও ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন না করতে পারলে আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, জীবনযাত্রা চরম হুমকির মুখোমুখি হবে।
জলবায়ুর সঙ্গে অর্থনীতি ও উন্নয়নের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। সে সম্পর্ক অনেকটাই বৈরী। তাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রাখাটাই গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা স্থিতিশীল জলবায়ুর লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। একে অস্বীকার করলে উন্নয়ন ও জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা কোনোটাই অর্জিত হবে না।
জলবায়ুর অস্থির আচরণ এখন বিশ্বব্যাপীই পরিলক্ষিত। বাংলাদেশে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন বন্যাকবলিত থেকেছে দেশের একটি অঞ্চল। সেই সঙ্গে পাহাড়ি ঢল ও ধসে প্রচুর প্রাণহানিও ঘটেছে। একই সঙ্গে তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদী খরায় বিপর্যস্ত হয়েছে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে থাকা আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে। সেখানকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে ধারাবাহিক খরা দেখা দিয়েছে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জিম্বাবুয়ে। সরকার সেখানে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা (disaster state) ঘোষণা করেছে।
কার্বন দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে; এ কথা সত্যি। তবে এতে খুব বেশি সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ নেই, কারণ আমাদের অর্থনীতি এখনও শিল্প-নির্ভর বা কার্বন-নির্ভর হতে পারেনি। মোট কার্বন দূষণের মাত্রা চীনে সবচেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ তাদের উন্নয়ন। তবে শুধু উন্নয়ন বললে ভুল হবে, বরং জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর উন্নয়নই এর জন্য দায়ী। ভারতও তাই।
আমাদের অর্থনীতি এখনও কৃষি-নির্ভর। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির চাকা গতিশীল করতে হবে কার্বন দূষণের মাত্রা না বাড়িয়ে। যা আসলেই বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন করা। এ কাজে প্রয়োজন অর্থনৈতিক সহায়তা ও লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার।
জলবায়ুর ওপর উন্নয়নের প্রভাব অনেকটাই অদৃশ্য। যা আমরা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর জলবায়ুর যে প্রভাব তা আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট–এর দেওয়া এক তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বে দূষণের কারণে প্রতি ছয়জনের একজন মারা গেছে। আবার দূষণজনিত এ মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি হয় বায়ুদূষণের কারণে। একইভাবে লক্ষ্যণীয়, দূষণের কারণে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের অর্ধেক চীন ও ভারতের অধিবাসী।
বাংলাদেশ যদিও এ তালিকার বাইরে। কিন্তু এর আশু প্রভাব আমরা অস্বীকার করবো কী করে? কারণ তথ্য আরো বলছে, দূষণজনিত মৃত্যুর ৯২ শতাংশই ঘটছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশের মতো শিল্পায়নমুখী দেশগুলোতে প্রতি চারজনের একজন মারা যায় দূষণজনিত কারণে। আমাদের দেশে অপরিকল্পিত ও অ-টেকসই উন্নয়ন ও নগরায়নের ফলে দূষণের মাত্রা ও এর প্রত্যক্ষ প্রভাব বেশি। তাই জলবায়ুর বৈশ্বিক আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ত হতে হবে, যার লক্ষ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে উন্নত-উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর দায়-দায়িত্ব ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় নিজস্ব সক্ষমতা অর্জন করা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৭
এএ