ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলে সংকটে শৈশব-শেষ পর্ব

শিশুর সুরক্ষা, অন্ধকারে আলোর ঝিলিক

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৫
শিশুর সুরক্ষা, অন্ধকারে আলোর ঝিলিক ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হাজারো সংকটে উপকূলের শৈশব। এ এক অন্যরকম বেড়ে ওঠা।

এখানে শৈশব ডানা মেলে অপুষ্টি আর অশিক্ষায়। দূরন্তপনার রেশ কাটতে না কাটতেই কর্মজীবনের সূচনা। কাঁধে ভর করে ভারি কাজের বোঝা। শৈশবের রঙিন স্বপ্ন ওদের জীবনকে আলোড়িত করে না। দারিদ্র্যের বেড়াজাল নিয়ে আসে বঞ্চনার পর বঞ্চনা।
 
শিশু অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। পেটভর্তি খাবারের আয়োজনটা ঠিকঠাক না থাকলেও হাড়ভাঙা পরিশ্রমটা পুরো মাত্রায়। উপকূলের প্রান্তিক জনপদের শিশুদের সংকটের আদিঅন্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে বাংলানিউজ তৈরি করেছে ‘উপকূলে সংকটে শৈশব’ শীর্ষক ছয় পর্বের ধারাবাহিক। আজ পড়ুন শেষ পর্ব।
 
উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে এসে: একদল শিশু সব ধরণের অধিকার বঞ্চিত। শিক্ষা কিংবা মেধা বিকাশের সুযোগ নেই। চিকিৎসা পাওয়ার ন্যূনতম অধিকারটুকুও নেই। অধিক খাটুনির পরও জুটছে না তিনবেলা খাবার। ঠিক পাশেই বিপরীত চিত্র। একদল শিশু খানিক বেশি সুবিধা পাচ্ছে। স্কুলে তো যাচ্ছেই, অন্য সময়ে মেধা বিকাশের জন্য রয়েছে সব ব্যবস্থা। এটা যেন উপকূলের প্রান্তিকের শিশুদের বেড়ে ওঠায় বহুমুখী বাঁধার পথে খানিক আলোর ঝিলিক।  
 
উপকূলের সংকটাপন্ন শৈশবকে আলোর পথে এগিয়ে নেওয়ার এই উদ্যোগের দেখা মেলে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায়। স্থাপন করা হয়েছে ‘শিশুবান্ধব কেন্দ্র’। শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, মেধার বিকাশ ঘটাতে এখানে রয়েছে নানা ধরণের আয়োজন। কারও পুতুল বানাতে ইচ্ছে করলে সুযোগ রয়েছে। ছবি আঁকতে চাইলে তাও পারবে। বই পড়া কিংবা কম্পিউটার শেখার সুযোগও রাখা হয়েছে এখানে। শিশুদের বেড়ে ওঠা নির্বিঘ্ন করতে এ ধরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।  
 
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের শিশুবান্ধব কেন্দ্রের ৩য় শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া ফারজানার বাবা মো. আলম বলেন, ‘এখানে এসে আমার মেয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, ছবি আঁকা, বইপড়াসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এতে তার মানসিক চিন্তার বিকাশ ঘটছে। স্কুলের পরীক্ষায়ও ভালো করছে। ’
 
রাজাপালং ইউনিয়নের এই শিশুবান্ধব কেন্দ্রের ম্যানেজার ফেরদৌস আলম জানালেন, এই কেন্দ্রে নিবন্ধনকৃত শিশুর সংখ্যা ২ হাজার ৩২৩জন। সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এই কেন্দ্র খোলা থাকে। কেন্দ্র ম্যানেজারের দৃষ্টিতে, ছেলেমেয়েদের মেধা বিকাশের ফলে এলাকার স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার বেড়েছে। ঝরে পড়া কমেছে। শিশু নির্যাতন, বাল্য বিয়ে এমনকি নারী নির্যাতনও কমেছে।  
 
কেন্দ্র ম্যানেজারের দেওয়া তথ্যের প্রমাণ মেলে পার্শ্ববর্তী কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ বছরের ঝরে পড়ার হার থেকে। ২০১০ সালে স্কুলে ৪৫ জন ঝরে পড়লেও ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫-তে। অন্যদিকে পাশের হার ২০১০ সালে ৮৬দশমিক ৯০ শতাংশ থাকলেও ২০১৪ সালে এতে ওই হার দাঁড়ায় ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশে।  
 
শিশুবান্ধব কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা গেল, এখানে শিশুদের খেলাধুলা ও মেধা বিকাশের বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। পাশের স্কুলে পড়াশুনার পাশাপাশি শিশুরা এই কেন্দ্রে এসে বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত হয়। কেন্দ্রের সকল ইভেন্টের জন্য রয়েছে পৃথক কক্ষ। একদল লাইব্রেরি কক্ষে বই পড়ছে তো আরেক দল কোমলমতি শিশু ছবি আঁকার কক্ষে রঙ-তুলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। গোটা কেন্দ্র বর্ণিল আলপনা আর নান্দনিক কারুকাজে আকর্ষণীয় করে রাখা হয়েছে।
 
এই কেন্দ্রে সমাজকর্মী খালেদা বেগম বলেন, শিশুদের অঙ্কনের মধ্য দিয়ে ওদের মেধার বিকাশ ঘটছে। আঁকতে গিয়ে ওদের মাথায় নানান ধরনের ভাবনা আসে। ছবি আঁকায় ওরা রঙের ব্যবহার শিখে। ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে ওদের চিন্তার বিকাশ ঘটছে। অল্প সময়ের মধ্যে ওরা মেধার সাক্ষর রাখছে। যেটা এখানে না এলে সম্ভব হতো না।  
 
কুতুপালং এলাকার সঞ্জিত বড়ুয়ার ছেলে রনি বড়ুয়া এখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এই শিশুবান্ধব কেন্দ্রে আসছে ৩য় শ্রেণি থেকে। এখানে এসে ছবি আঁকায় বেশ হাত পাকিয়েছে। জলরঙে ওর আঁকা চমৎকার কিছু ছবি দেখিয়ে বললো, এখানে না এলে কখনো এগুলো শেখা সম্ভব হতো না। এখন অনেক ভালো ছবি আঁকতে পারি।   
 
এ ধরনের আরেকটি শিশুবান্ধব কেন্দ্র রয়েছে টেকনাফের জাদীমুরা এলাকায়। ওই কেন্দ্রে গিয়েও এ ধরণের দৃশ্য চোখে পড়ে। দূর থেকে দেখলে বোঝা যায় এখানে ব্যতিক্রমী কিছু হচ্ছে। ভেতর গেলে ঠিক তারই প্রমাণ মেলে। বাচ্চা আপন মনে খেলছে বিভিন্ন কক্ষে। ক্লাসের বাইরে এই কেন্দ্রে এসে ওরা মেতে ওঠে হইহুল্লোড়ে। লাইব্রেরি, আর্ট কর্নার, প্লে গ্রাউন্ড, টয় কর্নার, কম্পিউটার কর্নার, এবিলিটি বেইজ কর্নার পৃথকভাবে সাজানো রয়েছে। ঠিক উখিয়ার কুতুপালং কেন্দ্রের মতই।  
 
কেন্দ্রের শিক্ষার্থী ২য় শ্রেণির মেহেদি হাসান বললো, এখানে এসে কার্টুন দেখে মীনা-রাজুকে চিনেছে। এখানে নিয়মিত আসার ফলে অনেক বন্ধ বেড়েছে তার। একই ক্লাসের আচমা আকতারও একই অনুভূতি জানালো। ওর সবচেয়ে প্রিয় ছবি আঁকা আর পুতুল খেলা। স্কুল ছুটি হলে কিংবা বিরতির সময়ে এই কেন্দ্রে এসে মেহেদি, আচমার মত অনেকেই লেখাধুলায় অংশ নেয়।  
 
শিশুদের সুরক্ষা ও মেধা বিকাশে ব্যতিক্রমী এই শিশুবান্ধব কেন্দ্রকে হাজারো সংকটের মাঝে এক টুকরো আলোর ঝিলিক বলে মনে করেন অনেকেই। এলাকার শিক্ষক, অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবর্গ বললেন এ ধরনের উদ্যোগ শিশুদের অবস্থা যে বদলে ফেলতে পারে, তারই প্রমাণ রেখেছে এইসব শিশুবান্ধব কেন্দ্র।  
 
প্রকল্পটির নাম ‘কক্সবাজার জেলাধীন উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সুরক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি প্রকল্প’। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় এর কার্যক্রম চলছে। দুই উপজেলায় কেন্দ্র সংখ্যা ৫টি। ২০১৪ সালের ১৫ মে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০১৬ সালের ১৪ মে। এ সময়কালে কেন্দ্রগুলোতে ১৬ হাজার ৭৯২ জন শিশু ও এক হাজার ২৫০জন কিশোর-কিশোরী সামাজিক সুরক্ষা সেবার আওতাভুক্ত হবে।  
 
এনাবেলিং এনভায়রনমেন্ট ফর চাইল্ড রাইটস (ইইসিআর) প্রকল্পের অধীনে শিশুবান্ধব কেন্দ্র পরিচালনা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোডেক। আর বাস্তবায়নে সহায়তা করছে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ-বাংলাদেশ।  
 
প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার ৫টি শিশুবান্ধব কেন্দ্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ হাজার ৮২৬জন। এবিলিটি বেইজ শাখায় ছাত্রছাত্রী রয়েছে আরও ১২৫জন।  
 
কার্যক্রম সম্পর্কে প্রকল্প ব্যবস্থাপক বলেন, এই কেন্দ্র স্থাপনের ফলে পিছিয়ে থাকা এই অঞ্চলের লেখাপড়ায় ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার দিকে ঝুঁকছে। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকেরা পাচ্ছেন বিশেষ প্রণোদনা। এই কার্যক্রম এলাকায় বাল্য বিয়ে কমিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের মাত্রাও কমেছে।     
 
কোডেকের নির্বাহী পরিচালক ড. খুরশীদ আলম বলেন, উপকূল অঞ্চলের শিশুদের লেখাপড়া ও মেধা বিকাশে নানা ধরণের সমস্যা রয়েছে। এই এলাকার বহু ছেলেমেয়ে আগে স্কুলে যেত না। অভিভাবকেরা ছিল অসচেতন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি করার পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে এই কাজের ইতিবাচক সারা মিলেছে।  
 
তিনি বলেন, উপকূলের প্রান্তিক জনপদে শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে রয়েছে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে শিক্ষা সমস্যা সবচেয়ে ভয়াবহ। শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারার কারণে শিশুরা অল্প বয়সেই কাজে নেমে পড়তে বাধ্য হয়। উপকূলের সর্বত্র শিশুবান্ধব কেন্দ্র ছড়িয়ে দিতে পারলে সমস্যার অনেকখানি সমাধান সম্ভব।     

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৫
আরআইএম/এমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।