চট্টগ্রাম: ২০১৭ সালের মধ্যে নগরীর পতেঙ্গায় সম্ভাবনাময় ‘বে-কনটেইনার টার্মিনাল’ নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও প্রাথমিক কাজই শেষ করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ‘বে-কনটেইনার টার্মিনাল’ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫ কোটি টাকায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বন্দরের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম জানান, একইসঙ্গে পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণের সমীক্ষার কাজও চলছে।
বন্দরের একটি সূত্র জানিয়েছে, যাদেরকে ‘বে-কনটেইনার টার্মিনাল’ নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নয়। ফলে এ টার্মিনালের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন হবে না।
সূত্র জানায়, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হলে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। পরিবেশগত সমীক্ষা সম্পন্ন হলে পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হবে। ভূমি পেলেই ১০০ একর জায়গায় নতুন ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে।
নির্মাণকাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি এই টার্মিনালেও পণ্য ও কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সব সুযোগ তৈরি হতো জানিয়ে সূত্র জানায়, বে-টার্মিনালটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এটি তৈরি হলে বন্দরের সক্ষমতা অনেক বেড়ে যেত।
এদিকে জাহাজ ও কনটেইনার জট নিরসনে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা দ্রুত বে-টার্মিনাল নির্মাণ সম্পন্নের দাবি জানিয়ে আসছে। বন্দরের সংকট নিরসনে বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম চেম্বার আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীরা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি তুলে ধরেছেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বাংলানিউজকে বলেন, দিন দিন যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে তাতে চট্টগ্রাম বন্দর সামাল দিতে পারবে না। এজন্য বিকল্প চিন্তা করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দ্রুত বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বে-টার্মিনাল নির্মাণ হলে জাহাজের সংখ্যা বাড়বে, যে কোন ড্রাফট এবং যে কোন সময় যাওয়া-আসা করতে পারবে। এতে বন্দরের স্থান সংকট দুর হবে। ১০০ একর জায়গায় ইয়ার্ড নির্মাণ করে সেখানে রফতানি কনটেইনার রাখার ব্যবস্থা করা যাবে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে আরও বেশি কনটেইনার রাখার সুযোগ তৈরি হবে।
সূত্র জানায়, বে-টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। বিকল্প এ বন্দর হলে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে পারবে পাঁচ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে একদিনে সর্বোচ্চ হ্যান্ডেল করতে পারছে এক হাজার ৭০০ কনটেইনারবাহী জাহাজ। এ বন্দরে ৯ দশমিক ৫০ মিটারের অধিক গভীরতার কোনো জাহাজ নোঙর করতে না পারলেও নতুন বন্দরে ঢুকতে পারবে ১৪ মিটার গভীর ড্রাফটের জাহাজও।
কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ৯০৭ একর জায়গা চিহ্নিত করে নতুন বন্দরের প্রস্তাবনায় অনুমোদনও দিয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নো অবজেকশন সার্কিফিকেটর কারণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হলেও কয়েকমাস আগে সার্টিফিকেট দিয়েছে সিডিএ।
বন্দরের হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমার শেষ প্রান্তে পতেঙ্গার অদূরে ১২ কিলোমিটার লম্বা চর জেগেছে। এতে চর ও উপকূলের মাঝামাঝি এক-দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত জাহাজ চলাচলের পথ বা চ্যানেল তৈরি হয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকার মতো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে সরাসরি বড় জাহাজ ভেড়ার সুযোগ নেই। কিন্তু নতুন চ্যানেলে দিন-রাত জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ থাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে বেশি গভীরতা ও দৈর্ঘ্যের জাহাজ চলাচলের সুযোগ তৈরি হবে। ফলে নতুন বে-টার্মিনালটি ঘিরে সিপিএ ও আমদানি-রফতানি ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু এটি নির্মাণে ধীর গতির কারণে হতাশ ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার রাখার জায়গা নেই। ফলে জাহাজ থেকে পণ্য নামতে দেরি হচ্ছে। এতে লোকসানে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।
বন্দরে কনটেইনার রাখার জায়গা বাড়াতে দ্রুত বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেভাবে কাজ এগিয়ে যাওয়ার কথা সেভাবে এগুচ্ছে না। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটি নির্মাণ করা জরুরি।
বিজিএমইএ এর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাছির উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে তাতে আগামী তিন বছরে এ বন্দর সামাল দিতে পারবে না। তাই বে-টার্মিনালকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে হাতে নিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। এটি নির্মাণ হলে আগামী ১০ বছর পর্যন্ত সামাল দিতে পারবে। এরপর গভীর সমুদ্রবন্দরের দিকে যেতে হবে।
জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিংয়ের (এইচপিসি) গবেষণা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে ২০৩৬ সালে ৫৬ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে। সমুদ্রপথে প্রতি বছরই বাড়তে থাকা বিপুল কর্মযজ্ঞ সামাল দিতে নতুন এ ছোট বন্দর হবে বড় ধরনের অবলম্বন।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬
এমইউ/আইএসএ/টিসি