সাতক্ষীরা: ভয়াল ২৫ মে আজ। ২০০৯ সালের এই দিনে প্রলয়ংকারী জলোচ্ছ্বাস আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা উপকূলীয় এলাকা।
এ দিনে আইলার ষষ্ঠ বছর পূর্তি হলেও সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সাতক্ষীরার উপকূলীয় লক্ষাধিক মানুষ। কাজ, খাবার ও সুপেয় পানির অভাবে আইলায় বিধ্বস্ত উপকূলীয় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
টিকে থাকতে না পেরে অনেকেই চলে যাচ্ছেন অন্য কোথাও। প্রতিনিয়ত বেড়িবাঁধ ভাঙনে বাড়ছে গৃহহীনের সংখ্যা। রাস্তার অভাবে জলাবদ্ধ এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করছে হাজার হাজার মানুষ।
আইলা দুর্গত গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, খুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে বাস করছেন আইলায় গৃহহীন হয়ে পড়া মানুষ। লবণাক্ততার কারণে কৃষি কাজ নেই বললেই চলে। কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে এলাকা ছাড়ছেন অনেকেই। বেড়িবাঁধ ভেঙে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় জনপদ।
সুপেয় পানির জন্য চলছে চরম হাহাকার। কোনো মতে দূর দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করে জীবন চলছে তাদের। নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থা।
বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট গোটা উপকূল জুড়ে। প্রচণ্ড লবণাক্ততায় জনপদগুলো বৃক্ষরাজি শূন্য হয়ে পড়েছে।
জ্বালানি, খাবার পানি ও কর্মসংস্থানের সংকট মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লোনা পানির চিংড়ি চাষ।
লবণাক্ততা মোকাবেলা করে কোনো কোনো জমিতে ধান চাষ সম্ভব হলেও অধিকাংশ কৃষি জমি রয়েছে অনাবাদী। কাজ ও জ্বালানি সংকটের কারণে সুন্দরবনের ওপর চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ।
সেই সঙ্গে বেড়েছে রোগ-শোক, অপুষ্টি, বাল্য-বিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক প্রবণতা ও শিশু শ্রম। কমেছে শিক্ষার হার।
গাবুরার ইউসুফ আলী বাংলানিউজকে জানান, এলাকায় কোনো কাজ নেই। লবণ পানির চিংড়ি চাষ যত বাড়ছে কাজ তত কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, লবণ পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। নতুবা এ জনপদের মানুষ না খেয়ে মরবে। এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারবে না।
পদ্মপুকুরের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য দেবেন্দ্রনাথ মন্ডল বাংলানিউজকে জানান, আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ এখনও ঠিকমত সংস্কার করা হয়নি। যত দিন স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করা হবে, ততদিন আইলার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে না। বার বার বাঁধ ভেঙে আমাদের সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। এলাকায় লবণ পানি ঢুকলে আর ফসল হয় না। মিষ্টি পানির আধারগুলো লোনা হয়ে যায়। আর খাওয়ার পানি থাকে না।
চাঁদনীমুখা গ্রামের আছাদুল আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের নিরাপদ জীবনের জন্য সবার আগে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বাঁধ হলে যার যতটুকু সম্পত্তি আছে, তাতেই ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো। মিষ্টি পানির পুকুরগুলো আর নষ্ট হবে না। সেই পানি খেয়েই বাঁচবে মানুষ।
পানি কিনে খেয়ে কী জীবন চলে? এমন প্রশ্নও তোলেন আছাদুল।
স্থানীয় পরিবেশ গবেষক শাহীন ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এলাকায় মানুষের মধ্যে তীব্র অপুষ্টি বিরাজ করছে। আইলায় খাদ্য নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়েছে। বর্তমানে কৃষকরা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে লবণাক্ত মোকাবেলা করে আবার ধান চাষের চেষ্টা করছেন। তাদের এ প্রচেষ্টায় সরকার সহযোগিতা না করলে কোনদিনও তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এ জন্য স্থানীয় সরকারি খালগুলোর বন্দোবস্ত বাতিল করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ ও জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
এলাকায় কিছু চাষাবাদ করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি।
শ্যামনগর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী জানান, গোটা উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। মানুষ পুকুরের পানি খেয়ে বেঁচে আছে। সেটাও আবার পাওয়া যায় না। তাই খাবার পানির সংকট নিরসনে এলাকার পুকুর-জলাশয়-জলাকারগুলো পুনরায় খনন করে ব্যবহার উপযোগী ও মিষ্টি পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, যতদূর সম্ভব লোনা পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। লোনা পানির কারণে মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে আইলায় বিধ্বস্ত দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শুধু পদ্মপুকুর নয়, উপকূলীয় লাখ লাখ মানুষের নিরাপদ জীবনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ। বার বার বাঁধ ভেঙে আমাদের সব অর্জন শেষ হয়ে যায়। খাবার পানিটুকুও থাকে না।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নের কাজ চললেও এখনও আইলার ক্ষয়-ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
২০০৯ সালের ২৫ মে ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকা। ১৫ ফুট উচ্চতায় ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায়। এতে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৭৩ জন নিহত হন। গৃহহীন হয়ে পড়েন হাজার হাজার পরিবার। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৫
টিআই