কলকাতা: করোনা মহামারি কাটিয়ে দীর্ঘ দুই বছর পর কলকাতায় দশমবারের মতো শুরু হলো বাংলাদেশ বইমেলা। শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ বইমেলার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
এসময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজরুল ইসলাম, কলকতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনা আন্দালিব ইলিয়াস-সহ বিশিষ্টরা।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, ভাষা-সাহিত্য এসব বিষয় রাজনীতি, কাঁটাতার, পাসপোর্ট, ভিসা এবং সামাজিক আক্রমণ ইত্যাদি শব্দপুঞ্জকে অতিক্রম করতে পারে একটি শব্দ তা হলো বই। আর সেই বাংলাদেশ বইমেলায় মঞ্চে প্রধান অতিথির আসন আলো করে রেখেছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক, তিনবারের এমপি দীপুমণি।
তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দু’ভাগে ভেঙে যাওয়া বাংলার মন এবং হৃদয়কে কখন ভাগ করতে পারেনি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি। দুই বাংলাই একইসঙ্গে আনন্দে মেতে উঠি আবার ব্যথা বোধ করি। আর সেই হৃদয়কে দুইপারে জুড়ে রেখেছে বাংলা ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি। পড়শি দেশ যখন যুদ্ধ করছে আরেক পড়শি দেশের সঙ্গে। এবং পুরুষবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করছে, নারী বিদ্বষ যখন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন দুই বাংলা অর্থাৎ একটি দেশ এবং একটি রাজ্য হিসেবে তার শীর্ষে বসে আছেন দুজন নারী। দুই জনপ্রিয় নেতৃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারা যুদ্ধ প্রসুত বা আন্দোলন প্রসুত বাস্তবতা থেকে উঠে এসেছে। তাঁরা এই পরিস্থিতিতে শান্তি এবং সহিষুনুতার পথে, বাংলাকে পথ দেখাচ্ছে। চক্রান্ত থাকবে, কুৎসা থাকবে কলরব থাকবে। সবকিছু অতিক্রম করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাই নিজের দিকে তাকান, নিজেকে চিনুন, আর নিজেকে চিনতে বইয়ের বিকল্প হয় না।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি বাংলাদেশ বইমেলার পরিবেশের প্রশংসা করে বলেন, কলেজ স্ট্রিট হলো কলকাতার বইপাড়া। চারিদিকে এত নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমন একটি জায়গায় এই বইমেলা সত্যিই খুব আনন্দের। কলেজ স্কয়ার হলো বইমেলার আদর্শ জায়গা। আর বইয়ের থেকে ভালো সঙ্গী আর বোধহয় না।
বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসার তাতে বাংলাদেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তিনি বলেন, ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষাকে গোটা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। এরপর ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষা ভিত্তিক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গঠনের মধ্যদিয়ে বাংলাভাষা আরও উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি যখন বাংলা ভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দিলেন তারপর এই ভাষা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা রাখেন।
তার অভিমত, আমাদের দুই দেশের মধ্যে ভাতৃত্ব ও সৌহার্দের বন্ধন, তা আরো গভীর হয়েছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদির এই অঞ্চলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রচেষ্টা, এই প্রচেষ্টা আরও জায়গায় নিয়ে যাবে।
মমতা ব্যানার্জি এবং শেখ হাসিনার মধ্যেকার সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করে দীপু মনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত স্নেহভাজন হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি ঢাকার সম্মিলিত উদ্যোগে চলতি বছর এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে কলকাতার বইপাড়া বলে পরিচিত কলেজ স্ট্রিটের কলেজ স্কয়ার প্রাঙ্গণে। স্থানীয় সময় দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা অবধি ১০ম বাংলাদেশ বইমেলা চলবে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
প্রতিবারের মতো এ বছরও বাংলাদেশের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা, প্রতিষ্ঠান এই মেলায় অংশ নিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৬৮টি স্টলে, ৭৭টি বাংলাদেশি প্রকাশনার বই কলকাতার পাঠকদের কাছে হাজির করা হয়েছে। ২০১৯ সালে, ৯ম বাংলাদেশ বইমেলা হয়েছিল মোহরকুঞ্জ প্রাঙ্গণে। সেবার মোট ৮০টি প্রকাশনা অংশ নিয়েছিল। ৮ম বারে ছিল ৬৯টি এবং ৭ম’বারে ছিল ৪৭টি বাংলাদেশি প্রকাশনা।
প্রতিটি বইয়ের স্টলে বিপুল বাংলাদেশি বইয়ের সম্ভারের পাশাপাশি কলকাতার বইপ্রেমীদের জন্য প্রতিদিন থাকছে একমঞ্চে দুই বাংলার প্রতিথযশা শিল্পীরা। অংশ নেবে কলকায় অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। বইমেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করছে কলকাতার ভাষা ও চেতনা সমিতি।
আয়োজকদের মতে, কলকাতার বইপাড়া এমন একটা অঞ্চল যেখানে নিত্যদিন ভিড় লেগে থাকে। একদিকে যেমন গোটা বাংলার পাইকারি ও খুচরা বইয়ের বাজার এই কলেজ স্ট্রিট, অপরদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে কলেজ স্ট্রিটে। এছাড়া বাড়তি পাওনা কফি হাউসের আড্ডাপ্রেমীদের জমায়েত। ফলে কলেজ স্ট্রিট মানে বাংলাদেশ বইমেলার বাড়তি প্রচার। সেটাই আসল উদ্দেশ্য।
একসময় বাংলায়, বাংলাদেশি বইয়ে প্রাপ্তিস্থান ছিল কলকাতা বইমেলায়। পরবর্তীতে পাঠক সমাবেশ ও পত্রভারতীর যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশি বইয়ের স্থায়ী ঠিকানা হয় কলকাতার কলেজস্ট্রীটে। তারই মাঝামাঝি বাংলাদেশি বইয়ের পসরা নিয়ে ২০১১ সালে কলকাতায় পথচলা শুরু ‘বাংলাদেশ বইমেলা’। শুরু থেকে ৩ বছর গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় বইমেলাটি হয়। তবে শুরু হলেও নির্দিষ্টস্থানে মেলাটিকে ধরে রাখা যায়নি। পরবর্তিতে ৪ বছর মেলা হয় রবীন্দ্রসদনের খোলা প্রাঙ্গনে। এরপর রবীন্দ্রসদন চত্বর ঘুরে ৩ বছর বাংলাদেশ বইমেলা হয়ে আসছিল রবীন্দ্রসদনের পশ্চিম পাশে মোহরকুঞ্জ প্রাঙ্গণে। ২০১৯ সালে, শেষবার সেখানেই হয়েছিল। চলতি বছর ফের স্থান পরিবর্তন করে চলে এলো কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে। অয়োজকদের অভিতম, কলেজ স্ট্রীটের, কলেজ স্কোয়ার প্রাঙ্গণ-ই হবে বাংলাদেশ বইমেলার স্থায়ী ঠিকানা।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি মাজারুল ইসলাম বলেন, আমরা মনে করি কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলার মূল উদ্দেশ্য শুধু ব্যবসায়িক নয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করা। এরসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যাতে বাংলাদেশের খ্যাতনামা লেখক-কবিদের সঙ্গে উদীয়মান লেখদেরও চিনতে পারাটাই বাংলাদেশ বইমেলার মূল উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, ০২ ডিসেম্বর, ২০২২
ভিএস/এসএ