ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

‘পশ্চিমবঙ্গে পালাবদল’

২৪ বছর পর বুদ্ধদেবকে ছেড়ে যাচ্ছেন গাড়িচালক ওসমান

আনোয়ারুল করিম ও রক্তিম দাশ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১১
২৪ বছর পর বুদ্ধদেবকে ছেড়ে যাচ্ছেন গাড়িচালক ওসমান

আলিমুদ্দিন স্ট্রিট (কলকাতা) থেকে: মোহাম্মদ ওসমান। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবহন পুলের ড্রাইভার।

দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। শুক্রবার দুপুরের পর থেকে আর তিনি বুদ্ধদেবের সঙ্গে থাকছেন না। নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিনই বুদ্ধদেব তাকে বলেন, ‘ওসমান আপনি চলে যান। আমি এখন থেকে দলের গাড়িতে যাতায়াত করবো। ’

‘বুদ্ধদেবের এ কথা শুনে কেমন লেগেছিল’ এমন প্রশ্ন করতেই বাংলানিউজের প্রতিবেদকের কাছে কিছু বলতে পারলেন না ওসমান। চোখ তার ছলছল। চশমা খুলে চোখ মুছে বললেন, ‘১৯৮৭ সালে বুদ্ধবাবু আমাকে ডেকে নেন। সেই থেকে তিনি যে পদেই গেছেন, আমাকে সঙ্গে রেখেছেন। ’  

বুধবার দুপুরে কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্ক্সিস্ট) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দপ্তরের কার্যালয়ে কথা হয় ওসমানের সঙ্গে। পরিচয়ের প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের কথা শুনে কিছুটা আগ্রহ দেখান তিনি। এরপর নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যেই হয়ে পড়ছিলেন আবেগাপ্লুত।

সরকারি চাকরির সূত্রে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ছেড়ে যেতে হলেও তার মন কিন্তু বাঁধা থাকবে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ও পাম এভিনিউয়ে বুদ্ধদেবের সরকারি ফ্লাটটিতে।  

ওসমানের বাড়ি বিহার রাজ্যের মোজাফ্ফরপুর জেলার বোচাহার থানার উনসারটোলাপারাতি গ্রামে। ১৯৭১ সালে ভাগ্যের অন্বেষনে কলকাতায় আসেন। প্রথম কিছুদিন নানা স্থানে কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান। মুটে-মজুরের কাজও করেন বেশ ক’বছর। পরে একসময় ঠেলাগাড়িও চালান। এরপর এক বন্ধুর সাহায্যে গাড়ি চালানো শেখেন।

১৯৮২ সালে গাড়িচালক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরির সুযোগ হয় ওসমানের। এরপর তিনি বিভিন্ন সময়ে কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল রসুল, প্রয়াত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সরোজ মুখার্জি ও শৈলেন দাশগুপ্তের গাড়ি চালানোর সুযোগ পান। পশ্চিমবঙ্গ সফরে এলে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ও ভারতের মধ্যে প্রথম কেরালা রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের গাড়িও চালান ওসমান।

ওসমান বলেন, ‘প্রয়াত শৈলেন দাশগুপ্তের আগ্রহে ১৯৮৭ সালে তৎকালীন রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গাড়ি চালানোর দায়িত্ব নেন। ’

সেই থেকে শুরু। এরপর থেকেই বুদ্ধদেবের নিত্যসঙ্গী হয়ে যান তিনি। পাহাড় থেকে সাগরের তীর- বুদ্ধদেবকে সর্বত্রই নিরাপদে নিয়ে গেছেন ওসমান।

কমরেড জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০০১ সালের ১ এপ্রিল থেকে বুদ্ধদেব ভারতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ‘জেড প্লাস’ ক্যাটাগরিতে সংযুক্ত হন। তাকে দেওয়া হয় বুলেট প্রুফ গাড়ি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিলাসবহুল জিপ পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি অ্যাম্বাসেডর গাড়িকেই পছন্দ করেন।

ওসমান বলেন, ‘গত ১৩ মে দুপুরে বুদ্ধদেব আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিস থেকে যান রাজভবন। সেখানে পদত্যাগপত্র দিয়ে আবারও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে ফেরেন সোয়া একটার দিকে। ’

তিনি বলেন, ‘গাড়ি থেকে নেমেই তিনি (বুদ্ধদেব) সঙ্গের নিরাপত্তারক্ষীসহ অন্যদের বললেন, আপনারা চলে যান। ওসমান আপনিও চলে যান। বলেই তিনি ঢুকে পড়েন অফিসের ভেতরে। ’

সেদিন থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর সরকারি ‘বুলেটপ্রুফ’ গাড়িতে চড়ছেন না। যদিও পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনিই ‘ভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী’। তার জন্য সরকারি গাড়ি শুক্রবার পর্যন্ত বরাদ্দ থাকবে। তবুও তিনি ওই গাড়িতে চড়ছেন না।  

শুক্রবার থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চড়ছেন ডব্লিউ বি ০৬- ৪০৫৩ নাম্বারের সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে, যার মালিক সিপিআই (এম)।  

ওসমান জানান, তবুও দীর্ঘদিনের রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিন সকালে ডব্লিউ বি ০৬- ০০০১ নম্বরের গাড়িটি নিয়ে তিনি হাজির হন পাম এভিনিউয়ে বুদ্ধদেবের বাসায়। বুদ্ধদেব গাড়িটিতে চড়েন না। তবুও নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়ির সঙ্গে ফাঁকা গাড়ি নিয়ে তিনিও আসেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে।   বিকেলে আবারও একইভাবে ফাঁকা গাড়ি নিয়ে যান বুদ্ধদেবের বাসায়।

ওসমান বলেন, ‘শনিবার থেকে আমি পরিবহন পুলে ফেরত যাবো। ’

তবে এরপর কার গাড়ি চালাবেন তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। ওসমান বলেন, ‘২২ তাারিখ থেকে মাস খানেকের জন্য ছুটি নেবো। বিহারে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবো। সেখানে থাকবো কিছুদিন। ’  

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনই চাকরি ছাড়ার কথা ভাবছি না। ২০১৬ সাল পর্যন্ত চাকরির বয়স রয়েছে। ’

চার মেয়ে ও দুই পুত্রের জনক ওসমান এরই মধ্যে ২ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে রাজ্য সরকারের খাদ্য অধিদপ্তরে পিয়নের চাকরি পেয়েছে।

কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় সরকারি আবাসিক এলাকায় এক কামরার একটি বাসায় থাকেন ওসমান ও তার পরিবার। পান-সুপারি খাওয়া ছাড়া আর কোনো বদ অভ্যাস নেই বলেও জানান ওসমান ।

কেমন ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেবের সমালোচকরা বলেন, ‘তিনি ছিলেন দাম্ভিক, অহংকারী’! ওসমানকে এ প্রশ্ন করা হলে তার সরাসরি উত্তর, ‘একদমই না। রাস্তায় যেতে যেতে প্রায়ই তো বিভিন্ন বিষয়ে কথা হতো। আমাকেই তো কোনোদিন আপনি ছাড়া ‘তুমি’ বলেননি। ’

ওসমান বলেন, ‘রাজ্যের মুসলমানদের জন্য তার ভাবনা কম ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেও আমাকে প্রায়ই বলতেন, কোরআন পড়া শেখো, ধর্ম পালন করো, কিন্তু এর পাশাপাশি ইংরেজি ও কম্পিউটার শিখতে হবে। আর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার এই চিন্তার কারণেই তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল পরিবর্তন ঘটালেন। রাজ্যের মাদ্রাসা এখন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটি নমুনা। যেখানে হিন্দুরাও পড়ছে। ’

ওসমান বলেন, ‘বুদ্ধবাবু এখনও ধূমপান করেন। আমি অনেকবার বলেছি, এবার ছেড়ে দেন। ’   

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে ২৪ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা কী--- এপ্রশ্নের জবাবে ওসমান বলেন, ‘আমাকে সবসময় বলতেন, সত্যের পথে থেকো, এই পথের শেষ নেই। আমিও ওই একটিই বিষয় মেনে চলার চেষ্টা সারাজীবন করেছি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।