চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: বছর শেষ হলেও রেশ কাটেনি বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানান অসঙ্গতি ও বিভিন্ন খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানো এক অধ্যায়ের।
করোনাকালে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৪৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
যেসব খাতে অস্বাভাবিক ব্যয়
গবেষণা: চবির ২০২০-২১ অর্থবছরে গবেষণা খাতে বরাদ্দ হয় ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। নিয়মানুযায়ী কোনও শিক্ষক গবেষণা করতে চাইলে গবেষণাকেন্দ্রে প্রস্তাবনা জমা দিবেন এবং তার প্রস্তাবনা অনুমোদন পেলেই তিনি গবেষণা ভাতা পাবেন।
ইউজিসির এক প্রতিবেদনে এ ভাতাকে বিধিবহির্ভূত ও সরকারের আর্থিক ক্ষতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউজিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু গবেষণা খাতে নয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে চবির ১১টি খাতে ১২ কোটি ৯০ লাখ ১৫ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম পাওয়া গেছে।
বিদ্যুৎ বিল: করোনাকালে ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা সশরীরে অংশ নিতে পারেননি শ্রেণি কার্যক্রমে। এমনকি আবাসিক হলগুলোও ছিল বন্ধ। ফলে বিদ্যুতের ব্যবহার যে খুব একটা হয়নি, তা স্পষ্ট। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যয় দেখিয়েছে ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও বিদ্যুৎ খাতে এ খরচ দেখে বিস্মিত সংশ্লিষ্টরা। যেখানে পুরোদমে ক্যাম্পাস খোলা থাকা অবস্থায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিল ছিল ৫ কোটি ১৭ লাখ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের বিদ্যুৎ বিল ছিল ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
চিকিৎসা: চবির ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ ছিল ৫৫ লাখ টাকা। সেখানে ঔষধের ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৮ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫৮ লাখ টাকা। যেখানে ঔষধ ব্যয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। যদিও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে যথাযথ চিকিৎসা ও ঔষধ পান না তারা।
আপ্যায়ন: করোনা পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও শুধুমাত্র আপ্যায়ন বাবদ ৩৭ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছে চবি কর্তৃপক্ষ। যা রীতিমতো সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
খেলাধুলা: ২০২০-২১ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় হলভিত্তিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কোনও খেলার আয়োজন হয়নি। অথচ বছর শেষে খেলাধুলার ব্যয় দেখানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা।
পোশাক: ২০২০-২১ অর্থবছরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পোশাক খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা। যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবহন: করোনাকালে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দীর্ঘ ১৯ মাস বন্ধ ছিল চবির প্রধান যাতায়াত মাধ্যম শাটল ট্রেন। অথচ এ পরিবহন খাতে ভাড়া বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা।
ইন্টারনেট: ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও করোনাকালে ইন্টারনেট খরচেও কম যায়নি চবি কর্তৃপক্ষ। বছর শেষে ৬৫ লাখ টাকা ইন্টারনেট খরচ দেখিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন দিবস ও অনুষ্ঠান: বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সীমিত পরিসরে উদযাপন করা হয়েছে বিভিন্ন দিবস ও অনুষ্ঠান। কিন্তু এসব খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের মতোই। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপনে ৫ লাখ, জাতীয় দিবস উদযাপনে ১৫ লাখ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা। সর্বমোট ৪০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয় এ খাতে।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যত অনিয়ম
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ: বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি অনুযায়ী যথাযথ নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের তিনটি পদে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ ওঠে গত নভেম্বর মাসে। এমনকি নিয়োগ বোর্ডে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনও বিশেষজ্ঞ না রেখেই শেষ করা হয় নিয়োগ প্রক্রিয়া। বাকি ছিল শুধু সিন্ডিকেট সভায় সুপারিশ প্রাপ্তদের অনুমোদন।
সিলেকশন বোর্ডে বিভাগ সংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষজ্ঞ না রাখায় প্রশ্ন উঠেছে নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে। এছাড়া তিন পদের বিপরীতে ৫ জনকে সুপারিশ করায় এ নিয়েও হয় নানান আলোচনা-সমালোচনা। শুধু তাই নয়, এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রুল জারি থাকলেও রুলটি নিষ্পত্তি না করেই চালানো হয় নিয়োগ কার্যক্রম। এমনকি উচ্চ আদালতের কোনও শুনানিতেও অংশ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ‘নিন্দনীয় ও হাস্যকর’ বলায় শোকজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সিলেকশন বোর্ডে (নিয়োগ বোর্ড) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সদস্য রাখতে হয়। তবে চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে এবার ছিলেন না এ বিভাগের কোনও বিশেষজ্ঞ শিক্ষক।
এ বিষয়ে গত ২০ নভেম্বর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর এ ‘চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে নিয়ম না মেনেই নিয়োগ প্রক্রিয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে চবির এ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসেম বলেন, ‘সিলেকশন বোর্ডে সদস্যদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হয়। কিন্তু এবার সিলেকশন বোর্ডের কেউ ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিশেষজ্ঞ নন। এটা নিন্দনীয় এবং হাস্যকর’।
অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসেমের দেওয়া এ বক্তব্যের জন্য গত ২৪ নভেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুসারে কোনও বিভাগের শিক্ষকদের মধ্য থেকে (অধ্যাপক না থাকলে) ন্যূনতম সহকারী অধ্যাপক পদে কোনও শিক্ষককে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সভাপতি পদে নিয়োগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালের ৩০ মে ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের দুই শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার পরও গত ৭ মাস সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. এবিএম নাজমুল ইসলাম খানকে এ বিভাগের সভাপতি পদে বহাল রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে বিভাগের তিন স্থায়ী শিক্ষক প্রতিবাদ জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
এছাড়া গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির তৃতীয় সভায় বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও বিভাগের সভাপতি প্ল্যানিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই ৫ জন শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। এসময় মানসিক চাপ প্রয়োগ করে সভাপতি নিজের সিদ্ধান্ত মেনে প্ল্যানিং কমিটির সদস্যদের এ সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।
এরপর ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্ল্যানিং কমিটির চতুর্থ সভায় ৮ নভেম্বর হওয়া প্ল্যানিং কমিটির তৃতীয় সভার সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদনের বিষয়ে প্ল্যানিং কমিটির কোনও সদস্য সম্মতি দেননি। পরে সিদ্ধান্তগুলো বাতিল করার পরিবর্তে বিভাগের সভাপতি সভা স্থগিত করেন।
পদোন্নতির নিয়োগ বোর্ডেও প্রক্রিয়াগত ত্রুটি
সেকশন অফিসার পদোন্নতির নির্বাচনী বোর্ডে সিন্ডিকেট মনোনীত সদস্যের বাইরে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়াকে। বিষয়টিকে নিয়োগ বোর্ডের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি আখ্যা দিয়ে পদোন্নতি বোর্ড থেকে ২৫ নভেম্বর পদত্যাগ করেন চবির ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এস এম সালামত উল্যা ভূঁইয়া।
এছাড়া ২৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত পদোন্নতি নিয়োগ বোর্ডে প্রায় ১০০ জন পদোন্নতি পদপ্রার্থী থাকলেও সিলেকশন বোর্ডকে ৫৮ জনের ডকুমেন্ট দিয়েছে প্রশাসন। বাকি ৪২ জন প্রার্থীর কোনও ডকুমেন্ট পাননি বলে জানিয়েছেন সিলেকশন বোর্ডের সদস্যরা।
বিষয়টি নিয়মবহির্ভূত দাবি করে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, পদোন্নতির প্রার্থীদের সব ধরনের ডকুমেন্ট সিলেকশন বোর্ডের সদস্যদের দিতে হয়। যাতে পদোন্নতি প্রত্যাশী প্রার্থীদের সব শর্ত পূরণ হয়েছে কিনা তা জানা যায়। কিন্তু প্রশাসন ৫৮ জনের তথ্য সিলেকশন বোর্ডের সদস্যদের দিলেও বাকি অনেকেরই তথ্য দেননি। যা নিয়োগের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি।
রাতের আঁধারে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে পদ উধাও
চবির ১৩টি বিভাগের ১৯টি স্থায়ী ও ৩টি অস্থায়ী পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ২৫ নভেম্বর রাতে। তবে রাত পোহাতেই দেখা যায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে একটি পদের বিজ্ঞপ্তি।
বাংলানিউজের হাতে আসে আগে-পরে প্রকাশিত দুটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এতে দেখা যায়, প্রথমে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ১৬ নম্বরে থাকা চবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি স্থায়ী প্রভাষক পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিতে। এছাড়া নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আগের তারিখ কিংবা অন্য কোনও পদের পরিবর্তন করা হয়নি। এমনকি বিষয়টি চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়েই করা হয়েছে বলে অভিযোগ এ বিভাগের সভাপতির।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২২
এমএ/এসি/টিসি