ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

আম্পানের পর যেমন আছে সুন্দরবন…

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০০ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২০
আম্পানের পর যেমন আছে সুন্দরবন… সুন্দরবন। ছবি: বাংলানিউজ

খুলনা: প্রলঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ সুন্দরবনের ওপর দিয়ে দুর্বল হয়ে খুলনা উপকূল অতিক্রম করে। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়েই মূলত দুর্বল হতে শুরু করে ঘূর্ণিঝড়টি। বুক পেতে দিয়ে যে বনরাজি উপকূলকে আগলে রাখলো, কেমন আছে সেই সুন্দরবন?

‘আম্পান’ যে গতি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল তার প্রভাব আটকে দিয়েছিল সুন্দরবনের গাছপালা। ভারতে ‘আম্পানের’ মূল আঘাতের পর ২শ মাইলের মধ্যে থেকেই সুন্দরবন বাতাসের গতিবেগ প্রতিরোধে ভূমিকা নিয়েছে।

ভারতে মূল ঝড়ের আঘাত ১৮০ কিলোমিটার হলেও খুলনায় এ আঘাত ৯০ কিলোমটিারের মধ্যেই ছিল। বাংলাদেশে আঘাত হানার আগেই সুন্দরবন এর শক্তি কমিয়ে দেয়। ফলে এই ঝড়ে যে পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি ক্ষতির হাত থেকে উপকূলের মানুষ ও সম্পদ রক্ষা পেয়েছে। এর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও ৩ থেকে ৪ ফুট কমিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনটি।
সুন্দরবন।  ছবি: বাংলানিউজ
সুপার সাইক্লোন ‘আম্পানের’ আঘাত হানার পরে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি কী অবস্থায় রয়েছে?  আম্পানের গতিকে কমিয়ে দিয়ে লোকালয়ের মানুষের জীবন আবারো বাঁচিয়ে দেওয়ার পর সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থা কেমনই বা আছে?

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে কমিটি গঠন করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন>>>আম্পানেও দেশকে মায়ের মতো আগলে রাখলো সুন্দরবন

সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে বন বিভাগের গঠিত চারটি কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ‘আম্পানের’ আঘাতে সুন্দরবনের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বনের ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছ ভেঙে গেছে। আর বন বিভাগের অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। তবে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার মৃত্যু কিংবা আহতের খবর পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আম্পানের আঘাতে পশ্চিম সুন্দরবনের দুইটি রেঞ্জ এলাকায় ১২ হাজার ৩৩২টি গাছ ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব গাছের মধ্যে গরান গাছের সংখ্যা বেশি।

এর মূল্য ১০ লাখ ১০ হাজার ৫৬০ টাকা। এছাড়া স্থাপনা, জেটি, উডেন ট্রেইল, ওয়াচ টাওয়ার ও অবকাঠামোর ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে বাঘ, হরিণসহ অন্য কোনো বন্য প্রাণীর ক্ষতি হয়নি। আর পূর্ব সুন্দরবনের দু’টি রেঞ্জ এলাকায় ২৬টি গাছ ভেঙেছে। এ বিভাগের আওতায় জব্দ থাকা বেশ কিছু কাঠ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। এতে আর্থিক ক্ষতি সাত লাখ ছয় হাজার ৮৩০ টাকা। পাশাপাশি পূর্ব বনবিভাগে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।

সুন্দরবন।  ছবি: বাংলানিউজবুধবার (২৭ মে) সকালে সুন্দবনের কোল ঘেসা গ্রাম মোংলার দক্ষিণচিলার বাসিন্দা বাদাবন ইকো-কটেজের পরিচালক মো. লিটন জমাদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন আর আমাদের বাড়ি একটি ছোট খালের এপার-ওপার। এ খালটি খড়মা নদী নামে ছিল।

আম্পানে বনের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, জয়মনি ঘোল এলাকায় বনের বেশ কিছু গাছপালার ডাল ভেঙেছে। বাতাসের তীব্রতা ও ঝড়ের গতি দীর্ঘ সময় থাকায় অনেক পাখি মারা গেছে। আমাদের বাড়ির উঠানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল শিয়াল, বাঘডাসাসহ বেশ কিছু প্রাণী। সম্প্রতির যেকোনো ঝড়ের চেয়ে এবারের ঝড়ে বনের বেশি ক্ষতি হয়েছে।

করমজল প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার আজাদ কবীর বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনের পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন করমজল পর্যটন কেন্দ্রটি ইকো ট্যুরিস্টদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। এ দর্শনীয় স্থানে হরিণ, কচ্ছপ ও কুমিরের প্রজনন, লালন-পালন, ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র এবং পায়ে হেঁটে বনের সৌন্দর্য দেখা যায়। এবারের আম্পান ঝড়ের তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। তাই ভেবেছিলাম করমজলের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু তুলনামূলক ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কম হয়েছে।

তিনি জানান, ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের বেশ কিছু টিন উড়ে গেছে। গাঠ পড়ে কিছু অ্যাংগেল ভেঙে গেছে। পল্টুনের ক্ষতি হয়েছে এবারের ঝড়ে। তবে করমজলের কোনো পশুপাখির ক্ষতি হয়নি।

বন কর্মকর্তারা ও সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। নিকট অতীতে সুন্দরবন সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, বুলবুলের ক্ষত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত দেড়শত বছরে ৭৫টি প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সুন্দরবন। তার পরও সুন্দরবন বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

সুন্দরবন।  ছবি: বাংলানিউজসুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. বশিরুল আল মামুন বাংলানিউজকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সুন্দরবনের কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে সুন্দরবন থেকে সব ধরনের গাছ কাটা নিষিদ্ধ রয়েছে। যে কারণে আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেগুলো ওভাবেই থাকবে, কোনো গাছ কাটা হবে না। বন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনে আম্পানে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আশা করি আগামী ছয়মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

বন কর্মকর্তারা বলেন, বনের গাছ স্বাভাবিকভাবে ঠিক হয়ে উঠবে। তবে বন বিভাগের আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামোগুলোর মেরামত করতে হবে।

পরিবেশবাদী উন্নয়ন সংগঠন ‘জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট’ ক্লিনের প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের পর্যবেক্ষণে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুলের’ চেয়ে ‘আম্পানে’ সুন্দরবনের বেশি ক্ষতি হয়েছে। এতে সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জে বেশি ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবন।  ছবি: বাংলানিউজএর আগেও অসংখ্য ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল আঘাত ঠেকিয়েছে সুন্দরবন। এবারও ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পানকে’ প্রায় একাই ঠেকিয়ে দিয়েছে সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী গাছপালাগুলো। এতে বাংলাদেশ বড় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেলেও আঘাত ঠেকাতে গিয়ে সুন্দরবন হয়ে গেছে বিধ্বস্ত।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২০
এমআরএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।