চট্টগ্রাম: করোনা মহামারিতে বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল চট্টগ্রাম। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই নগরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আসলেই কোন পর্যায়ে আছে তা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা দিতে অনীহা সৃষ্টি করেছে অমানবিকতার দৃষ্টান্ত।
আইসিইউ ও অক্সিজেন সংকট
করোনার প্রকোপ শুরুর আগ থেকে চট্টগ্রামে আইসিইউ ও অক্সিজেন নিয়ে শুরু হয় নৈরাজ্য। একদিকে আইসিইউ না পেয়ে রোগীর মৃত্যু অন্যদিকে লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম।
গত ৯ জুন আইসিইউ সেবা না পেয়ে এক অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যু ছিল হৃদয়বিদারক ঘটনা। পাঁচদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা ওই নারী বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা না পেয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে অক্সিজেন সাপোর্ট পেলেও আইসিইউ না পাওয়ায় মৃত্যু হয় তার। এর আগে আইসিইউ সংকটে ২২ মে রাতে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে মারা যান এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম। এছাড়া নগর বিএনপির সহ-সভাপতি লায়ন মো. কামাল উদ্দিন, চবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের চৌধুরীর বাবা মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী, নগরের দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রীতি বিকাশ দত্তও আইসিইউ সুবিধা না পেয়ে মারা যান। এমন সব ঘটনায় প্রকাশ পায় কতটা অসহায় ছিল মানুষ। অক্সিজেনের অভাবেও মৃত্যু ঘটে করোনা আক্রান্ত প্রকৌশলী মো. শাহ আলম সহ কয়েকজনের।
তবে করোনা যেন শাপে বর হয়েছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জন্য। প্রতিষ্ঠার পর অবহেলিত এই হাসপাতালে যুক্ত হয়েছে ১০ শয্যার আইসিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনসহ নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা। এক সময় অবহেলার চোখে দেখা এই হাসপাতালের প্রতিও ফিরেছে মানুষের আস্থা।
বেসরকারি হাসপাতালে নৈরাজ্য
করোনার প্রথম থেকেই চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করে আসছিলেন বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা। এমন পরিস্থিতিতে রোগী আর স্বজনদের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের বাতাস।
চলতি বছরের ১৬ জুন সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে চার বছরের শিশু শাওন হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও মিলেনি সেবা। শেষ পর্যন্ত অকালেই পাড়ি জমাতে হয় না ফেরার দেশে।
শুধু শিশু শাওন নয়, বুকে ব্যথা নিয়ে কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু হয় শফিউল আলম ছগীর নামে এক ব্যক্তির। বাদ যাননি চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকও। নিজের করোনা আক্রান্ত মায়ের কিডনী ডায়ালাইসিস করতে কোনো বেসরকারি হাসপাতালই রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে মাকে নিয়ে তাকে ছাড়তে হয় চট্টগ্রাম।
এমনকি ম্যাক্স হাসপাতালের এক চিকিৎসক অভিযোগ তোলেন-নিজ প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার। শুধু শ্বাসকষ্ট বা জ্বরের রোগী নয়, সব ধরনের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয় তারা।
নৈরাজ্য ঠেকাতে ৩১ মে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বিকে সদস্য সচিব করে ৭ সদস্যের সার্ভিল্যান্স কমিটি গঠন করে দেন বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদ। এতেও কাজ হয়নি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও এখনও পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরেনি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে।
করোনার নমুনা পরীক্ষা ও জট
করোনার নমুনা পরীক্ষা প্রথমে একটি প্রতিষ্ঠানে করা হলেও পরবর্তীতে একে একে চট্টগ্রামে চালু করা হয় ৯টি ল্যাব।
প্রথমদিকে ল্যাবগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায় নমুনা জট। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীদের। সময়মতো করোনার রিপোর্ট না পাওয়ায় অনেক মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া একবার নমুনা দিলে তার ফলাফল পেতে সপ্তাহ থেকে মাস পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয় রোগীদের। এতে রোগীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে নগর জুড়ে।
সমস্যার যেন শেষ নেই, ল্যাব বাড়লেও দক্ষ লোকবলের অভাবে ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
নগরে লকডাউন
করোনা শুরুর পর থেকে সংক্রমণের লাগাম টানতে চর্চা শুরু হয় লকডাউন সংস্কৃতির। বাইরে লকডাউন, ভিতরে আড্ডা-এ যেন করোনাকে নিয়ে রসিকতা। নিয়ম না মেনে এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে প্রশংসার চেয়ে বেড়েছে বিতর্ক।
৪ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর থেকে বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করা হয়। এরপর সব জায়গায় শুরু হয় লকডাউনের হিড়িক। সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত না করে লকডাউন দেওয়ায় খাদ্যাভাবে ভুগতে হয় গৃহবন্দিদের।
সংক্রমণ বাড়তে থাকলে চসিক কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে চট্টগ্রাম সিটির ১০ এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু জোন ভাগ করা হলেও সুযোগ সুবিধা না রাখায় লকডাউনে যেতে পারেনি চসিক।
ব্যক্তি উদ্যোগে আইসোলেশন সেন্টার
করোনা ভাইরাসে সংক্রমণ শুরুর পর থেকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো যখন চিকিৎসা সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখন বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠে ফিল্ড হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার। অমানবিকতার বিপরীতে ধরা পড়ে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে প্রথমদিকে সেবা করার লক্ষ্যে আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করা হলেও পরবর্তীতে এটি রূপ নেয় রাজনৈতিক প্রেস্টিজ ইস্যুতে। একটি আইসোলেশন সেন্টার যেন স্থাপন না করলেই নয়। এমন মনোভাবে নগরজুড়ে বাড়তে থাকে আইসোলেশন সেন্টার।
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় প্রথম উদ্যোগ নেন ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। তার চেষ্টায় মাত্র ২১ দিনে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলে শুরু হয় চিকিৎসাসেবা। পরবর্তীতে চসিকের উদ্যোগে আইসোলেশন সেন্টার, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সংস্কৃতিকর্মী মো. সাজ্জাদ হোসেনের করোনা আইসোলেশন সেন্টার, মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিমের মুক্তি আইসোলেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. হোসেন আহম্মদ গড়ে তুলেন বন্দর ৫০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার। এছাড়া স্বেচ্ছায় শ্রম দিতে এগিয়ে আসা আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আইসোলেশন সেন্টার এবং সিএমপি-বিদ্যানন্দের যৌথ উদ্যোগে আইসোলেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও ছোট বড় আরও অনেক আইসোলেশন সেন্টার গড়ে ওঠে নগরে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২০
এমএম/এসি/টিসি