ঢাকা, বুধবার, ১৫ আশ্বিন ১৪৩২, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৭

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কোকেন পাচারের রুট বাংলাদেশ

মিনহাজুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:০৩, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
কোকেন পাচারের রুট বাংলাদেশ ...

চট্টগ্রাম: দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকা থেকে কোকেন এনে বাংলাদেশ হয়ে ভারত ও থাইল্যান্ডে পাচার করছে নাইজেরিয়ানদের নেতৃত্বে গড়া একটি আন্তর্জাতিক চক্র।  

চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোকেন জব্দের ঘটনায় চার বিদেশির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) চট্টগ্রাম মেট্রো।

এদের মধ্যে তিনজন নাইজেরিয়ান। মূল হোতা জ্যাকব ফ্র্যাঙ্ক ওরফে ডন ফ্র্যাঙ্কি ওরফে জন ল্যারি বর্তমানে নাইজেরিয়ায় অবস্থান করছেন।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কোকেন এনে বিমানযোগে বাংলাদেশ হয়ে ভারত বা থাইল্যান্ডে পাচার করা হতো। ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্র্যান্ড বাহামা দ্বীপের নাগরিক স্টাটিয়া শান্টিয়া রোলকে (৫৩) গ্রেপ্তার করে কাস্টমস গোয়েন্দা, নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও পুলিশ। তিনি পেশায় সেলসওম্যান এবং কম্পিউটার ইউপিএসের ভেতরে লুকিয়ে কোকেন বহন করছিলেন। পতেঙ্গা থানায় দায়ের হওয়া ৩ কেজি ৯ গ্রাম কোকেন জব্দের মামলা তদন্তে মূল হোতার নাম উঠে আসে।

একই চক্র ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার বিমানবন্দর দিয়ে মালাউইয়ের নাগরিক নারী নোমথানদাজো টাওয়েরা সোকোর সহায়তায় ৮ কেজি ৩ গ্রাম কোকেন পাচার করেছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কোকেন জব্দের ঘটনা। তখন ডিএনসি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, কোকেনের গন্তব্য ছিল ভারত এবং সেটি আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ ঘটনায় তিন বিদেশি ও দুই বাংলাদেশিসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখনই জ্যাকব ফ্র্যাঙ্ক ওরফে ডন ফ্র্যাঙ্কি ছিলেন ঘটনার মূল হোতা।

নগরের পতেঙ্গা থানায় কোকেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ও ডিএনসির পরিদর্শক লোকাশিষ চাকমা গত আগস্টে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে চার বিদেশির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন।  

অভিযোগপত্রে থাকা অন্য তিন বিদেশি হলেন- গ্র্যান্ড বাহামা দ্বীপের স্টাটিয়া শান্টিয়া রোল (৫৩), নাইজেরিয়ার লাগোসের আফিজ ওয়াহাব (৩৮) এবং আবুজার ইকেচুকু নওয়াগউ (৩১)। বর্তমানে তিনজনই কারাগারে আছেন। তদন্তে আংশিকভাবে চক্রটির কার্যকলাপ উন্মোচিত হলেও কোকেনের চূড়ান্ত গন্তব্য খুঁজে বের করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা।

ডিএনসি চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক লোকাশিষ চাকমা জানান, আমাদের দেশে এত বিপুল পরিমাণ কোকেন সেবনের মতো ব্যবহারকারী নেই। এগুলো বাংলাদেশ হয়ে ভারত বা থাইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আনা হয়েছিল। স্টাটিয়া শান্টিয়া রোল ব্রাজিল থেকে প্যাকেজটি পেয়েছিলেন। চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদে মালামাল পৌঁছে দিলে তিনি ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পেতেন। তদন্তে আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে, ওই নারী জ্যাকব ফ্র্যাঙ্ক ওরফে ডন ফ্র্যাঙ্কির সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেছিলেন।

তদন্তে আরও দুই নাইজেরিয়ান- আফিজ ওয়াহাব ও ইকেচুকু নওয়াগউ এর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তারা ঢাকায় বসবাস করে ওই নারীকে মালামাল বহনে তদারকি করতেন।

স্টাটিয়া শান্টিয়া রোল তদন্তকারীদের জানান, তিনি অবিবাহিতা ও শারীরিকভাবে অসুস্থ, যার চিকিৎসার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। তিনি তার কাজিন ডিয়ন পিন্ডরের কাছে আর্থিক সহায়তা চান। কয়েক দিন পর একজন ল্যারি নামের ব্যক্তি তার মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে সহায়তার প্রস্তাব দেন। পরে জন ল্যারি তাকে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে গিয়ে কিছু নথিতে সই করতে বলেন। স্টাটিয়া ২০২৪ সালের ৭ জুলাই বাহামা থেকে ব্রাজিলে যান। সেখানে গিয়ে তাকে বলা হয়, একটি উপহার হাতে হাতে একজনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং তিনি রাজি হন। অ্যালান নামে এক ব্যক্তি তাকে লাগেজটি দেন। জন ল্যারির নির্দেশ অনুযায়ী লাগেজটি গ্রহণ করতেন জোসেফ নামের এক ব্যক্তি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তার মাধ্যমে জন স্টাটিয়াকে নির্দেশনা দেন।

নথি অনুযায়ী, ১৩ জুলাই ওই নারী চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নেমে ৪ দিনের অন-অ্যারাইভাল ভিসা নেন। তিনি এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে আসেন। এর আগে স্থানীয় ‘মুসাফির ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ এর মাধ্যমে হোটেল আগ্রাবাদে একটি কক্ষ বুকিং করা হয়। বিমানবন্দরে লাগেজ বেল্ট থেকে ব্যাগ হারিয়ে গেলে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দেন। ১৫ জুলাই ব্যাগটি পাওয়া গেলে স্ক্যানিংয়ে সন্দেহজনক মনে হলে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং কোকেন উদ্ধার হয়।

অভিযুক্ত আফিজ ওয়াহাব একজন ফুটবল খেলোয়াড় এবং এক বাংলাদেশি নারীকে বিয়ে করেছেন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে থাকছেন। তার ভিসার মেয়াদ ২০১২-২০১৩ সালে শেষ হয় এবং তিনি আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তদন্তে জানা গেছে, আরেক নাইজেরিয়ান নাগিন স্টাটিয়ার জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে তার সন্ধান মেলেনি। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, পুরো চক্রের সদস্যরা একে অপরকে চেনেন না, ওপর থেকে একজন মূল যোগাযোগ পরিচালনা করে। ফলে কয়েকজন ধরা পড়লেও হোতা অদৃশ্য থাকে।

মামলার বাদী তৎকালীন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সার্কেলের পরিদর্শক জিল্লুর রহমান জানান, কোকেনের বাংলাদেশে বাজার নেই। বাংলাদেশকে কোকেন পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কোকেনের ইউরোপ ও আমেরিকায় বাজার রয়েছে। বড় বড় খেলোয়াড়রা কোকেন সেবন করে থাকে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে আসছে একটি চক্র।

এমআই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।