সমুদ্রের নোনা জলের ঝাপটায় অপরূপ সৌন্দর্য্য নিয়ে জেগে আছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। বিকাশের ধারায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই পর্যটন কেন্দ্র।
সংকটের ভেতর দিয়েই ডানা মেলছে কুয়াকাটা। তারপরও প্রতিটি নতুন ভোরে নতুন আশাবাদ। এই বুঝি কুয়াকাটা ফিরে পেল প্রাণ। এইসব নিয়ে কুয়াকাটা উপাখ্যান শিরোনামে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ঘুরে এসে:
কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের শুধু নামটাই পড়ে আছে। প্রকৃতির তাণ্ডবে এই উদ্যান বার বার লণ্ডভণ্ড হলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। চলাচলের রাস্তায় মাটি নেই। লেকভর্তি কচুরিপানা। বিশ্রামের স্থানগুলো গবাদিপশুর দখলে।
পর্যটক আকর্ষণে তৈরি করা কাঠের সেতুটি সেই কবে থেকে ভেঙে পড়ে আছে! ভর দুপুরেও এই উদ্যানে বিরাজ করে ভুতুড়ে পরিবেশ।
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে সামান্য পূর্বে সৈকতের গা ঘেঁষে প্রায় ১৮ হাজার একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে জাতীয় উদ্যান। কুয়াকাটার পূর্ব দিকের এই অংশটা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
সূর্যোদয় দেখার জন্যে পর্যটকেরা ছুটে আসেন এখানে। আবার খানিকটা দূরে গঙ্গামতি বনের ধারের লেক পর্যটকদের বাড়তি আনন্দ জোগায়। সে হিসেবে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে বাড়তি বিনোদনে ভিন্নমাত্রা যোগ করে জাতীয় উদ্যান। কিন্তু এখানে এসে পর্যটকেরা এখন হতাশ হন।
কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের অবস্থা সরেজমিন দেখতে গিয়ে দেখা হলো কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে। এদের একজন সাইফুল্লাহ।
তিনি বললেন, অনেক আশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম কিছুটা সময় কাটাতে। কিন্তু এখানকার ভুতুড়ে পরিবেশে বেশি সময় থাকা সম্ভব হলো না। উদ্যানের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে হেঁটে একজন মানুষের সঙ্গেও দেখা মিললো না। একটু বিশ্রামের পরিবেশও পেলাম না।
সরেজমিন দেখা যায়, সমুদ্র সৈকতের কোলে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে জেগে থাকা এই ইকোপার্কটি বার বার ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হলেও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উদ্যানের ভেতরের রাস্তায় চলাচলে কাদাপানি পেরোতে হয়। নজরকাড়া দৃষ্টিনন্দন লেকটি পরিণত হয়েছে কচুরিপানা ভর্তি বদ্ধ জলাশয়ে।
লেকের চারপাশের বর্ণিল পাতাবাহার গাছগুলো এখন আর নেই। লেকের মাঝখানে কাঠের সেটি ভাঙাচোড়া কঙ্কালের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। ৬টি প্যাডেল বোটের খবর নেই।
জাতীয় উদ্যানের ভেতেরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে লেকপাড়ের পাকা ঘাটগুলো শেওলার আস্তরণে ঢেকে আছে। পিকনিক স্পটের টিনের ছাউনির সবকটি ঘর এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ ঘরগুলোতে বসে তাস খেলার আসর। গাঁজাখোরদের আসর বসে উদ্যানের বিভিন্ন স্থানে।
মনোরম এই লেকের মূল সড়কটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে কয়েক স্থানে কাদাপানি ভাঙতে হয়। এ কারণে পর্যটক-দর্শনার্থীরা এখন আর এ পথে পা মাড়ান না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, নির্জন এই উদ্যানে মানুষজন যেতে ভয় পায়। প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ইয়াবা, ফেনসিডিল, চোলাই মদসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বেচাকেনা চলে উদ্যানের বিভিন্ন স্থানে। বখাটে জুয়াড়ি আর মাতালদের মিলন মেলা বসে এখানে। বন বিভাগের উদাসীনতায় কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের এ অবস্থা হয়েছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
শুরুর দিকে চোখ ধাঁধানো সেই দৃশ্যের সঙ্গে জাতীয় উদ্যানের বর্তমান চেহারার মিল খুঁজে পান না স্থানীয় বাসিন্দারা। কুয়াকাটা পর্যটন এলাকার পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম স্থান ছিল এটি। সূর্যোদয় সূর্যাস্তের মনোরম বিরল দৃশ্য উপভোগের জন্য কুয়াকাটার সুখ্যাতি বিশ্বজোড়া। এ কারণে এখানে পর্যটক দর্শনার্থীর ঢল নামে শীত মৌসুমে। এখানে আসা পর্যটকের কাছে ইকোপার্কটি ছিল খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু সিডর-আইলার মতো সুপার সাইক্লোন কিংবা মহাসেনের মতো জলোচ্ছ্বাসে কয়েক দফা বিধ্বস্ত হয়েছে এই উদ্যান। তারপরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে সমহিমায় পর্যটক দর্শনার্থীরা ছুটতেন কুয়াকাটার এই স্পটে। খুঁজে পেতেন কুয়াকাটায় বেড়ানোর সার্থকতা। এখন শুধুই হতাশা।
কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে সৈকত লাগোয়া ইকোপার্কের অবস্থান। চারদিকে ছিল ঝাউবাগান ঘেরা। কিছুটা পর পর দেওয়া আছে বিশ্রামের বেঞ্চি। তার উপরে রয়েছে সিমেন্টের বড় ধরনের স্থায়ী ছাতা।
ইকোপার্কটি বাইরে থেকে গহীন অরণ্য মনে হলেও মাঝখান দিয়ে একাধিক চলার পথ ছিল। ছিল ছোট্ট ছোট্ট বক্স কালভার্ট। এরই মধ্যে বিশাল লেক। লেকের মাঝখান দিয়ে চলাচলের ছিল একটি কাঠের সেতু। লেকটির দুইপাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির বনজ, ফলজসহ সৌন্দর্য্য বর্ধনকারী গাছের সমাহার ছিল। স্বচ্ছ টলমলে পানির মধ্যে বনবিভাগের ফাইবার প্যাডেল বোট ছিল। এখন সে দৃশ্য শুধু কল্পনায়।
সূত্র বলছে, চার বছর আগে কুয়াকাটা ইকোপার্ক ও ফাতড়ার বনাঞ্চল এলাকা জাতীয় উদ্যানের আওতায় ন্যস্ত করা হয়। প্রায় ১৮ হাজার একর এলাকা নিয়ে উদ্যানের অবস্থান। বনাঞ্চল ছাড়াও বিশাল বনভূমি ইকোপার্কের আওতায় রয়েছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিদফতরের উদ্যোগে প্রাথমিক পর্যায়ে দুই কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করা হয়। প্রথম দফায় ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে ২১টি ধাপের মধ্যে ২০টির কাজ সম্পন্ন করতে ৬৩ লাখ টাকার ব্যয় করা হয়। পরবর্তী ধাপে করা হয় কাঠের সেতু।
ওই সময়ে প্রধান ফটক নির্মাণ, মেঠোপথ প্রশস্তকরণ, বক্স ও পাইপ কালভার্ট, ভূমির উন্নয়ন, গোল ঘর ও জেটি নির্মাণ, ফিডার রোড, কার পার্কিং সুবিধা, পিকনিক শেড, টিকিট কাউন্টার, অ্যাপ্রোচ রোড, নিরাপদ খাবার পানিসহ অভ্যন্তরীণ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, সিটিং বেঞ্চ নির্মাণ, লেক-পুকুর খনন ও বাইরের বিদ্যুতায়ন।
এছাড়া ম্যানগ্রোভসহ শোভা বর্ধনকারী বাগান, বন্যপ্রাণির আবাসস্থল উন্নয়নে বাগান সৃজন করা হয়। ৪৭ হেক্টর বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির লক্ষাধিক গাছের চারা রোপন করা হয়। এর বাইরে এক হাজার ৬৬৭টি নারিকেল চারা লাগানো হয়েছে। কিন্তু এসবের ৮০ শতাংশ নেই। শুধু মূল ফটকে একটি গেট রয়েছে। অরক্ষিত একটি সীমানা রয়েছে। গেটে কোনো নিরাপত্তারক্ষীও নেই। ভেতরে একটি পাকা টংঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে।
উদ্যানের দায়িত্বে নিয়োজিত কুয়াকাটা বনবিভাগের বিট কর্মকর্তারা এ উদ্যানের উন্নয়ন কিংবা সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি। জানালেন, এখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে উদ্যানের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
এবি
** মহাপরিকল্পনা ফাইল চাপা, সংকট সীমাহীন