ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

নানা ঘটনায় সরগরম ছিল চট্টগ্রামের আদালতপাড়া

মিনহাজুল ইসলাম,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২২
নানা ঘটনায় সরগরম ছিল চট্টগ্রামের আদালতপাড়া ...

চট্টগ্রাম: বিদায় নিচ্ছে ২০২২। বেশকিছু আলোচিত বিষয় নিয়ে এ বছর চট্টগ্রামের আদালত ছিল দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে।

বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল বিনাদোষে লোহাগাড়ার জানে আলম হত্যা মামলা, বিনা দোষে কারাগারে কনডেম সেলে থাকা আবুল কাশেম, অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় সাবেক ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের রায়, মিতু হত্যা মামলায় সাবেক এসপি বাবুল আক্তারসহ সাতজনের নামে অভিযোগপত্র, মাদকের মামলায় কারাবাসের বদলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, আসামি না হয়েও কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ঘোরা বশর, আদালতে বিয়ে, মিথ্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দুই এসআইয়ের বিরুদ্ধে বিচারকের মামলা।  

কনডেম সেলে কাশেমের ৭ বছর
গত ৩ আগস্ট লোহাগাড়া থানার জানে আলম হত্যা মামলার আসামি আবুল কাশেম বেকসুর খালাস পাওয়ার পরও ৭ বছর ৩ মাস ১১ দিনেও রায়ের কপি পৌঁছেনি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে।

এই সংবাদ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে প্রকাশের পরদিন হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর বেঞ্চে বিষয়য়টি উপস্থাপন করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। হাইকোর্টের এই বেঞ্চ আবুল কাশেমের বিষয়ে বিচারিক অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত ১০ আগস্ট ৭ বছর পর আবুল কাশেমের খালাসের আদেশের কপি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছালে কনডেম সেল থেকে তাকে সাধারণ বন্দী ওয়ার্ডে রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে আরও একটি হত্যা মামলা বিচারাধীন রয়েছে।  

প্রদীপ ও চুমকি কারনের রায়
গত ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ২০ বছর ও তার স্ত্রী চুমকি কারনকে ২১ বছর কারাদণ্ড দেন। ১৮ জুলাই একই আদালতে এ মামলায় দুদক পক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি চুমকির বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলেও প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিপরীতে উচ্চ আদালতে একটি আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় ঐদিন সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। পরে গত ৪ এপ্রিল প্রদীপের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলায় দুদকের পক্ষে ২৪ জন সাক্ষী ও আসামিপক্ষের ২ জন সাফাই সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলার শুরু থেকে চুমকি কারন পলাতক থাকলেও গত ২৩ মে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণের শেষদিন তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।  

মিতু হত্যা মামলায় বাবুলসহ সাতজনের নামে অভিযোগপত্র
গত ১৩ সেপ্টেম্বর মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারসহ ৭ জনকে আসামি করে আদালতে ২ হাজার ৮৪ পৃষ্ঠার চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বাবুল আক্তারের করা মামলায়ও ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি বাবুলকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। গত ৬ মার্চ মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দেওয়া হয়।  গত ৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুন্নেছার আদালতে পিবিআই হেফাজতে থাকার সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দাবি করে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন স্ত্রী হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা বাবুল আক্তার। পরে আদালত আবেদনটি খারিজ করে দেন। গত ১৭ অক্টোবর নগরের খুলশী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে বাবুল আক্তার, প্রবাসী সাংবাদিক ও ইউটিউবার ইলিয়াসসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর ইনচার্জ পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা।

মাদকের মামলায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার রায় 
গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে নগরের বন্দর থানায় এক কেজি গাঁজা উদ্ধারের মামলায় অভিযোগ গঠনের দিন দোষ স্বীকার করেছিলেন দুই আসামি। দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় কারাদণ্ডের পরিবর্তে এক বছর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ও দুইটি এতিমখানায় দুইজনকে বাংলা অনুবাদসহ দুইটি কুরআন শরিফ দেওয়া আদেশ দিয়ে এক বছরের প্রবেশনে মুক্তি দেন আদালত। গত ১৪ জুন একই আদালত মানহানি মামলায় ফাহমিদা রহমান নামে এক কণ্ঠশিল্পীকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ডের বদলে ছয় মাসের প্রবেশন দিয়েছিলেন। প্রবেশনের এ সময়ে আসামি নগরের খুলশী নজরুল অ্যাকাডেমিতে ছয় মাস গান শিখাবেন, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আসামির (ফাহমিদা) গাওয়া দুইটি গানের সম্মানী (টাকা) নিয়ে সে টাকায় কবি নজরুলের লেখা বই অথবা তাঁকে নিয়ে লেখা বই জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।  

আসামি না হয়েও কারাদণ্ডে দণ্ডিত বশর
আসামি না হয়েও মাদকের মামলায় ১০ বছর কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন নুরুল বশর।  বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত রোহিঙ্গা নাগরিক জোহর আলম দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে পরিচয় গোপন করতে নিজের নাম-ঠিকানা হিসেবে নুরুল বশরের ঠিকানা দেওয়া হয়। আটক হওয়ার আগে বশরের পাড়ায় দিনমজুরের কাজ করার সুবাদে নুরুল বশরের সঙ্গে পরিচয়, তারই সূত্রে নুরুল বশরের নাম-ঠিকানা জানতো মাদক কারবারি জোহর আলম। তিনি মিয়ানমারের নাগরিক। বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফ থানার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন ২ নম্বর ওয়ার্ড বালুখালি সৈয়দের বাড়ির বাসিন্দা। নুরুল বশর দাবি করেন, কোনদিন কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম কারাগারে যাইনি। আমাদের এলাকার আব্দুল আলিম গ্রেফতার হয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে যায়। সেখানে মিয়ানমারের নাগরিক জোহর আলম আমার নাম ব্যবহার করে কারাগারে যাবতীয় কাজ করে। পরে কারাগার থেকে বের হয়ে আব্দুল আলিম বিষয়টি আমাকে জানায়। আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি।  জোহর আলম কারাগার থেকে জামিন পেয়ে বের হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। নুরুল বশরের পক্ষে সংশ্লিষ্ট আদালতে একটি আবেদন করা হয়েছিল। আদালত আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন, কিন্তু বশর আদালতে যাননি।  

আদালতে বিয়ে
গত ১৭ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহমেদ ভূঞার আদালতে ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার মো. সাগর ও রাজিয়া (ছদ্মনাম) ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার কাবিনে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরে মামলার বাদীর জিম্মায় মো. সাগরের জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে বিয়ে হলেও দীর্ঘদিন কাবিননামা রেজিস্ট্রি করা হয়নি। পরে স্ত্রী আদালতে মামলা করলে এই মামলায় স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়।  

দুই এসআইয়ের বিরুদ্ধে বিচারকের মামলা 
গত ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা মামলা দায়ের, মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ায় অভিযোগে পুলিশের দুই উপ পরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন শিশু আদালত এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর চট্টগ্রামের বিচারক ফেরদৌস আরা।  ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দুইটি সোনার বার পাচারের অভিযোগে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার বাটারফ্লাই পার্ক থেকে মো. নাজমুল হাসান জুয়েল নামে এক শিশুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পরের দিন ওই শিশুর বিরুদ্ধে এসআই আনোয়ার হোসেন বাদি হয়ে সোনার বার পাচারের মামলা করে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পতেঙ্গা থানার এসআই সুবীর পাল। তদন্ত শেষে শিশু নাজমুলকে অভিযুক্ত করে একই বছরের ৩ অক্টোবর আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। পরে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে চলতি বছরের গত ৪ সেপ্টেম্বর শিশুটি নির্দোষ বলে রায় দেন আদালত। এ মামলায় শিশুটি সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল তারিখ থেকে ১ মাস ৬ দিন জেল হাজতে আটক থাকার পর একই বছর ২৮ মে জামিন পায়। বর্তমানে ছেলেটি একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২২
এমআই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।