কলকাতা থেকে ফিরে: সুরের জাদুকর রাহুল দেব বর্মণ মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছেন উড়ে এসে বসা একটি পাখির দিকে। চোখে চিরচেনা চশমা।
তার দু'হাত ভর দিয়েছে দুটি তবলায়। সামনে সবুজ ঘাসে একটি গিটার। ওটার ওপরেই দাঁড়িয়ে পাখিটি। সে চেয়ে আছে আরডি বর্মণের দিকে। পাখির চাহনিতে যেন কবিগুরুর ভাষা- 'তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী!'
এখানে সবুজ ঘাস ছাড়া সবই ভাস্কর্য। শিল্পীর নিপুণ কারুকাজ। কলকাতার অভিজাত এলাকা সাউদার্ন এভিনিউতে নজরুল মঞ্চ ও রবীন্দ্র সরোবরের সামনে গেলেই চোখে পড়বে রাহুল দেব বর্মণ বসে আছেন!
জীবদ্দশায় তিনি যেসব গান বানিয়ে গেছেন, সবই চিরসবুজ হয়ে আছে, থাকবে। ভাস্কর্যগুলো সবুজ ঘাসের ওপর রাখা তাই যথাযথ।
ভাস্কর্যটি গড়ে তোলা হয়েছে পঞ্চমদার সম্মানে। এটি বানিয়েছেন ভাস্কর নারায়ণ দত্ত। ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি আরডি বর্মণের প্রয়াণের দুই দশক স্মরণে এটি উদ্বোধন করেন কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী কিশোর কুমারের পুত্র অমিত কুমার। এই ভাস্কর্যের প্রতিষ্ঠাতা অমিত কুমার ফ্যান ক্লাব।
কিশোর কুমারের সঙ্গে রাহুল দেব বর্মণের রসায়ন জমতো বেশ। এই দু'জনের জুটি হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে উপহার দিয়েছে অসংখ্য কালজয়ী গান। মূলত আরডি বর্মণের সুরে গেয়েই কিশোরের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আশা ভোঁসলেকে নিয়েও অনেক গান তৈরি করেন তিনি। আশার বড় বোন লতা মঙ্গেশকরও বেশকিছু গান গেয়েছেন পঞ্চমদার সুরে। এর মধ্যে 'ও আমার ময়নাগো, কার কারণে তুমি একেলা' কে না গুনগুন করে।
রাহুল দেব বর্মণের আদুরে নাম ছিলো পঞ্চমদা। ছোটবেলায় তার কান্নার শব্দ অনেকটা ‘সারেগামাপাসা’র 'পা’র মতো শোনাতো। স্বরলিপির পঞ্চম সুরে কান্না করতেন বলেই তাকে ডাকা হতো পঞ্চম নামে। কলকাতায় তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালের ২৭ জুন। পৈতৃক সূত্রে বিখ্যাত এই সংগীতশিল্পীকে বলা যায় বাংলাদেশের মানুষ।
আরডি বর্মণের বাবা বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় বাংলা গানের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শচীন দেব বর্মণের ভিটেমাটি কুমিল্লায়। এখানেই তার জন্ম হয়েছিলো ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর। তাকে ডাকা হতো এসডি বর্মণ আর শচীনকর্তা নামেও। প্রায় ১০০ বছরের বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে তার কালোত্তীর্ণ গানের আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি।
শচীনকর্তার সুরে বেশিরভাগ গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, গীতা দত্ত, মান্না দে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলে ও শামসাদ বেগম। মুকেশ আর তালাত মাহমুদও গেয়েছিলেন। সুর করার পাশাপাশি ১৩টি বাংলা ও ১৪টি হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর তার প্রয়াণ হয়।
এসডি বর্মণের একমাত্র পুত্রসন্তান আরডি বর্মণ। ছেলেবেলায় ডানপিটে খোকা ছিলেন তিনি। তালিম নিয়েছেন শচীনকর্তার কাছেই। বাবার কাছেই রাজপাট বুঝে নিয়েছিলেন রুবি রায়ের গায়ক। তারপর এলেন সেলুলয়েডে। তার হাত ধরেই ষাট-সত্তর দশকে ডিস্কোকেন্দ্রিক পরিবর্তন আসে বলিউডে।
ষাট থেকে নব্বই দশক অবধি ৩৩১টি ছবির গানের সংগীত পরিচালনা করেন আরডি বর্মণ। আজও শ্রোতার মুখে মুখে ফেরে তার সুর করা হিন্দি ও বাংলা ছবির শত শত গান। মন প্রাণ মাতিয়ে বাতাস ভরায় এসব পঞ্চমী সুর। পরবর্তী প্রজন্মের সংগীত পরিচালকদের কাজে তার ব্যাপক প্রভাব পাওয়া যায়।
ভাস্কর্যটা দেখে আরডি বর্মণের অনেক গান মনে পড়ছিলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 'যেতে যেতে পথে হলো দেরি', 'শোনো এই তো সময়', 'তুমি কতো যে দূরে', 'দম মারো দম', 'ইয়ে জো মোহাব্বত হ্যায়', 'ইয়ে দোস্তি বাম নেহি ছোড়েঙ্গে', 'এক লাড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা', 'চুরালিয়া হ্যায় তুমনে জো দিল কো', 'ইয়ে শাম মাস্তানি' ইত্যাদি।
রাহুল দেব বর্মণ অনেক দূরে চলে গেছেন ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি। তার প্রয়াণে যেন পৃথিবীর সংগীত থেমে গিয়েছিলো! শুভ্রদেবের তো এমন কথার একটা গানই আছে তার প্রয়াণ নিয়ে। ভাস্কর্যটা দেখে মনে পড়লো ওটাও।
বাংলাদেশ সময় : ১১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
জেএইচ