আগরতলা: ক্যামেরা, লেন্স আর ভয়েজ রেকর্ডারও হতে পারে যুদ্ধের ভয়ংকর অস্ত্র। রবীন সেনগুপ্তের কাছে অন্তত তাই।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা-ত্রিপুরার অবদানের কথা সবারই জানা। তবু মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আগরতলার এ মানুষটির কথা না বললে অনেকটা অসমাপ্ত থাকবে ইতিহাস।
সে সময়ের স্মৃতি আজও তাজা রবীনের মনে। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে মন খুলে জানালেন সে সময়ের অভিজ্ঞতাগুলোর কথা।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই তরুণ রবীন আজ ৮৫ বছরে। থাকেন আগরতলার ৫/১, মধ্যপাড়ার প্রশান্তি ভিলায়।
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ৯ মাস সিলেট থেকে ঢাকা হয়ে দক্ষিণের চট্টগ্রামে ক্যামেরা কাঁধে ছুটেছিলেন রবীন। তার ক্যামেরার লেন্সে উঠে আসে ঘাতক পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচারের ছবি, যা দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রে দেখে স্তব্ধ হয় বিশ্ব।
বাংলাদেশও তার অবদান ভোলেনি। বাংলাদেশ সরকার রবীনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দিয়েছে।
রবীন বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ডাক দেন, তার প্রভাব পড়ে ত্রিপুরায়। ত্রিপুরার বুদ্ধিজীবী মহল সে বছর ৩০ মার্চ আগরতলার সূর্য চৌমুহনীতে বঙ্গবন্ধুর বিশাল কাটআউট তৈরি করে। আয়োজন করে বিশাল মিছিলের। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা সাম্যের গান গেয়ে বাংলাদেশের আহ্বানে সমর্থন দেয়। এ মিছিলে পা মেলান রাজধানীর নানা শ্রেণী-পেশা ও বয়সের মানুষ।
২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু। ৩০ মার্চ ক্যামেরা আর ভয়েজ রেকর্ডারটি সঙ্গী করে বাংলাদেশের উদ্দ্যেশে যাত্রা করেন রবীন।
এ যাত্রা সহজ ছিল না। তখন প্রায় ৪০ বছর বয়স তার। ফটোগ্রাফি ও তথ্যচিত্র পাগল মানুষটি সবে সাতপাঁকে বাঁধা পড়েছেন। মিষ্টি বউটি তার চেয়ে ২০ বছরের ছোট। বিয়ের মাত্র ৮ মাসের মধ্যেই আসে মুক্তিযুদ্ধের ডাক।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ডাক তাকে টানছিলো। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আরেক সৈনিক জিয়াউর রহমান তখন আগরতলায় তার নিজ বাড়িতে এসেছিলেন। এসব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ঘরে থাকা দায় হয় রবীনের।
স্ত্রীকে রেখে পা বাড়ান যুদ্ধের ময়দানে। স্ত্রী চোখ জলে ছলছল। কিন্তু অভয় দেন রবীনের বাবা। বলেন, ‘আমার ছয় ছেলে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে যদি এক ছেলে শহীদও হয়ে যায়, আমি নিজেকে গর্বিত মনে করবো। ’
তারপর টানা ৯ মাস কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে। বাংলাদেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ঘুরেছেন হানাদারদের বীভৎস নির্মম অত্যাচারের ছবি
তুলতে, নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদের শব্দ রেকর্ড করতে।
যুদ্ধ চলাকালে খুব অল্পক্ষণের জন্য আগরতলায় আসতেন রবীন। যুদ্ধের ছবি পৌঁছে দেওয়া ও ক্যামেরার জন্য প্রয়োজনীয় ফিল্ম সংগ্রহের জন্যই ছিলো তার এ আসা। এ কাজে তার পাশে ছিলো ছোট দুই ভাই। রবীন তাদের বলে দিয়েছিলেন- ‘দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমের লোক বাড়িতে এলে তাদের বিনামূল্যে এসব ছবি দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। ’
এভাবেই বাংলাদেশের বন্ধু হয়ে ছিলেন রবীন সেনগুপ্ত, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশিদের পক্ষে জনমত গড়তেও ভূমিকা রেখেছিল তার ছবিগুলো।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
এসকেএস/এএ