ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ আশ্বিন ১৪৩২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ঠেকানো যাচ্ছে না স্ক্র্যাপ চুরি 

মিনহাজুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৪৮, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫
ঠেকানো যাচ্ছে না স্ক্র্যাপ চুরি  ...

চট্টগ্রাম: কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না স্টিল মিলের ইস্পাত তৈরির জন্য বিদেশ থেকে কাঁচামাল হিসেবে আনা স্ক্র্যাপ আয়রন চুরি। বন্দর থেকে কারখানায় পরিবহনের সময়ে রাস্তায় চুরি কিংবা লুট করা হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার স্ক্র্যাপ।

 

মামলা, আটক, গ্রেপ্তার, টহল কোনোকিছুই দমাতে পারছে না চোর চক্রের সদস্যদের। বাধা দিতে গিয়ে ঘটছে হামলা কিংবা হত্যার মত ঘটনা।

এমনকি পরিবহনের সময় পুরো ট্রাক লুট করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এই চুরিতে জড়িত আছে মাদকসেবী, পথশিশু এবং চোর চক্রের সদস্যরা। তারা চুরি করা স্ক্র্যাপ বিক্রি করে ভাঙ্গারি দোকানগুলোতে। তাদের ছত্রছায়ায় আছে বিভিন্ন এলাকার বড় ভাই।

চট্টগ্রামের ইস্পাত উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মাথাব্যথার কারণ এখন এই চুরি। চুরি ঠেকাতে তারা বাধ্য হয়ে সড়কের মোড়ে মোড়ে বসিয়েছে পাহারা। নিজেদের আমদানি করা স্ক্র্যাপ আবার কিনতে হচ্ছে খোলাবাজার থেকে। চট্টগ্রামের কেএসআরএম, বিএসআরএম, জিপিএইচ ইস্পাত, একেএস, সীমা, আরএসআরএম ও মোস্তফা হাকিম স্টিল মিলসসহ অনেক কোম্পানি ইস্পাত তৈরির জন্য বিদেশ থেকে কাঁচামাল হিসেবে পিগ আয়রন আমদানি করে। ট্রাকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে ডাম্প ট্রাক ও লং, ভেহিক্যালে সীতাকুণ্ডণ্ডের কারখানাগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পরিবহন সময় রাস্তায় ঘটছে চুরির ঘটনা।

২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর জিপিএইচ ইস্পাতের ১৫ টন স্ক্র্যাপবাহী একটি ডাম্প ট্রাক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে থামিয়ে লুটের ঘটনা ঘটে। পরে গাড়ি উদ্ধার হলেও মালামাল পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানায় মামলা হলে গ্রেপ্তার হয় ট্রাক চালক।  

পুলিশ, ইস্পাত উৎপাদনকারীদের সাথে বলে জানা গেছে, নগরীর মাঝির ঘাট থেকে নাহার বিল্ডিং, বারেক বিল্ডিং হয়ে পোর্ট কানেটিং রোডের নিমতলা, পোর্ট কলোনি, মন্সুর মার্কেট, বড়পোল, আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের মাথা, আনন্দবাজার জেলে পাড়া, সাগরিকা, বায়েজিদ লিংক রোড এলাকায় ঘটছে চুরির ঘটনা। বাধা দিলে ড্রাইভার ও হেলপার কিংবা ইস্পাত কারখানার নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর হামলা হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে লুটের ঘটনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সরকার পতনের পর তার পরিধি বেড়েছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

ইস্পাত কারখানা এবং চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের মে মাস থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে ২০ লাখ ৯২ হাজার টন স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়েছে। আমদানি করা এসব স্ক্র্যাপ বন্দরের বারিক বিল্ডিং ১ নম্বর গেট এবং ২ নম্বর গেট থেকে খালাস করে পোর্ট কানেক্টিং রোড হয়ে কারখানাগুলোতে যাচ্ছে। প্রতিদিন শত শত ডাম্প ট্রাক, ট্রলির মাধ্যমে পরিবহন করা হচ্ছে।  

পরিবহনের সময় স্ক্র্যাপ চুরি এবং লুটের ঘটনায় গত ১২ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সঙ্গে বিশেষ নিরাপত্তা সভায় ইস্পাত ব্যবসায়ীরা বলেছেন, স্ক্র্যাপ পরিবহনে নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীর পাশাপাশি বিভিন্ন সিকিউরিটি কোম্পানি থেকে লোক ভাড়া করা হয়েছে। কোম্পানিগুলোকে স্ক্র্যাপ নিরাপত্তা দিতে খরচ করতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। যার প্রভাব পড়ছে উৎপাদন খরচে আর এর ফলে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ছে ইস্পাতের। সভায় ১১ দফা সিদ্ধান্ত নিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানিয়েছেন ইস্পাত কারখানার মালিকরা।

এদিকে গত দুইমাস দিন ও রাতে নগরের পোর্ট কানেকটিং রোডের বিভিন্ন পয়েন্টে নিমতলা বিশ্বরোড থেকে এ কে খান মোড় পর্যন্ত জিপিএইচ, বিএসআরএমসহ নানা কোম্পানির লোকদের লাঠি হাতে নিরাপত্তার দায়িত্বে দেখা গেছে। দিনে এবং রাতে রোটেশন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেন তারা। রাতে যুক্ত হয় গাড়ির টহল। রাস্তার বেহাল দশার কারণে ধীরে ধীরে গাড়ি চললে সেখানে দৌড়ে গিয়ে চেক করছেন নিরাপত্তা কর্মীরা। অনেক সময় ১০ থেকে ১২টি গাড়ি একসঙ্গে চলাচল করতে দেখা গেছে স্কট নিয়ে।

জিপিএইচ ইস্পাতের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (নিরাপত্তা) স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) মো. রবিউল ইসলাম চৌধুরী রবি বাংলানিউজকে বলেন, কিশোর গ্যাংরা মাঝেমধ্যে ও বিক্ষিপ্তভাবে স্ক্র্যাপ পরিবহন ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। আমরা পুলিশ ও প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে আগাম সতর্কতা, দ্রুত ফিডব্যাক-মেকানিজম ও নিজেদের মধ্যে সহায়ক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছি। পুলিশ আমাদের সহায়তা করছে, তবুও এটি বেগবান করতে সরকার আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ভালো হয়। যেমন: প্রতি মাসে উপজেলা/থানা ও কোম্পানির সম্মিলিত নিরাপত্তা সমন্বয় বৈঠক বজায় রাখা। অনলাইন গ্রুপের মাধ্যমে রিয়েলটাইম ডিউটি শেয়ারিং এবং জরুরি রিপোর্টিং চালু রাখা। চুরি-ছিনতাই বৃদ্ধি পেলে পুলিশ-প্রাইভেট সেক্টর যৌথ রেইড ও কনবিং অপারেশন দ্রুত কার্যকর করা। ঝুঁকিপূর্ণ যুবদের চিহ্নিত করে ভোকেশনাল ট্রেনিং, জীবনদক্ষতা ও মনোনিবেশমূলক মেন্টরিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করা-অ্যাপ্রেন্টিসশিপ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অনুদানসহ। প্রতিষ্ঠানের কমিউনিটি আউটরিচের মাধ্যমে সামাজিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি গ্রহণ করা (স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা)। পরিবহন ও চালান নিরাপত্তায় প্রযুক্তি ও ভরসাযোগ্য প্রহরায় বিনিয়োগ বাড়ানো (জিপিএস, কনভয় প্রটোকল, নিবন্ধিত চালক তালিকা)। জরুরি হটলাইন ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া ইউনিট গঠন-শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২৪/৭ কল সাপোর্ট। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে স্ক্র্যাপ সম্পর্কিত ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক প্রভাব উপস্থাপন করে দৃঢ় নীতিগত সমাধান দাবি করা।

এছাড়াও স্ক্র্যাপ অপারেশনের ক্ষেত্রে যে রুট ব্যবহার করা হয় সেখানে ডিসি সাউথ এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী সম্পূর্ণ রাস্তায় বিশেষ নিরাপত্তা জোরদারের জন্য সিসিটিভি লাগানোর প্রস্তাব রয়েছে যা সম্পন্ন হলে এই এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন ঘটবে। রোড নেটওয়ার্ক এর উন্নয়ন প্রয়োজন, যেখানে কনস্ট্রাকশন চলছে সেখানে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আইনের সাইন পোস্টিং এবং পুলিশি টহল জোরদার করা হলে ট্রাফিক বা কনস্ট্রাকশন সাইটের ক্ষেত্রে গাড়ির স্লো হলেও কেউ চুরি করার সাহস বা সুযোগ পাবে না। স্থানীয় পুলিশ, কোম্পানি ও সামাজিক উদ্যোগ একসাথে থাকলে অপরাধ কমবে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং দুর্বল ও কর্মহীন যুবকদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

চুরি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনার বিষয়ে একাধিক ইস্পাত কারখানার কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন পরিবহনের সময় কয়েক টন স্ক্র্যাপ চুরি হয়ে যাচ্ছে। কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা গ্যাংয়ের হামলার শিকার হয়। আমরা কাউকে হাতেনাতে ধরতে পারলে বা আমাদের কর্মীদের ওপর হামলার পর পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। কিন্তু ছোটখাটো চুরির ঘটনায় সাধারণত উল্লেখযোগ্য কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। চুরিতে এদের বড় গ্রুপ আছে। এলাকাভিত্তিক কে কে জড়িত-এটা পুলিশ জানে। চুরির মামলা দিলে দুইদিন পর জামিনে এসে আবার একই কাজ করছে তারা।  

 

কেএসআরএম’র গণমাধ্যম ও জনসংযোগ উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে একটি সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী চক্র এসব চুরির সঙ্গে জড়িত। চুরি রোধে প্রশাসনের তৎপরতা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। চুরি ঠেকাতে পুলিশের পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গাড়িতে টহল দল নিয়োজিত করা হয়। তবু হরহামেশা চুরির ঘটনা ঘটছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ না নেওয়া হলে তা কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব নয়। প্রতিবছর আমাদের প্রচুর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সাম্প্রতিক সময়েও আমাদের স্ক্র্যাপ পরিবহনের সময় গাড়ির গতিরোধ করে চালক-হেলপারকে রক্তাক্ত আহত করা হয়েছে। এসব ঘটনায় স্ক্র্যাপ পরিবহন ব্যয় বেড়ে বাজারেও প্রভাব পড়ে। ক্রমাগত চুরির ঘটনা ঘটতে থাকলে এ খাতের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সভায় স্ক্র্যাপ চুরির বিষয়ে থানায় মামলা দায়ের এবং কোম্পানীর আইনজীবীদের মাধ্যমে জামিনে বিরোধিতা করতে বলা হয়েছে। পরিবহনের সময় স্ক্র্যাপ গাড়ির বডি লেভেলের সমান, নেট লাগানো এবং রাস্তার মাঝখানে না দাঁড়াতে বলা হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, যাতে স্থানীয় স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্ক্র্যাপ কেনা না হয়। ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সীতাকুণ্ডের শীতলপুরে একেএস স্টিল মিলে ট্রাক থেকে মালামাল নামানোর সময় আবুল হাসেম নিরব (১৯) নামে এক তরুণের লাশ উদ্ধার করা হয়, যিনি ওই ট্রাকের মালামালের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। পরে এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে পুলিশ তদন্ত করে দেখে, চুরিতে বাধা দেওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছিলো।

চুরি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনায় বিষয়ে সিএমপির উপ-কমিশনার (ক্রাইম) মো.রইছ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, কারখানার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছি। প্রত্যেক কারখানাকে বড় গাড়ি ব্যবহার ও একসঙ্গে সারিবদ্ধভাবে চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে আমাদের পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তা প্রদান করছে। এছাড়াও আমরা সংশ্লিষ্ট থানার অফিসারদের টহল বৃদ্ধি এবং সর্বোচ্চ আইনগত সহায়তা দিতে নির্দেশ দিয়েছি।

এমআই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।