ঢাকা থেকে ফিরে: আপামর বাঙালির দুটি বৈশিষ্ট্য জিনগত। এক ভোজন রসিক দুই ভ্রমণ প্রিয়।
সেটা যদি হয় আবার শীতের মরশুম। প্রথম বিশেষণটা আমার সাথে না মিললেও দ্বিতীয়টা মিলে যায়। আমার মত অনেক বাঙালির ভোরের সূর্যোদয় দেখাটা, অনেকটা লটারির টিকিট কাটার মত।
ঢাকায় এবার অামার ভোরের আলো দেখার সুযোগ মেলে। উদ্দেশ্য দু’টো, এক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর ভিনদেশী পরিযায়ী পাখি দেখা, দ্বিতীয়টা মনের আশ মিটিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠার স্বাদ নেওয়া।
এই শুনে আমার এক সহকর্মী বলেছিল। "এত সকাল সকাল কেন? এত সকালে কি এত ধরনের পিঠা খাওয়া যায়? "ভাবলাম, ঠিকই তো, সকাল সকাল পিঠা খাওয়ার কি আছে?
পিঠা, পশ্চিমবাংলার বাঙালিরাও খায়। তবে সময় পালটেছে। পশ্চিমবাংলার মা-দাদি, নানীদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ের জোর কমে গেছে। তা বলে কি এই জেনারেশনে ছেলেমেয়েরা পিঠা খায় না? খায় তো। ইন্টারনেট দেখে। তাদের মধ্যে আবার গসিপও চলে কোন দোকানে পিঠাওয়ালা সাথে পিঠাটাও ভালো। তাই নৈবে নৈবাচঃ। অতএব পিঠা খেতে হয় আমাদের কিনে।
পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা পিঠাটাকে মিষ্টির বিভাগেই ফেলে। এখন চলছে ফিউশনের যুগ। পিঠারও ফ্লেভার চেঞ্জ হচ্ছে। পিঠাকে আকর্ষণীয় করতে তার মধ্যে মিক্সড হচ্ছে আম, আনারস, স্ট্রবেরি, চকলেট ইত্যাদি।
তাই বলে কি, পশ্চিমবাংলার ঘরে পিঠা হয় না। হয় তো। পৌষ-সংক্রান্তি দিনে ঘরে ঘরে কমবেশি একটু আধটু পিঠা করেন মায়েরা। দুধ পুলি, ভাপা পিঠে, পাটিসাপটা এবং অারও কয়েক ধরনের। এগুলো হয় চালের গুড়ো, ময়দা, সুজি নারিকেল, নতুন গুড়, ক্ষীরের মিশ্রনে। এবং এই পিঠাগুলোর আসল স্বাদ পাওয়া যায় পরের দিন।
কিন্তু ঢাকায় এবার আমার পিঠার স্বাদ আমূলভাবে বদলে গেল। গরম গরম রুটি, লুচি খেতেই আমরা অভ্যস্ত। পিঠাও নাকি গরম গরম খাওয়া যায়। তাও আবার শুধু মিষ্টি না। ঝাল, ভাজা, ভাপা বিভিন্ন রকমের।
একবার স্বর্গীয় দৃশ্যটি ভাবুন, শীতের সকালে কাঠের জ্বালের চুল্লির সামনে বসে কখনো পিঠার সাথে মিশ্রণ হচ্ছে শুটকি, মরিচ, জিরা, ধনেপাতা আরও কত ধরনের ভর্তা। আবার কখন হাঁস, মুরগী, কবুতরের গোসত মিশিয়ে নিঃশব্দে গলধঃকরণ করা। আবার কখনো নতুন গুড়, নারকেল, দুধ ইত্যাদি দিয়ে সেবন। এ শুধু নিজের তৃপ্তি নয়, অন্তর আত্মাকেও তৃপ্তি করা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শুক্রবার আমার এবং আমাদের যাওয়া। ভিনদেশী পাখি পশ্চিমবাংলার জলাধারগুলোতেও আসে। আসে না শুধু বাংলাদেশের পিঠার গন্ধ আর তার স্বাদ।
এতক্ষণে নজর পড়ল অামার সেই সহকর্মীর দিকে। যে আমায় বলেছিল এত ভোরে কি, এত ধরনের পিঠা খাওয়া যায়। ওমা, একি সে তো নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে। জিজ্ঞেস করলাম খেতে পারছো তো? উত্তরে সে বলে, খাও খাও শুধু পেট ভরে নয়, মন ভরে খাও। তোমার দেশে তো এসব পাবে না। আর খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।
বাঙালির আর দুটি স্বভাব বিরাজমান। সেটা হল আগ্রহ ও কৌতূহল। রসনা সম্পূর্ণ হয় তখনি যখন জানা যায় কি দিয়ে তৈরি হয় এ সব সুস্বাদু। বাংলাদেশে পিঠের স্বাদ বাড়ে নতুন আউশ ধানের চালে। সে চাল যদি হয় শিশুমতী বা পরাঙ্গী, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
কলকাতায় রাস্তার মোড়েমোড়ে অাছে, বিভিন্ন দেশের ফাস্ট ফুড। নেই শুধু আমার বাংলাদেশ। কয়েকটা দোকান ঢাকার নামে চলে। তবে তাদেরই বোকা বানানো যায়, যারা আসল বাংলাদেশের রসনার স্বাদ নেয়নি।
ঢাকায় দেখলাম পিঠা শিল্পটা রাস্তার মোড়ে মোড়ে। কেন শিল্পটা আন্তর্জাতিক মাত্রা পাচ্ছে না বুঝি না। এতক্ষণে যে পিঠা শিল্পীর শিল্প ভোগ করছিলাম। সে আর কেউ নয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে সাধারণ এক পিঠা বিক্রেতা। তিনি জানান,"শীতের চারমাস পিঠার ব্যবসা করি। বাকি আপনাদের আর আল্লার দোয়ায় আটমাস চলে যায়। "
আর এই কারণেই পিঠার দেশ বাংলাদেশ।
** মাওয়ার পদ্মা এবং ইলিশ পর্যটন
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা,ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
ভি.এস/আরআই