ঢাকা: খাদ্য নিরাপত্তা ও পল্লী অঞ্চলে অর্থ সরবরাহে বাড়তি ছয় হাজার ৮০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করছে সরকার। বাড়তি এ কৃষি ঋণের কৃষক পর্যায়ে সুদ হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে এ ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। কৃষি ঋণের জন্য বাড়তি এ তহবিল নিয়মিত ৩০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত। সব মিলিয়ে কৃষিঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
করোনা মহামারি পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সরবরাহে জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে। বেড়েছে খাদ্যমূল্য। পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কাকে সামনে রেখে সরকার খাদ্য উৎপাদনে আরও বেশি মনোযোগ দেয়।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট তৈরি হলেও যাতে দেশে এ পরিস্থিতি না আসে; আমদানি না করেও যাতে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বজায় থাকে সে লক্ষ্য থেকেই খাদ্য উৎপাদনে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয় সরকার। সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে কম সুদ হারে এ ঋণ বিতরণ করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে কৃষিতে অর্থসরবারহের স্কিমগুলো হলো - খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়নে স্কিম। ঋণের কৃষক পর্যায়ে সুদ হারের বিষয়টি নির্ধারণের কাজ চলছে।
এছাড়া গম ও ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধিবিষয়ক এক হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন। এ ঋণ বিতরণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে শতকরা ৫০ পয়সা হারে (দশমিক ৫ শতাংশ) পাবে। আর কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করা হবে ৪ শতাংশ হারে। স্কিম থেকে ইতোমধ্যে ৯১ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচনে রয়েছে ৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম। গ্রাহক পর্যায়ে এ ঋণের সুদ হার ৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলো পাবে ৫০ পয়সা হারে। এ স্কিম থেকে বিতরণ হয়েছে ১৪৬ কোটি টাকা। এ ঋণ বিতরণ চুক্তিবদ্ধ ব্যাংকগুলো কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করার পর ক্লেইম করলে বাংলাদেশ ব্যাংক সমপরিমাণ টাকা দিয়ে দেবে।
এদিকে পাট উৎপাদন, বিপনন ও প্রক্রিয়াজাত করণে সংশ্লিষ্টদের কাছে সরকারি সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ৩০০ কোটি টাকার স্কিম হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থেকে ৪ শতাংশ হারে সংগ্রহ করে গ্রাহক পর্যায়ে ৭ শতাংশ হারে বিতরণ করবে।
খাদ্য উৎপাদনে যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণে মূলধন প্রয়োজন। মূলধনের এ চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলধন স্কিম গঠন করেছে। এর মাধ্যমে কৃষি খাতে অর্থের প্রয়োজন মিটবে। এবং কৃষি উৎপাদনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো: মেজবাহুর রহমান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বৈশ্বিক যুদ্ধপরিস্থিতিসহ নানা কারণে খাদ্য সরবারহের যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলায় বাড়তি এসব স্কিম। এ ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে অনুশাসন আছে, বিষয়টি মাথায় রেখে খাদ্য উৎপাদনে এসব স্কিম হাতে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আমাদের নিয়মিত প্রায় ৩০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ কার্যক্রম তো চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাড়তি ছয় হাজার ৮০০ কোটি টাকার ঋণের বাইরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বিতরণ করবে। গ্রাহক পর্যায়ে এ ঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। এ ঋণের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক পুরোটাই বিতরণ করবে কৃষকদের মাঝে। আর বাকি অর্থ সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের কমপক্ষে ২ শতাংশ কৃষিঋণ হিসেবে বিতরণ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ঋণ বিভাগের তথ্য বলছে, এ ঋণের জুলাই-ফেব্রুয়ারি আট মাসের কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রার বেশি ইতোমধ্যে বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে। যথারীতি আগে বিতরণ করা ঋণ ফেরতও আসছে।
খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিকে আধুনিকায়ন ও বড় বিনিয়োগের বিষয়টি যুক্ত হয়ে পড়েছে। আবার পল্লী কর্মসংস্থানও জড়িত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, সে লক্ষ্যকে সামনে শস্য উৎপাদন, সেচ যন্ত্র ক্রয়, কৃষি যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, পল্লী কর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণ কার্যক্রমে কৃষি ঋণের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে কৃষিতে উৎপাদন যেমন বাড়ছে, প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে উঠছে।
এসব বিষয়কে সামনে রেখে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান কৃষিতে সকল ব্যাংকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কমপক্ষে ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেন।
সে সময় ঋণের পরিমাণের পাশাপাশি মানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পর্যবেক্ষণ জোরদার করা হয়। এখনো যা বহাল রয়েছে। এবং সময় সময় কৃষি ঋণের পরিধি বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। সব ব্যাংক কৃষি ঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে কৃষিতে ভূমিকা রাখবে সেটাই মূল কথা। এক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ বিতরণ করতে পারতো না। এখন শুধু দেশী ব্যাংকই নয়, বিদেশী ব্যাংকগুলোও কৃষিঋণ বিতরণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।
তিনি বলেন, দুটি ভাবনা থেকে তারা কৃষিঋণ বিতরণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। প্রথমত: কৃষিও এখন বড় হচ্ছে, এখন আর সেই কৃষি নেই। এখন খামার, কৃষি প্রক্রিয়াকরণের মতো মাঝারি থেকে বড় কার্যক্রম চলে আসছে। দ্বিতীয়ত: খাদ্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণের জায়গা থেকেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ বিতরণ করছে।
কৃষিঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে পল্লী অঞ্চলে যে সব ব্যাংকের নিজস্ব শাখা নেই তারা এনজিও লিংকেজ ব্যবহার করে বিতরণ করছে।
কৃষি ঋণ বিতরণ যেমন নিশ্চিত করা হয়েছে, মান নিয়ে কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠছে। ব্যাংকগুলো শাখা পর্যায়ের অনীহার কারণে সঠিকভাবে বিতরণ হচ্ছে না, কৃষকরা ঋণ নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কৃষকরা ব্যাংক বিমুখ হচ্ছেন। একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিজস্ব অনুসন্ধানেই এমন চিত্র পাওয়া গেছে। সংশ্লিস্টরা বলছে, এসব সমস্যা দূর করতে আরও বেশি মনোযোগি হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৩
জেডএ/এসএএইচ