আয়ের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সফটওয়্যার কোম্পানি ওরাকল। সেখানেই টেকনিক্যাল স্টাফের প্রিন্সিপাল মেম্বার হিসেবে কর্মরত সৌরভ নেত্রভালকর।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, মোটো জিপি, ফর্মুলা ওয়ানের মতো খেলায় স্পন্সর করলেও ক্রিকেটের সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক নেই ওরাকলের। কিন্তু তাদেরই এক প্রকৌশলীর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেট পৌঁছে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। গড়েছে ইতিহাস। সেই তিনিটা হলেন নেত্রভালকর। ফুলটাইম প্রকৌশলী হওয়ার পাশাপাশি যিনি ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন সমানতালে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এবারই প্রথমবার খেলছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে যৌথভাবে এবারের আসর আয়োজন করছে তারা। বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথমবার মাঠে নেমেই হারিয়ে দেয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কানাডাকে। গতকাল তো ইতিহাসই গড়ে ফেলল। টুর্নামেন্টের অন্যতম পরাশক্তি পাকিস্তানকেও পরাজয়ের স্বাদ দিয়ে জন্ম দেয় অঘটনের।
সুপার ওভারের নাটকীয়তার ম্যাচে আগে ব্যাট করে ১৫৯ রান করে পাকিস্তান। তাড়া করতে নেমে ২০ ওভার শেষে সেই রান অবিশ্বাস্যভাবে ছুঁয়ে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। তাই খেলা গড়ায় সুপার ওভারে। যেখানে পাকিস্তানের জন্য ১৯ রানের লক্ষ্য দাঁড় করায় স্বাগতিকরা। আর সেই রান আটকানোর দায়িত্ব পড়ে নেত্রভালকরের কাঁধে। বাঁহাতি এই পেসার হতাশ করেননি। পাকিস্তানকে ১৩ রানে আটকে দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই নিজের পরিচয়টাও তুলে ধরেছেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বের বুকে।
নাম শুনলে স্বভাবতই আমেরিকান বলে মনে হবে না। মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটার ভারতের হয়ে খেলেন ২০১০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। সেই আসরে দলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন তিনি। বর্তমানে পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজমও সেই আসরে খেলেছিলেন তার বিপক্ষে।
এরপর যেমনটা হয়ে থাকে, অন্যান্য ক্রিকেটারের মতো জাতীয় দলের খেলার স্বপ্ন দেখতে থাকেন নেত্রভালকর। বিশ্বকাপের সেই পারফরম্যান্সই আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল তার মনে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, শতকোটি জনসংখ্যার ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাওয়াটা বেশ কঠিন।
সতীর্থ লোকেশ রাহুল, মায়াঙ্ক আগারওয়ালদের যখন ভারতের জার্সিতে খেলতে দেখেছেন, তখন কিছুটা হলেও হতাশা কাজ করে নেত্রাভালকরে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত চেষ্টা করে গিয়ে একটা পর্যায়ে হালটা ছেড়েই দেন তিনি। পেশা হিসেবে কাজে লাগাতে শুরু করেন মুম্বাইয়ের সর্দার প্যাটেল থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে প্রাপ্ত স্নাতক ডিগ্রিকে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে সুযোগ আসে একই বিষয়ে মাস্টার্স করার। সেখানেও অবশ্য ক্রিকেটের ছোঁয়া আছে।
২০১৪ সালে ক্রিকডিকোড নামে এক অ্যাপ তৈরি করেন নেত্রভালকর। যার মাধ্যমে ক্রিকেটাররা নিজেদের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তার এই সৃষ্টি এনে দেয় কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক। নেত্রভালকর তাই আর অন্য কিছু না ভেবে লুফে নেন তা।
২০০৯ সালে ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমিতে যুবরাজ সিংকে বোল্ড করে আলোচনায় আসা বাঁহাতি এই পেসারকে ক্রিকেট আর ভাবায়নি। মাস্টার্সের ভালো ফলের জেরে পরের বছরের বিখ্যাত ওরাকল কোম্পানিতে চাকরি মেলে তার। আরেকজন সাধারণ মানুষের মতোই সপ্তাহে ৫ দিন কর্মব্যস্ততায় কাটছিল। কিন্তু সেখানে থাকা ভারতীয় অভিবাসীদের সঙ্গে বন্ধন গড়ে তুলতে পারছিলেন না। সেজন্য ক্রিকেটকেই বেছে নেন নেত্রভালকর। এভাবে খেলতে খেলতে বন্ধ থাকা দরজাটা আবারও খুলে ফেলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার স্বপ্নটাও জেগে ওঠে আবারও।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ নর্থ-ওয়েস্ট অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করেন নেত্রভালকর। এরপর জানতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য ন্যূনতম তিন বছর দেশটিতে বসবাস করতে হবে তাকে। বাঁহাতি এই পেসার তাই আবারও পুরোদমে ক্রিকেটে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ওরাকলে কাজ করার পাশাপাশি ছুটির দিনগুলোতে ব্যস্ত থাকতেন ক্রিকেট নিয়ে।
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র একাদশের বিপক্ষে এক প্রস্ততি ম্যাচে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার হয়ে ৩০ রানে ২ উইকেট নেন নেত্রভালকর। তার বোলিং দেখে মুগ্ধ হন কোচ পুবুদু দাসানায়েকে।
একের পর এক ধাপ পেরিয়ে ২০১৯ সালে অবশেষে পূরণ হয় নেত্রভালকরের স্বপ্ন। পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে খেলে ফেলেছেন ৪৮ ওয়ানডে ও ২৯ টি-টোয়েন্টি। বিশ্বকাপ খেলতে আসেন অফিস থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ছুটি নিয়ে। সবশেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে পাকিস্তানকে হারানোর নায়ক হয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট রূপকথায়।
কম্পিউটার প্রকৌশলী হিসেবে অনেক সফটওয়্যারের আপডেটের পেছনে শ্রম দিয়েছেন নেত্রভালকর। গতকাল তার হাত ধরেই নতুন এক 'আপডেট' পেল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট। অচেনা খেলাটিকে দেশের মানুষের কাছে 'ইনস্টল' করিয়ে দিতে হয়তো এই আপডেটটি কাজে লাগবে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০২৪
এএইচএস