চট্টগ্রাম: মেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। চলছে ছুটি।
বেড়ানো শেষ। বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) বিকেলে ভাইয়ের বাসায় কাটানো এই কয়েকদিনের আনন্দের রেশ নিয়ে ফিরছিলেন নিজ গন্তব্যে খুলনাতে। না, আর ফেরা হলো না তার। নগরীর আলকরণ এলাকায় গাড়ি ধরতে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে তাদের বহনকারী সিএনজি অটোরিকশাটি রেললাইনের উপর উঠে গেলে দ্রুতগতিতে আসা শাটল ট্রেন ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান আনোয়ারা বেগম (৩৫)। এর কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে গেল তার বড় মেয়ে আফরিন বেগমও (১৪)। এ যেন আনন্দ করতে এসে মরদেহ হয়ে ফেরা।
এই দুর্ঘটনা শুধু এই পরিবারের মা মেয়েকে নিয়ে যায়নি। এখনও আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছে আনোয়ারার ছোট মেয়ে আয়েশা বেগম (৯)। সঙ্গে তার ফুপি মনি আক্তারও (৫৫)। ইতিমধ্যেই আয়েশাকে বাঁচাতে তার বাম পা কেটে ফেলা হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা ছোট্ট আয়েশা এখনও জানে না তার বড় আদরের মা-বোন এই পৃথিবীতে আর নেই।
জন্মের কয়েক বছরের মাথায় হারিয়েছিল প্রিয় বাবাকে। এবার বেঁচে থাকার অবলম্বন মা-বোনকেও হারাল আয়েশা। নিজেও জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বোন আর ভাগ্নের নিথর দেহের পাশে বসে আহাজারী করছিলেন আনোয়ারার ভাই মোরশেদ। তার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন বোন আর ভাগ্নেরা। একটু আগেই তাদের হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের মরদেহ। মানতে পারছেন না মোরশেদ ও তার স্ত্রী।
মোরশেদের স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আনোয়ারার স্বামী প্রায় আট বছর আগে মারা যান। এরপর থেকে দুই মেয়েকে নিয়েই কাটছিল তার দিন। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এখন তিনি ও তার বড় মেয়ে চলে গেলেন। আয়েশার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। কোনোভাবেই মানতে পারছি না বিষয়টি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আফরিন বেগম এবার ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছিল। বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) তার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। এ জন্যই তারা বুধবার খুলনার উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আর সেই ফলাফল দেখা হলো না। ’
এর আগে বিকেল তিনটার দিকে নগরীর মুরাদপুরের বিবিরহাট রেল ক্রসিংয়ের উপর তুলে দিলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা দ্রুতগতির শাটল ট্রেন আনোয়ারা বেগমদের বহনকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান আনোয়ারা বেগম। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহ স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্তৃব্যরত চিকিৎসক আফরিন বেগমকে মৃত ঘোষণা করেন। রেল লাইনের উপরে অটোরিকশা তুলে দিয়ে বিপদ আঁচ করতে পেরে পালিয়ে যান অটোরিকশা চালক।
‘সবশেষে’ : বেঁচে থাকলে খুলনার পথের অনেক দূর এখন যাওয়া হয়ে যেত আনোয়ারা বেগম ও তার মেয়েদের। তার বদলে আনোয়ারা ও তার মেয়ে আফরিনের মরদেহ পড়ে আছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
তাদের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করছেন ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জাকির হোসাইন। অন্যদিকে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকা আয়েশা বেগম ও তার ফুপি মনি আক্তারের অবস্থাও খুব ভালো নয় বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক আবদুল হামিদ।
বুধবার বিকেলে গাড়িতে উঠলে বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যেই খুলনায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। অবশ্য বৃহস্পতিবারের মধ্যেই হয়তো মা-মেয়ে ফিরবেন বাড়িতে। তবে চোখ দুটি আর খোলা থাকবে না। স্ট্রেচারে শুয়ে, সাদা কাপড়ে ‘বন্দি’ থেকে-এই যাত্রা হবে শেষ বারের মতো।
বাংলাদেশ সময় ২০১০ ঘন্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
টিএইচ/টিসি