ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একই পেশা, বদলায় না অবস্থা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একই পেশা, বদলায় না অবস্থা

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলের জেলে জীবন। সমুদ্রে দস্যু আর দুর্যোগের আতঙ্ক কাটিয়ে কিনারে ফিরতে না ফিরতেই পড়তে হয় দাদনদারদের রোষানলে।

হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। শূন্য হাতেই ফিরতে হয় ঘরে। দিন আনা দিন খাওয়া জেলে পরিবারের অবস্থা বদলায় না, এক টুকরো সম্পদ গড়তে পারেন না তারা। উপকূল ঘুরে জেলে জীবনের এইসব অনুসন্ধান করেছে বাংলানিউজ। সাত পর্বের ধারাবাহিকের চতুর্থ পর্ব     


উপকূল অঞ্চল ঘুরে এসে: জীবন এখানে থমকে দাঁড়ায় যেন। সেই শিশুকাল থেকে মাছ ধরা, জীবনের সবটুকু শেষ করেও ভাগ্যের কোনো বদল হয়নি। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বয়সী জেলেরা তাই হিসাব মেলাতে পারেন না। জীবনের বাকি কটা দিন হয়তো এই কাজ করেই জীবনটা পার করে দেবেন। পরের প্রজন্ম মৎস্যজীবী হলেই যেন জেলে জীবনের পরম প্রশান্তি।

উপকূলের জেলে জীবনের হিসেবটা এমনই। নানাম‍ুখী সংকটের ভেতর দিয়ে অতিক্রান্ত এই জীবনের হিসেব মেলানোটাই যেন কঠিন। জীবনভর মাছ ধরে কাটানো বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের অভিব্যক্তি। প্রত্যেকের কণ্ঠেই যেন আক্ষেপের সুর। জীবনের ফেলে আসা সেই দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন অবশিষ্ট কিছুই নেই। না হয়েছে এক টুকরো সম্পদ, না পেরেছেন ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে, উপরন্তু দেনার দায় বেড়েছে অনেক গুণ। আলাপকালে জেলেরা তাই জীবনকে সপে দেন নিয়তির হাতে।



দীর্ঘদিন পেশায় থেকে উপকূলের জেলেদের অবস্থা পরিবর্তন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য মেলে। মাছ ধরে আর্থিক অবস্থা বদলাতে পেরেছেন, এমন জেলে খুঁজে পাওয়াটাই কষ্টকর। সুখের দিনের চেয়ে দুঃখের দিনটাই চোখের সামনে ভাসে। অনেকে দেনার দায় কাঁধে নিয়ে এ জীবিকাই ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে মাছ ধরতে গিয়ে পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। কেউবা সব হারিয়ে পথে বসেছেন।

ভোলার ইলিশা এলাকায় মেঘনা নদীতে মাছ ধরেন মো. শাহাজল। বয়স ৬০ অতিক্রম করেছে। বাড়ি ভোলার দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে। ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে মাছ ধরেন। সারা জীবন অন্যের নৌকায় মাছ ধরেছেন। ছেলেরাও ঠিক তার মতোই ছোটবেলা থেকে জীবিকার অন্বেষণে অন্যের নৌকায় মাছ ধরছে।

শাহাজল বলেন, যা রোজগার হয়, সেটাই খরচ হয়ে যায়। অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। বেশি মাছ পড়লে একটু ভালো খাই। কম মাছ পড়লে সমস্যা বেশি হয়। অভিযান চললে মাছধরাই বন্ধ থাকে। তখন কষ্ট হয় আরও বেশি। নদীতে মাছ ধরে কোনমতে খেয়ে-পরে থাকা যায়। এর বেশি কিছুই আশা করা যায় না।       

ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুরের জেলে সালাহউদ্দিন। ছোটবেলা থেকে ট্রলারে মাছ ধরতে ধরতে এখন ট্রলারের মাঝি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। মাঝি হিসেবে অন্য জেলেদের চেয়ে মাছের ভাগ একটু বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে কী, আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেননি সালাহউদ্দিন। মাঝ বয়সে এসে ঋণ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা।

সালাহউদ্দিন বলেন, জেলেরা যা পায়, তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে-পরে থাকাটাই কঠিন। জেলেরা জীবন বাজি রেখে কঠোর পরিশ্রম করে মাছ ধরে। আর অবস্থা পরিবর্তন হয় আড়তদার-মহাজনদের।

দৌলতখানের কলাকোপা গ্রামের জেলে আব্দুল গণি। ক্ষুদ্র ব্যবসা ছিল। নদী ভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবনে নানা সমস্যা দেখা দেওয়ায় ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই পাঁচ বছর ধরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ। কিন্তু এতেও অবস্থার কোনো বদল হয়নি তার।



মাত্র ১০-১১ বছর বয়স থেকে নদীতে মাছ ধরা শুরু করেছেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউনিয়নের নাইয়াপাড়ার জেলে জালাল মাঝি। এখন বয়স ৭৫ বছর। সে হিসেবে প্রায় ৬০ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরেছেন। এখন অবসর। মাছ ধরতে গিয়ে ১১ বার জলদস্যুদের কবলে পড়েছেন। ৯ বার ফিরে এসেছেন ভালয় ভালয়। দুই বার সর্বস্ব হারাতে হয়েছে। ছেলেরা এখনও মাছ ধরতে পারছে, জালাল মাঝির প্রশান্তি এটুকুই।

একই পাড়ার আরেক জন আলাউদ্দিন। প্রায় ৩০ বছর ধরে মাছ ধরছেন। যেমন নিঃস্ব অবস্থা থেকে মাছধরা শুরু করেছিলেন, সেভাবেই আছেন এখনও। বরং ২০০৭ সালের প্রলংঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর তাকে আরও নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে। ওই সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একটি পা হারিয়েছেন তিনি। মহাজন আর বিভিন্ন সংস্থা মিলিয়ে দেনা আছেন প্রায় দুই লাখ টাকা। পরিবার-পরিজন নিয়ে তার জীবন এখন চরম সংকটের মুখে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, উপকূল অঞ্চলের অধিকাংশ জেলের অবস্থা সংকটাপন্ন। মাছ ধরতে যেতে হলেই মহাজনদের কাছে হাত পাততে হয়। জাল-নৌকা কিনে কিংবা মেরামত করে নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তার থাকে না। এ কারণেই জেলেরা মহাজন-আড়তদারদের কাছে জিম্মি থাকে বছরের পর বছর। ফলে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয় না।

জেলেদের অভিযোগ, সরকারি সুবিধা জেলেদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায় না। অন্যদিকে জেলেরা সংগঠিত নয়। জেলেদের দাবি আদায়ে কিছু সংগঠন কাজ করলেও তাতে প্রকৃত জেলেদের কোনো কল্যাণ হয় না। সহজ শর্তে ঋণ আর সরকারি সুবিধা নিশ্চিতকরণের দাবি জানিয়েছেন জেলেরা।          
 
ভোলা কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমিতির সম্পাদক আবুল কাসেম বাংলানিউজকে বলেন, এক শ্রেণির অ-মৎস্যজীবীর প্রভাবে প্রকৃত জেলেরা নিষ্পেষিত। জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। জেলেদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা কিংবা জেলেদের নিয়ে সরকারি পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।          

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতি দৌলতখান শাখার সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, জেলেদের আর্থিক অবস্থার বদল হচ্ছে না একেবারেই, এটা ঠিক নয়। আগের চেয়ে নদীতে মাছও ভালো পড়ছে, জেলেরাও ভালো আছে। তবে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জলদস্যুদের আক্রমণ তাদের পিছিয়ে রাখছে।
        
পাঁচ: জলবায়ু পরিবর্তনে ওলট-পালট জেলে জীবন
ছয়: বিধবা জেলে বধূদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার
সাত: জেলে পরিবারের শিশু, ষোলতেই দক্ষ মাঝি 

বাংলাদেশ সময়: ০২১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।