ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

কলুষিত ক্রিকেটের মুক্তির দিন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৯
কলুষিত ক্রিকেটের মুক্তির দিন ছবি:সংগৃহীত

কথায় আছে ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা, কিন্তু একটা সময় দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার ক্রিকেটকে গায়ের রঙে বিবেচনা করেছিল, কলুষিত হয়েছিল ভদ্রলোকের খেলাটি। তার খেসারত দিতে হয়েছিল দেশটির ক্রিকেটকে। প্রোটিয়ারা শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেই খেলবে, দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার এমন ন্যাক্কারজনক ঘোষণা দিয়েছিল। দেশের সরকারের এমন বর্ণবাদ নীতির কারণে ১৯৭০ সালে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে স্থগিতাদেশ প্রদান করে। ২১ বছর তারা বিশ্ব ক্রিকেটের অঙ্গনে নিষিদ্ধ ছিল।

এর ফলে, গ্রায়েম পোলক, ব্যারি রিচার্ডস, মাইক প্রোক্টরের মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বঞ্চিত হন। অ্যালান ল্যাম্ব, রবিন স্মিথের মতো উদীয়মান ক্রিকেটাররাও অভিবাসিত হয়ে ইংল্যান্ড এবং কেপলার ওয়েসেলস অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলেন।

লুকিয়ে ইংল্যান্ডে খেলতে হয়েছিল বাসিল ডি অলিভিয়েরাকে। তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার ‘শ্বেতাঙ্গ সরকার’ কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে দলে সুযোগ দিত না। শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্য অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারেনি। ঘরোয়া লিগে শুধুমাত্র কালো বলে তাদের জন্য আলাদা লিগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখনকার সরকার। কিস্তু, কালোদের জন্য আলাদা লিগ হলেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত মাঠ দেওয়া হত না, মাঠে প্রবেশের ক্ষেত্রেও ছিল অনেক বিধিনিষেধ। অশ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ কোনো ক্রিকেটারই প্রথমশ্রেণীর ম্যাচ খেলতে পারতেন না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন লিজেন্ড ক্রিকেটারদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে না পারার দায়টা তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারকেই দেওয়া যেতে পারে।

১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতা দখল করে শ্বেতাঙ্গ সরকার। শ্বেতাঙ্গদের জন্যেই ছিল সকল সুযোগ-সুবিধা। ১৯৬৪ সালে বর্ণবাদী নিয়মের কারণে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি টোকিও অলিম্পিকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ করে। সেবার ৬২ জনের অলিম্পিক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, তবে সেই তালিকায় কালো বর্ণের কোনো অ্যাথলেট ছিলেন না। অলিম্পিক কমিটি দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫০ দিনের সময় বেধে দিলেও তারা বিষয়টি আমলে নেয়নি। ফলে সে বছর অলিম্পিকে নিষিদ্ধ থাকতে হয় প্রোটিয়াদের। সে বছর ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফাও নিষিদ্ধ করে দেশটিকে।

বর্ণবাদী নীতির কারণে প্রোটিয়া জাতীয় দলে কালোদের ঠাঁই হতো না। মাত্র ৯ বছর বয়সেই স্কুল ক্রিকেটে প্রতিপক্ষের ১০ উইকেট নেওয়ার সাথে সাথে ব্যাট হাতে ১১৭ রান করা গ্রায়েম পোলক হারিয়ে গিয়েছিলেন নিষেধাজ্ঞার কারণে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে শতক হাঁকানো এই লিজেন্ড সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে গড়েছিলেন সেই রেকর্ড। রেকর্ড বুকে যার নাম অক্ষত ছিল প্রায় ৩০ বছর। মাত্র ২৩ টেস্টের ক্যারিয়ারেই নিজেকে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানের তালিকায় নিয়ে গেছেন এই কিংবদন্তি। আইসিসি তাকে ২০০৯ সালে ক্রিকেটের ‘হল অব ফেইমের‘ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

সাদা হলেও বর্ণবাদের কারণে আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় ১৯৭০ সালেই তার ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল। নিজের শেষ টেস্ট সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার ক্যারিয়ার সেরা ২৭৪ রানের ইনিংসের সুবাদে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৮৭ সালে ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ২৬২টি প্রথমশ্রেণীর ম্যাচে ৫৪.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ২০ হাজার ৯৪০ রান করেন ৬৪টি শতক এবং ৯৯ টি অর্ধশতকের সাহায্যে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সীমিত ওভারের ম্যাচ খেলার ভাগ্য না হলেও ঘরোয়া লিগে ১১৮টি লিস্ট-এ ম্যাচে ৫০.০৬ ব্যাটিং গড়ে ৪৬৫৬ রান করেছেন। আর আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে এখনো সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড়ে রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় চার নম্বরে আছেন পোলক (৬০.৯৭)। বর্ণবাদের কারণে সাদা হয়েও গ্রায়েম পোলকের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, এরপর তার ভাতিজা শন পোলকের মাধ্যমে প্রোটিয়ারা পেয়েছে অনেক কিছুই। শন পোলক দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮২৯ উইকেট এবং ৭৩৮৬ রানের মালিক হয়েছিলেন।

আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কারণে হারিয়ে গিয়েছিলেন বাসিল ডি অলিভিয়েরার মতো লিজেন্ড ক্রিকেটার। যিনি খেলার জন্যই জন্মভূমি ত্যাগ করেছিলেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে যিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে ৮২টি সেঞ্চুরির মালিক হয়েছিলেন। গায়ের রং কালো বলে তাকে খেলতে দেওয়া হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার দলে। ক্রিকেটের টানে শেষ পর্যন্ত বয়স লুকিয়ে ইংল্যান্ডে খেলতে চলে যান তিনি। অল আউট অ্যাটাক ব্যাটিংয়ের পথ প্রদর্শক খ্যাত এই তারকা ইংলিশ জাতীয় দলেও ঠাঁই করে নেন। অথচ কালো বলে অলিভিয়েরার এসব রেকর্ড কখনো পত্রিকার শিরোনামে আসেনি। তার এসব কীর্তি ক্রিকেট বিশ্ব তো দূরের কথা তার নিজের দেশের মানুষও জানতে পারেননি। ১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে দক্ষিন আফ্রিকান ‘কালো’ জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি কেনিয়া আর পূর্ব আফ্রিকা সফর করে দুর্দান্ত ব্যাট করেছিলেন। কিন্তু অশ্বেতাঙ্গ বলে তাকে জাতীয় দল তো দূরে থাক প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটও খেলতে দেওয়া হয়নি। অথচ ইংলিশ ঘরোয়া লিগে প্রথমশ্রেণীর ৩৬৭ ম্যাচে ৪৫টি শতক এবং ১০১টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪০.২৬ ব্যাটিং গড়ে ১৯ হাজার ৪৯০ রান করেছেন তিনি। বল হাতে ৫৫১ উইকেট নিয়েছিলেন।

১৯৬৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসার কথা ছিল ইংল্যান্ড জাতীয় দলের। ইংলিশদের হয়ে নিজ দেশে খেলতে আসার কথা ছিল অলিভিয়েরার। তবে আফ্রিকা সরকার জানিয়ে দেয়, তারা কোনো কালো বর্ণের ক্রিকেটারকে আতিথেয়তা দেবে না। অনেক জল ঘোলা হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাতিল হয় ইংল্যান্ডের সেই সফর। বর্ণবাদী নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। আগের সিরিজেই অস্ট্রেলিয়াকে ৪-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করলেও ক্রিকেট খেলুড়ে সব দেশই প্রোটিয়াদের নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দেয়।

গ্রায়েম পোলক-অলিভিয়েরার মতো মাইক প্রোক্টরও ছিলেন প্রতিভাবান ক্রিকেটার। ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করলেও প্রোক্টরের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ হওয়ার সাথেই। এরপর ক্যারিয়ারের বাকিটা সময় রোডেশিয়া, গ্লোস্টারশায়ার, নাটাল, ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স, ওরেঞ্জ ফ্রি স্টেইটের হয়ে খেলে কাটিয়ে দেন। দক্ষিণ আফ্রিকা যখন নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করে তার কয়েকবছর আগে ক্রিকেটকে বিদায় জানান প্রোক্টর। অথচ, প্রোক্টর ৪০১টি প্রথমশ্রেণীর ম্যাচে ৪৮টি শতক এবং ১০৯টি অর্ধশতকের সাহায্যে ২১ হাজার ৯৩৬ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ১ হাজার ৪১৭ উইকেট। লিস্ট-এ ক্রিকেটে ২৭১ ম্যাচে ৬ হাজার ৬২৪ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ৩৪৪ উইকেট।

এত অবতরণিকা টানার কারণ আজ ১০ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের ১০ মার্চ সে সময় নিজেদের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর ২১ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর ফিরেছিল প্রোটিয়ারা। একজন কালো মানুষের অনুরোধেই আবার ক্রিকেটে ফেরার সুযোগ পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা। যিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি। তার হাত ধরেই দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার কর্তৃক দেশ পুণর্গঠনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯১ সালে আইসিসি দলটির বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে। ২১ বছর পর প্রথমবারের মতো ১০ নভেম্বর, ১৯৯১ সালে ভারতের বিপক্ষে কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরে দক্ষিণ আফ্রিকা।

এরপর প্রোটিয়াদের নাম উজ্জ্বল করেছেন শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার গ্রায়েম স্মিথ, ডি ভিলিয়ার্স, অ্যালান ডোনাল্ড, জ্যাক ক্যালিস, হ্যানসি ক্রোনিয়ে, গ্যারি কারস্টেন, হাশিম আমলা, ডেল স্টেইনদের মতো তারকারা। পাশাপাশি কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে মাখায়া এনটিনি, কাগিসো রাবাদা, ভারনন ফিল্যান্ডার, জেপি ডুমিনিরা এগিয়ে নেন প্রোটিয়া ক্রিকেটকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৯
এমআরপি/এমএমএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।