এমন কোনো দৃশ্যই আপনি কল্পনা করেছেন হয়তো, এশিয়া কাপ থেকে বাংলাদেশ ছিটকে যাওয়ার পর। অথবা আপনি কল্পনা করেছেন এমন কিছু, যখন টি-টোয়েন্টিতে দলটা ধুঁকেছে দিনের পর দিন।
তিনি থ্রো করেছিলেন কাভার থেকে। ডিরেক্ট হিটে স্টাম্প ভেঙে জ্বলে উঠলো লাল আলো। মিরাজ দৌড় শুরু করলেন, যেন কেউই আজ থামাতে পারবে না তাকে। সতীর্থরা পেছন পেছন ছুটে বেড়ান এরপর। মিরাজকে জড়িয়ে ধরেন। জস বাটলারের উইকেটে ম্যাচের মোড় ঘুরে যেতে দেখেন আপনি, দেখেন ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য উন্নতিও।
সিরিজজুড়ে বাংলাদেশের ‘দল’ হয়ে উঠার গল্প শোনা গেছে। শেষে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ‘ব্যক্তিগতভাবে’ কারো প্রশংসায় রাজি হননি। তিনি দলের ভেতরে ও বাইরে ছড়িয়ে দিতে চান ‘এক’ হয়ে খেলার বার্তা। সেটির প্রতিচ্ছবিই হয়তো মিললো মিরাজের উদযাপনে।
জস বাটলার আফসোস করতে করতে মাঠ ছাড়েন যখন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখন হয়তো উঁকি দিচ্ছে নতুন সূর্য। হাহাকারের লম্বা পথ পেরিয়ে পরাজয়ের তেঁতো স্বাদ দিতে পারার তৃপ্তি। এই দলে প্রতিপক্ষকে চিড়েখুঁড়ো খাওয়ার তীব্র তাড়না। সংকল্প সব প্রতিকূলতা দূরে ঠেলে সামনে যাওয়ার।
সামনের নেতা সাকিব আল হাসান অবশ্যই। তার সঙ্গী কারা? সবার আগে আসবে নাজমুল হোসেন শান্তর নাম। প্রথম ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে জিতিয়েছেন, পরের দুটিতে ৪৬ ও ৪৭ রান করে দলের জয়ে রেখেছেন গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা; কেবল এসব কারণেই নয়। মাঠে নাজমুল হোসেন শান্ত সরব ছিলেন পুরোটা সময়।
ক’দিন আগেও গ্যালারি থেকে দুয়ো ধ্বনি আসতো নিয়মিত; এখন স্লোগান উঠে তার নামেই। শান্তও যেন দিতে চান দু হাত ভরে। ব্যাটিংয়ে পরিণত, ফিল্ডিংয়ে তার ক্ষিপ্রতা, ক্যাচের জন্য ঝাপিয়ে পড়া, প্রায়ই এসে বোলারের সঙ্গে কথা বলা, ফিল্ডিংয়ের ‘ফাইন টিউন’; সেই সাক্ষীই দিয়েছে পুরো ইংল্যান্ড সিরিজজুড়ে।
মেহেদী হাসান মিরাজ ভারতের বিপক্ষে অসাধারণ এক সিরিজ কাটিয়েছিলেন। তার ‘আত্মবিশ্বাস’ নিয়ে কখনোই সংশয় ছিল না কোথাও। নিজের ‘বিলিফ সিস্টেমের’ কথা বলেওছেন অনেকবার। মিরাজ মাঠেও দেখিয়েছেন তা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে দলেই ছিলেন না; দ্বিতীয়টিতে ফিরে ৪ উইকেট নিয়েছেন, শান্তর সঙ্গে জুটিতে রান করে হয়েছেন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়।
লিটন দাস প্রায় পুরো সিরিজজুড়েই নিষ্প্রভ থাকার পর শেষ ম্যাচে এসে খেলেছেন ম্যাচ জেতানো ইনিংস। তানভীর ইসলাম আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের কেবল তৃতীয় বলে এসেই পেয়েছেন উইকেটের দেখা। ওখানেও লিটন দাস গ্লাভস হাতে স্টাম্পিং করতে সময় নিয়েছেন কেবল ০.১৪ সেকেন্ড।
এসব নিয়ে যখন জানতে চাওয়া হলো। অধিনায়ক সাকিব তখনই যেন দিলেন আলাদা মন্ত্রের বার্তা, ‘আমি ব্যক্তিগত কোনো খেলোয়াড় নিয়ে বলতে চাই না। সবাই অসাধারণ খেলছে। যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা দরকার ছিল, করেছে। ’ এরপরই অধিনায়ক স্পষ্ট করেছেন দলের চাওয়া, ‘যারা ভালো খেলছে, আমি প্রত্যাশা করছি তারা যতদিন সম্ভব ভালো খেলতে থাকুক। যারা হয়তো এত ভালো অবদান রাখতে পারিনি, তারা যদি ১০-১৫শতাংশ বেশি রাখতে পারে; তাহলে আমরা আরও ভালো দল হবো। ’
সাকিব দলকে নিয়ে কতটুকু উচ্ছ্বসিত, তার বার্তাও এসেছে সংবাদ সম্মেলনে। ফিল্ডিংয়ের প্রশ্ন পুরোপুরি না শুনেই শুরু করেছিলেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, এরপর তিনি বললেন, ‘এশিয়ার সেরা ফিল্ডিং দল হতে চাই’ উত্তরের শেষে এসে আবার বললেন, ‘আমরাই সম্ভবত সেরা ফিল্ডিং দল। ’
কিন্তু যে সিরিজ জয় নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, এমন উপলক্ষ তো আগেও এসেছে দেশের ক্রিকেটে। নিউজিল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারিয়েছিল বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়াকে; মাস কয়েক পরে অ্যারন ফিঞ্চের দল জিতেছে বিশ্বকাপও। তাহলে এই দল কেন আলাদা? মাঠে প্রমাণ মিলেছে অবশ্যই। সাকিবের কাছে?
‘আসলে তুলনা করতে চাই না কোনো সিরিজের সঙ্গে কোনো সিরিজ। প্রতিটা ম্যাচ জেতা আমাদের জন্য জেতা গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে খেলে জিতেছি, বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে খুব বেশি সময় এমন করিনি। ’ কেন এই দল আলাদা, তার প্রমাণ বোধ হয় সাকিবের ‘খুব বেশি সময় করিনি’ কথাতে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে অবসংবাদিত ‘সেরা’ সাকিব। বাকি ক্রিকেটারদের ভেতর ‘সেরা’ হওয়ার তাড়না না থাকার আফসোস কান পাতলে শোনা যায় প্রায়ই। এবার ‘সেরা সাকিবই’ তার অধিনায়কত্বের দলকে ‘জেতার চেয়ে ভালো ক্রিকেট’ খেলার ও ‘সেরা’ হওয়ার বার্তা দিচ্ছেন। তবুও কি দল কক্ষপথে ফিরবে না? ইংল্যান্ড সিরিজ দেখে আশা অন্তত একটু দেখা যায়।
শেষে একটা ঘটনা বললে বোধ হয় অবস্থাটা স্পষ্ট হবে। বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ করে ট্রফি পেয়েছে। ক্রিকেটাররা সবাই উচ্ছ্বসিত। আফিফ হোসেন তাদের দলেই আছেন। কিন্তু এই ক্রিকেটারের জন্য দিনটি বিষণ্নতায় ছেয়ে যাওয়ারও।
রেকর্ড টানা ৬১ ম্যাচ খেলার পর একাদশ থেকে ‘বাদ’ পড়েছেন তিনি। বাকিরা যখন ট্রফি হাতে উচ্ছ্বাসে ভাসতে ভাসতে ড্রেসিংরুমের পথ ধরেছেন, আফিফ তখন হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। তাদের দীর্ঘ আলোচনার চললো লিটন দাসের ড্রেসিংরুম থেকে ফিরে এসে ব্রডকাস্টারদের ইন্টারভিউ দেওয়া পর্যন্ত।
হাথুরু ড্রেসিংরুমে ফিরলেন শেষ অবধি আফিফকে সঙ্গে নিয়ে। তার কাঁধে হাতও রাখলেন একটা সময়। হয়তো বললেন, ‘এই দলটা পারফরমারদের। তোমার সামর্থ্য আছে, ফিরে এসো দ্রুত। ’ এই দলটা যদি সত্যিই এমন খেলতে থাকে- বাংলাদেশ ক্রিকেট নতুন সূর্যোদয়ের আশা করতেই পারে।
বাংলাদেশ সময় :
এমএইচবি