মৌলভীবাজার: গত কয়েকদিনে অস্থির হয়ে উঠেছে লেবুর বাজার। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ এই ফলের চাহিদা বেড়েছে।
চায়ের পর লেবুর জন্য বিখ্যাত শ্রীমঙ্গল। রাজধানী ঢাকার কয়েকটি কাঁচাবাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রীমঙ্গলের লেবু সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বেশি দাম দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত লেবু।
সোমবার দুপুরে শ্রীমঙ্গলের কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, লেবুর সরবরাহ কম। খুচরা বিক্রেতারা শুধু সবুজ রঙের লেবুই নয়, আধাপাকা হলুদ রঙের লেবু নিয়েও বসেছেন। আর সেগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। কোনো লেবুই আটকে থাকছে না।
খুচরা বিক্রেতা লিটন মিয়া জানান, আজ আমি আড়ত থেকে ৮০০ পিস লেবু কিনেছি সাত হাজার ২০০ টাকায়। প্রতি পিস লেবুর দাম পড়েছে নয় টাকা। তবে সব লেবু সমান নয়। উপরে যে আকারের লেবু আছে, নিচে এই আকারের লেবু নেই। উপরে মাঝারি আকারের, আর নিচে ছোট। ছোটটাও ১০ টাকায় বিক্রি করতে হবে। মাঝারি আকারের নয় টাকা দিয়ে কেনা লেবুও ১৫ টাকায় বিক্রি করতে হবে।
আরেক খুচরা বিক্রেতা সালমান মিয়া বলেন, লেবুর বাজার এখন অতিরিক্ত গরম। আমি ছোট আকারের লেবু ৪০ টাকা হালি বিক্রি করছি। তবে পাকা লেবু ৮০ টাকা হালি বিক্রি করছি। পাকা লেবুর চাহিদা বেশি।
লেবুর আড়তদার রাজিব বলেন, প্রকৃতিগত কারণেই লেবুর উৎপাদন বর্তমানে কম। কিন্তু সেই তুলনায় চাহিদা খুব বেশি। নাটোরেও লেবু আছে। বীজবিহীন বা সিডলেস লেবু যেটাকে বলে, ওই লেবুরও একই অবস্থা। অস্বাভাবিক দাম। শুধু নাটোর নয়, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের লেবুর দামও বাড়তি।
তিনি বলেন, আমাদের শ্রীমঙ্গলের কাগজি লেবুর ডিমান্ড (চাহিদা) তুলনামূলকভাবে বেশি। আমাদের লেবুটা যায় ঢাকার কারওয়ান বাজার, রায়ের বাজার, শ্যাম বাজার ও যাত্রাবাড়ী বাজারে। বলা যায় আমাদের লেবু ঢাকামুখী। এ ছাড়া মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, বিয়ানীবাজার, বড়লেখা ও সিলেটের বাজারও আমাদের দখলে। রোববার আমি প্রায় ছয় লাখ টাকার লেবু বিক্রি করেছি। দৈনিক গড়ে শ্রীমঙ্গলে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকার লেবু বিক্রি হয়।
এই আড়তদার বলেন, দুই হাজার লেবু বর্তমানে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকায় এখন বিক্রি হচ্ছে। এই লেবুই প্রায় তিন মাস আগে ছিল সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা। সোমবার সকালে চার হাজার লেবু বিক্রি করেছি ৬৪ হাজার টাকায়। রোববার সাত হাজার ৪২০ পিস লেবু এক লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। প্রতি পিস গড়ে প্রায় ১৫ টাকা।
তিনি বলেন, এই চালান যাবে রায়েরবাজারে। গাড়ির খরচ আছে, শ্রমিকের খরচ আছে। এই লেবু প্রতিটি ২০ টাকায় বিক্রি করলে লাভ থাকবে। গত শনিবার সাত হাজার ৪০০ পিস লেবু এক লাখ আট হাজার ৫০০ টাকা করেছিলাম।
এই আড়তদার বলেন, চাহিদার তুলনায় লেবুর সরবরাহ অনেক কম। কারো টার্গেট পূরণ হয় না। সারা দিন যখন বৃষ্টি বেশি হয় বা অন্যান্য জায়গায় লেবু বেশি থাকে, তখন চাহিদা কম থাকে। তবে কোনো লেবুই ফেলে দেওয়া হয় না। রোজার মাসে তো টার্গেট একটু বেশি থাকে। যেমন আমাকে ঢাকা থেকে অর্ডার দিয়েছে ২০ হাজার লেবু পাঠানোর জন্য। কিন্তু সারাদিনেও আমি ২০ হাজার লেবু মেলাতে পারব না। ১০ হাজার লেবু মেলাতেই অবস্থা কাহিল হবে।
তিনি বলেন, আমি প্রায় ১৩ বছর যাবত আড়তদারি করি, আমি কখনো ২৫ টাকা পিস লেবু বিক্রি হতে দেখিনি। তিনটি আকারের লেবু আছে। বড়, মাঝারি ও ছোট। তাহলে ২৫ টাকায় কেনা বড় আকারের লেবু ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়, মাঝারি ৩০ টাকা এবং ছোট লেবু ২৫ টাকা বিক্রি করতে হবে। বাগানে চাহিদামতো লেবু নেই।
বাগান মালিক আতর আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমার ২৫ কিয়ার (বিঘা) লেবু বাগান রয়েছে। প্রতিদিন ঠেলাগাড়ি করে ৮০০ পিস লেবু পাইকারি বাজারে পৌঁছে দিই। বর্তমানে বড় আকারের ৮০০ লেবুর আড়ত-দাম ১৭ হাজার থেকে ১৮ হাজার। আর মাঝারি আকারের লেবুর দাম ১০ হাজার ১৫ হাজার। আর ছোটগুলোর দাম পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা। এখন আমাদের বাগানের গাছে পর্যাপ্ত লেবু নেই। কিন্তু হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে গেছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের পর থেকে লেবুর দাম কমতে থাকবে। তখন প্রতি পিস লেবু এক টাকা থেকে দুই টাকায় চলে আসবে।
লেবুর ফলন নিয়ে তিনি বলেন, পৌষ মাসে কুয়াশা ছিল। কুয়াশার কারণে গাছে লেবু থাকে না। হঠাৎ কুয়াশা পড়ার সঙ্গে সূর্যের তাপ পর্যাপ্ত না থাকায় গাছ পুষ্টি পায় না। লেবুগুলো লাল হয়ে পড়ে যায়। শীত মৌসুমে অনেক লেবু আমাদের নষ্ট হয়। তখন প্রতি পিস তিন থেকে চার টাকা বিক্রি হয়।
তিনি আরও বলেন, এখন ফাল্গুন মাস চলছে। গত দুই-তিন মাস আমরা গাছে লেবু ধরাতে পারিনি। পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থাও নেই। আমাদের পুরো বাগানে একটি মোটর চলে এবং মাত্র দুই-তিন কিয়ার (বিঘা) জায়গার মধ্যে পানি দেওয়া যায়, বাকি জায়গাগুলোতে পানি দেওয়া যায় না। ঘুরিয়ে দিতে দিতে আবার এদিকে মাটি শুকিয়ে যায়। পর্যাপ্ত পানির অভাবে লেবুগুলো ম্যাচিউর (পরিণত) হয় না। সেগুলোর ভেতরে রস থাকে না।
লেবুর ভরা মৌসুমের নিজের ক্ষতি কথা উল্লেখ করে এই চাষি বলেন, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে লেবু বিক্রি করে তেমন দাম পাই না। কিন্তু গাছে পর্যাপ্ত লেবু থাকে। কিন্তু কেউ কিনতে চায় না। যেমন আমি গত জ্যৈষ্ঠ মাসে জিপ গাড়িতে করে পাঁচ হাজার লেবু বিক্রি করেছিলাম, তখন আড়তের দাম ছিল মাত্র তিন হাজার ৬০০ টাকা। জিপগাড়ি ভাড়া এক হাজার ২০০ টাকা, পাঁচ হাজার লেবু গাছ থেকে তুলতে অন্তত দুই হাজার টাকা চলে যায়। সব মিলিয়ে লাভ তখন থাকে না।
এই বছরে ৮০০ পিস লেবুর বিপরীতে শ্রমিক খরচ, গাড়িতে করে লেবু বাজারে নেওয়া, আড়তখরচ বাবদ প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ পড়ছে বলে জানান আতর আলী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৌলভীবাজারের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, এখন তো লেবু ধরার কথা নয়। লেবুর সময় তো হলো বর্ষাকাল। চাহিদার তুলনায় যোগান কম, সেজন্যই দাম খুব বেশি। সম্প্রতি আমি এক হালি লেবু ৬০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। যে লেবু বাগানগুলোতে লেবু ধরেছে, সেসব বাগানের লেবুচাষিরা লাভবান হচ্ছেন।
হিমাগারে লেবু সংরক্ষণের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লেবুর জন্য জেলায় একটি অত্যাধুনিক কোল্ডস্টোরেজের (হিমাগার) দাবি আমাদের রয়েছে। তাতে করে কৃষকেরা এক-দুই মাসের জন্য লেবুগুলো সংরক্ষণ করে হিমায়িত রাখতে পারবেন। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে আমাদের মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক কোল্ডস্টোরেজের প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০২৫
বিবিবি/আরএইচ